অপারেশন সিঁদুর আর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রোজকার যে ভয়ানক ঝামেলা, গোলাগুলি, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, আকাশপথে লড়াই, এই সবের মধ্যেই একটা খবর সামনে এসেছে যেটা সম্ভবত এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জানি না কেন এখনও ভারত সরকার এ নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি, কিন্তু সে কথায় পরে আসছি। ভারত সরকার সেই প্রথম দিন থেকেই বলে আসছে যে পহেলগামের ঘটনার পিছনে আছে পাকিস্তান, তাদের প্রত্যক্ষ মদতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো উঠেছে, কারণ পহেলগামের ঘটনা নিয়ে অনেকেরই নানান বক্তব্য ছিল, ভারত কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি, অন্তত প্রত্যক্ষ এমন কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি যা নিশ্চিত করবে যে এই ঘটনায় পাকিস্তানেরই ভূমিকা আছে। হ্যাঁ, অনেকেই পাকিস্তানের মাটিতেই অ্যাবোটাবাদে সামরিক ছাউনির পাশেই শেল্টার পেয়েছিল ওসামা বিন লাদেন, এ তথ্য ভুলে যায়। পাকিস্তানে লস্কর-এ-তইবা বা জইশ-ই-মহম্মদের মাথারা ঘুরে বেড়ায় অনায়াসে, সেকথাও ভুলে যায়। অনেক পাকিস্তানিও বলেছেন যে এটা একটা সাজানো ঘটনা, যার কোনও ভিত্তি নেই। আর তারা এই কথাগুলো বলতে পেরেছে কারণ সত্যিই কেবল কিছু মানুষের কথাবার্তা ছাড়া, উগ্রপন্থীদের কিছু রেকর্ডেড কমিউনিকেশন এই ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসাজশের সেরকম কোনও প্রমাণ ছিল।
আসুন যে তথ্য আর প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমেই নাম উঠে এসেছে এক কোম্পানির, মক্সার টেকনোলজিস, অনেকেই জানে এটা একটা বড় আমেরিকান কোম্পানি যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে এবং যারা বাণিজ্যিকভাবেই হাই রেজোলিউশনের স্যাটেলাইট ছবি বিক্রি করে। রেজোলিউশন যত বেশি, দামও তত বেশি। এটা প্রায় মিলিটারি গ্রেডের, ইউক্রেনের যুদ্ধে তো ইউক্রেনীয়রা মক্সারের ছবির উপর নির্ভর করে অনেক আক্রমণ করেছে বা ঠেকিয়েছে। ট্রাম্প যখন জেলেনস্কিকে যুদ্ধবিরতি বা শান্তিচুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছিল, তখন প্রথম যে কাজটা করেছিল সেটা হল মক্সারের এই ছবি ইউক্রেনকে বিক্রি করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা, আর জেলেনস্কি তাতে বেশ বিপদেই পড়েছিল। তো হঠাৎই দেখা গেল, এই মক্সার কোম্পানির কাছে পহেলগাম অঞ্চলের স্যাটেলাইট ছবির জন্য অনেকে ভেরি হাই রেজোলিউশনের ছবি চেয়ে অর্ডার দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসটা এমনিতেই ছোট মাস, তো এ বছর ২৮ দিন ছিল। সেই ২৮ দিনে ৩০টা অর্ডার পড়েছিল পহেলগাম অঞ্চলের ছবির জন্য। প্রথমে মনে হয়েছিল ১২টা, কিন্তু পরে দেখা গেল ৩০টা অর্ডার। তার মানে কেউ সেই পরিমাণ টাকা এর পিছনে খরচ করেছে। প্রতিটা ছবির ন্যূনতম দাম তিন লক্ষ টাকা। রেজোলিউশন যত বেশি, দামও তত বেশি।
