জ্যোতি নরসিঙ্ঘানন্দজি মহারাজ, গাজিয়াবাদে বিপাসনা দেবী মন্দিরের মহন্ত, সেই মন্দির যেখানে ক’দিন আগে জল খেতে গিয়েছিল আতিস নামে এক মুসলমান কিশোর, তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সে স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারছে না। তাঁর দোষ, সে মুসলমান, হিন্দু মন্দির যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানে ঢুকেছিল। এই স্বামীজীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল? নির্দয়ভাবে এক কিশোরকে মারধর করার ব্যাপারে কোনও এফআইআর হয়েছিল? না হয়নি। তারপর থেকে ওই মন্দিরে ২০ জন ইউপি পুলিশের পাহারা বসানো হয়। এখন মন্দিরে ঢুকতে গেলে আধার কার্ড দেখাতে হবে। কারণ? জেহাদি মুসলমানরা নাকি জ্যোতি নরসিঙ্ঘানন্দজিকে খুন করার পরিকল্পনা করেছে। তাই মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। হাতে ইনসাস, এলএমজি নিয়ে বাবাজীর নিশ্ছিদ্র পাহারার বন্দোবস্ত করেছেন যোগীজির সরকার। এক মহন্তের সুরক্ষার ব্যবস্থা আরেকজন মহন্ত করবেন, এতে আর অবাক হবার কী আছে? ওই মন্দিরে বসেই সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে, এই জ্যোতি নরসিঙ্ঘানন্দজি। উনি সন্ন্যাসী হবার আগে ছিলেন দীপক ত্যাগী। উনি নাকি মস্কোতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য গিয়েছিলেন। উনি নাকি লন্ডনেও কর্মসূত্রে বেশ কিছুদিন ছিলেন, এবং দেশে ফেরার পর চেষ্টা করেছিলেন রাজনীতিতে নামার। সে সময় উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম যাদব, অখিলেশ যাদব সমাজবাদী পার্টির বোলবালা, তো উনি ওই দলেই ভিড়েছিলেন। তারপর ওনার কথা অনুযায়ী লাভ জিহাদের ঘটনায়, এক হিন্দু নারীর ওপর অত্যাচারের ঘটনা শোনার পরে তিনি এই আধ্যাত্মিক জীবনে আসেন। লক্ষ্য ইসলাম বিরোধিতা। হয় তিনি থাকবেন, না হলে ইসলাম থাকবে।
এসব বলার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর? কে করবে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও তো একই কথা বলছে, অথচ আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিরোধী এই তীব্র ঘৃণা ছড়ানো মানুষটাকে জেলে পোরা তো দূরস্থান, তার পুলিশি পাহারার বন্দোবস্ত করা হল। এগিয়ে এলেন বিজেপি নেতারা, সবচেয়ে আগে কে? কপিল শর্মা। কোন কপিল শর্মা? যিনি দিল্লি নির্বাচনের সময় শ্লোগান দিয়েছিলেন, দেশ কে গদ্দারোঁ কো, গোলি মারোঁ শালোঁ কো, সেই শ্লোগানদাতা কেবল পাশে দাঁড়ালেন না, ২৫ লক্ষ টাকা ডোনেশন দিলেন, মন্দির বানানোর জন্য। মন্দির চত্ত্বরে বসে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর জন্য। তিনি ওখান থেকে সাফ জানালেন ইসলাম হল শয়তানের ধর্ম, কোনও এফআইআর? না, হয়নি। কেউ বলেনি, কোনও মিডিয়া প্রশ্ন তোলেনি, অর্ণব গোস্বামী নেশন ওয়ান্টস টু নো, বলে চিৎকার করেনি, ঘন্টাখানেক কলতলায় ঝগড়া হয়নি। এমনকি দেশের বিরোধী নেতারাও কোনও প্রশ্ন করেননি, এই বাবাজীকে জেলে পোরার দাবিও তোলেননি। বরং বাবাজীকে আস্কারা দেওয়া হয়েছে, বাবাজীর ভক্ত সংখ্যা বেড়েছে, ইউটিউব ফলোয়ার বেড়েছে, অতএব বাবাজীর সাহসও বেড়েছে। এবার তিনি প্রকাশ্যেই বললেন, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম একজন টেররিস্ট, তিনি পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক, তার অনেক প্রমাণ আছে। এসব কথা গোপনে নয়, ওই মন্দিরে বসেই জানালেন। কেউ প্রতিবাদ করলো? দেশের রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে এই জাতীয় কুৎসার বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর হল? না হয়নি, ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তিনি এবং তাঁর ভক্তরা শ্লোগান দিয়েছেন, দেশকে ইসলাম মুক্ত করবেন।