এই রেজোলিউশন ব্যাপারটা বোঝাই, যদি ১০ পিক্সেল রেজিলিউশনের স্যাটেলাইট ছবি পাওয়া যায়, তাহলে যেখানকার ছবি দেওয়া হবে সেই রাস্তায় যে কোনও মানুষকেও স্পষ্ট চেনা যাবে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে ১৫ পিক্সেল বা তার কমে স্যাটেলাইট ছবি নিতে গেলে সেই দেশের অনুমতি লাগে। তাই এখানে ৩০ পিক্সেল রেজোলিউশনের ছবির অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, আর তাতে মানুষ চেনা না গেলেও সেই অঞ্চলের রাস্তা, লোকালয়, সব খুব পরিষ্কার বোঝা যাবে। মানে সেই লোকালয়ের একটা স্পষ্ট ধারণা করা যাবে, পুলিশ মিলিটারি পোস্ট ইত্যাদিও চিহ্নিত করা যাবে। যা নিয়ে একজন অজানা পথে পাড়ি দিতে পারে, যা নিয়ে একজন পহেলগাম থেকে এলওসি পার করে আসতেও পারে, যেতেও পারে। তার মানে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল, যার কোনও খবরই পায়নি আমাদের দেশের ইন্টেলিজেন্স, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স? তো একটা বিষয় তো পরিষ্কার হল যে কেউ একজন সেই পরিমাণ টাকা এই স্যাটেলাইট ছবিগুলোর জন্যে খরচ করেছিল। মজার ব্যাপার হল, এর আগের ১২ মাসে পহেলগামের ছবির জন্য গড়ে প্রতি মাসে মাত্র দেড়টা অর্ডার পড়ত। তাহলে হঠাৎ করে সেটা দেড়টা থেকে ১২টা হয়ে গেল কেন? তারপর মার্চ মাসে কোনও অর্ডার নেই। এপ্রিল মাসে, পহেলগামের ঘটনার পর, ২৪ আর ২৯ এপ্রিল আবার নতুন করে পহেলগামের ছবির জন্য মক্সারের কাছে অর্ডার দেওয়া হল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কাশ্মীরে হানাদারদের রুখেছিলেন শহীদ মেজর সোমনাথ শর্মা
অথচ তার আগের ১২ মাসে মক্সারের কাছে পহেলগামের ছবির জন্য প্রায় কোনও অর্ডারই ছিল না। অর্থাৎ পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা কোন রাস্তায় আসতে পারে তা ঠিক করা হল, আর ঘটনার পরেই তাদের জানানো হল, কোন রুটে কোন কোন বাধা আছে। এবারে যা জানার তা হল হঠাৎ করে পহেলগামের ছবির প্রতি এত আগ্রহ কেন আর কার হতে পারে? আর সেই আগ্রহটা ফেব্রুয়ারিতে একেবারে শিখরে পৌঁছল? আর যদি তাই হয়, তাহলে মার্চ মাসে কোনও অর্ডার নেই কেন, অথচ ঘটনার পর আবার অর্ডার দেওয়া হল? তার মানে যারা এসেছিল, তারা পালানোর রাস্তা, এসকেপ রুটও জেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। এর পরে যা জানা গেল তা আরও চমকে দেওয়ার মতো, মক্সারের কাছে পহেলগামের ছবির অর্ডার যখন বেড়েছিল, ঠিক তখন বিএসআই প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটা ছোট্ট কোম্পানি অনেকদিন পরে আবার অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছে। বিএসআই প্রাইভেট লিমিটেড, যার মালিক পাকিস্তানি ওবেদুল্লা শাহ, সে মক্সারের পার্টনার হয়। এটাও জেনে রাখুন যে আপনি টাকা দিলেন আর ছবি পেলেন এমন কিন্তু নয়, একমাত্র পার্টনাররাই মক্সারের কাছে অর্ডার দিতে পারে, বা অন্য কারও কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে তা এগজিকিউট করতে পারে, সেই পার্টনারশিপের জন্য আলাদা ফি লাগে।
তো সেই ওবেদুল্লাহ শাহ সদস্য হলেন, আর তারপর থেকে হু হু করে পহেলগামের ছবির চাহিদা বাড়তে শুরু করল। আবার ঘটনার পরে ঝুপ করে বন্ধ হয়ে গেল। এই ওবেদুল্লাহ শাহের বা এই বিএসই প্রাইভেট লিমিটেডের বেশ গোলমেলে অতীত, ওবেদুল্লা শাহকে এর আগে আমেরিকার ভাষায় চার্জ করা হয়েছিল, বিচার করা হয়েছিল, অভিযুক্ত করা হয়েছিল, দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং এক বছর এক দিনের কারাদণ্ড আর চার বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। কেন? পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি কমিশনে আমেরিকান প্রযুক্তি হস্তান্তর নিয়ম লঙ্ঘন করে পরমাণু গোপন তথ্য ও সংবেদনশীল সরঞ্জাম বিক্রি করার জন্য। কে জোগাল এই বিপুল পরিমাণ জরিমানার টাকা? কেউ জানে না। এই ওবেদুল্লা সাহেবের এক বছর এক দিনের কারাদণ্ড শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরেই সে এই কোম্পানি অংশীদার হয়। মানে এই লোকটার মাধ্যমেই ছবি কেনাবেচা হয়েছে, কেবল তাই নয়, এটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে মক্সার কোম্পানি নিজেই প্রথমে জানিয়েছিল যে বিএসআই তাদের কাছ থেকে কোনও ছবি কেনেনি, অন্য কেউ হয়তো কিনেছে। কিন্তু তারপর সব তথ্যপ্রমাণ সামনে আসতেই দেখা গেল তড়িঘড়ি করেই বিএসআই-এর নাম অংশীদারদের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে!
এই ওবেদুল্লা তার এক বছর এক দিনের সাজা শেষ করেছেন, তারপর উধাও, ইন্টারনেটে কোথাও নেই, তিনি যেন এক অবয়বহীন ভূত। তার কোনও ডিজিটাল পদচিহ্ন নেই। একটা টুইটার অ্যাকাউন্ট আছে, তবে সেটাও যে এই নির্দিষ্ট ওবেদুল্লা শাহের কি না, তা হলফ করে বলা যাবে না। এমনকী সেই টুইটার অ্যাকাউন্টে শেষ পোস্টটা ২০১৪ সালের, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক মানুষের। তার পরে তিনি গায়েব, হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। তার একমাত্র অস্তিত্ব ছিল মক্সার পোর্টালের পার্টনার হিসেবে, যেখানে ওবেদুল্লা শাহকে অংশীদার আর প্রাথমিক যোগাযোগের ব্যক্তি হিসাবে জানানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। পাকিস্তানের বেশ কিছু নাগরিকের এরকম অনেক ঘটনা আছে, তাদের উদ্যোগেই হঠাৎ কিছু সন্দেহজনক সংস্থা গজিয়ে ওঠে, কিছু ব্যবসা শুরু করে, বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করে, জিনিসপত্র কেনে, বিভিন্ন জায়গাতে সেসব জিনিস পাঠাতে শুরু করে, আর হঠাৎই গায়েব হয়ে যায়। আবার বহু পরে কোথাও ভেসে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মামলা চলাকালীন খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে কীভাবে বিএসআই পাকিস্তানি পারমাণবিক শক্তি কমিশনের জন্য একটা ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে উঠেছে এবং তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক সে কথাও বলা হয়েছিল। এখন এই পহেলগামের ঘটনাতে ওই ওবেদুল্লা শাহ আর বিএসআই প্রাইভেট লিমিটেডের ভূমিকা খুব স্পষ্ট করে বলে দেয় যে এই ঘটনার পিছনে পাকিস্তানেরই হাত আছে।