মার্চ ২০২১, বাংলায় নির্বাচন, বাবাজী মাঠে, নদিয়াতে হিন্দুদের কতল এ আম হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের খুন করা হচ্ছে, দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক ভারতের জিন্নাহ, তাঁকে জেলে পোরার দাবি জানালেন। নির্বাচনের সময় এই সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর জন্য, মহামান্য নির্বাচন কমিশন কিছু বলেছে? না বলেনি, কারণ একই কথা তখন কাঁথির খোকাবাবু শুভেন্দু বা গরুর কুজে সোনার খোঁজ পাওয়া দিলীপ ঘোষও বলে চলেছেন, সেদিন ছেড়েই দিন, আজ যখন নির্বাচন হিংসা নিয়ে সিবিআই মাঠে, আদালত মাঠে, তাঁরা কিছু বলেছেন? না বলেননি। শুনুন সেদিন এই বাবাজী কী বলেছিলেন, তিনি সাফ বলছেন, মমতা, অখিলেশ, তেজস্বী এরা সব আধুনিক ভারতের জিন্নাহ, বলছেন নদিয়ায় হিন্দু খুনের দায়ে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেলে পোরা উচিত। সরকার ভেঙে দেওয়া উচিত। আমরা বার বার বলেছি, বিজেপি আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মত নয়, বিজেপির মাথায় আছে আরএসএস, আর সেই আরএসএসের তলায় আছে অজস্র সংগঠন, ব্যক্তি, তারা সবাই মিলে একটা এজেন্ডাকেই সামনে রেখে চলে, তা হল এক অখন্ড হিন্দু রাষ্ট্র, ইসলাম মুক্ত ভারত। যারা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা, বিজেপিতে আছে, তারা সরাসরি এতটা উগ্রভাবে হিন্দুত্বের প্রচার করত না, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তত তারা নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলছে, মোদি – শাহের পরে বিজেপির হিন্দুত্বের পোস্টার বয় আদিত্যনাথ যোগী ওসব সংবিধানের ধার ধারেন না, সরাসরি ইসলাম বিরোধী প্রচার করেন। লাভ জেহাদের বিল এনেছেন। জনসভায় বলছেন বাবরের বাচ্চাদের এদেশে ঠাঁই নেই। প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে মোদিজি সরাসরি সেটা বলছেন না, কিন্তু প্রতিবাদও করছেন না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেবল মুসলমান বলে, মানুষ পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে, জ্যান্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সেই হত্যাকারীদের জামিনের পর, তাদের রথে বসিয়ে মিছিল করা হচ্ছে। সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, মাঝে মধ্যে দু একটা দুঃখপ্রকাশ। আর অন্যধারে হিন্দু জাগরণ সমিতি, বিভিন্ন মন্দিরের মহন্ত নিয়ে আর এক মাকড়সার জাল সোচ্চারে, গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। এদের ইশারায় তৈরি হচ্ছে তালিবানের মত হিন্দু উগ্রপন্থী। তারা খুন করছে উদার মতবাদীদের, খুন হচ্ছে গৌরি লঙ্কেশ, দাভোলকর, পানসারেরা। হিংসা লাগানোর কাজ করছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কারণ তারা একটা কথা স্পষ্ট বুঝে গেছে, ৭০/৭৫% হিন্দু ভোটের মেরুকরণ দরকার, তারা সেই লক্ষ্যে চলেছে। গাজিয়াবাদের বিপাসনা মন্দিরের মহন্ত জ্যোতি নরসিঙ্ঘানন্দজি ও সেই মাকড়সার জালে বসে থাকা এক মাকড়সা। সেও তার কাজ করছে, না হলে হিন্দু ধর্মের উদারবাদ কী করে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার কথা বলতে পারে? যে ধর্মে ইশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা চার্বাককে মহর্ষি বলা হয়, দৈত্যাচার্য শুক্র পূজনীয় হন, মহারাজ প্রিয়ব্রত তাঁর কন্যাকে দৈত্যাচার্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁদেরই সন্তানের নাম দেবযানী। এতটাই উদার হিন্দু ধর্মের নাম করে এই মূর্খের দল তাদের নোংরা খেলা খেলে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে উল্টোখেলাও তো হয়, আপনি গুন্ডাকে প্রশ্রয় দিলে সেই গুন্ডা, আপনার বা আপনার পরিবারের ওপরেও তো চড়াও হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়, যে সব লোকজন নিয়ে বিজেপির এই হিন্দু মহাসম্মেলন, তাদের অনেকেই তো বহু নোংরা কাজের দায়ে জেলেও আছে। এইসব স্বয়ম্ভু বাবাজী মাতাজীদের কন্ট্রোল করাটাও তো সহজ নয়। তার উদাহরণ আর একবার পাওয়া গেল, গাজিয়াবাদের এই বাবাজীর এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, এই ক’দিন আগে, সেখানে উনি মহিলাদের সম্পর্কে যথেচ্ছ কটূক্তি করেছেন শুধু নয়, তাঁর বক্তব্য বিজেপি যথেষ্ট ইসলাম বিরোধী নয়। এক যোগী আদিত্যনাথকে বাদ দিলে, বাকিরা সেই মুসলিম তোষণের মধ্যেই আছেন। বিজেপি দলের মহিলারা আসলে দলের পুরুষ নেতাদের রক্ষিতা, তারা একজন নেতাকে ধরেই তাদের রাজনীতি করেন। ব্যাস, এটা বলার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে তিন তিনটে এফআইআর হয়ে গেছে, এমন কি কপিল শর্মাও টুইট করে এনাকে গ্রেফতার করতে বলেছেন, বিবেক অগ্নিহোত্রী, চলচিত্র পরিচালক, বিজেপি’র খুব কাছের লোক তিনিও টুইট করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিজেপির মহিলা শাখা থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু এখনও গাজিয়াবাদের মন্দিরে এই বাবাজীর সুরক্ষার জন্য ২০ জন পুলিশ মোতায়েন আছে, এখনও তিনি একইভাবে যোগীজির প্রশংসা করছেন, আর ইসলামের বিরুদ্ধে জেহাদের কথা বলে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রপতিকে টেররিস্ট বললে এফআইআর হয় না! দেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পোরার দাবি জানালে প্রতিবাদটুকুও হয় না! প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ালে এফআইআর হয় না! কিন্তু যেই মাত্র তিনি বিজেপি নেতাদের চরিত্র নিয়ে খুলে আম বলা শুরু করলেন, ওমনি এফআইআর হল! এটাই বিজেপি এটাই আরএসএস, কেবল দেখার এই ফ্রাঙ্কেস্টাইনের সমাপ্তি কখন? কোথায়? কিভাবে হয়।
https://youtu.be/RFIqcHgw47Q
17.43 – 18.11 (মমতা, অখিলেশ এরা সবাই আসলে জিন্না)
14.09 – 14.28 (মমতা কে জেলে পোরা উচিত)
25.41 – 26.00 (ইসলাম কে শেষ করবো)
32.50 – 33.14 (আল্লাহ শয়তান)
3.20 – 4.22 (আবদুল কালাম একজন টেররিস্ট ছিলেন)
4.32 – 4.59 (হিন্দু বৈজ্ঞানিকদের খুন করিয়েছেন)
এই লিঙ্ক গুলো দেখুন শুনুন সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।