বেশিদিন নয়, মোদিজি গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে, মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে যারা কাস্ট সেনসাস, জাতিগত জনগণনার দাবি করছিলেন, তাঁদের কেবল সমালোচনাই করেননি, বলেছেন, চিনে রাখুন, পহচান লিজিয়ে, ইয়ে লোগ আর্বান নকশাল হ্যায়, এরা সব্বাই আর্বান নকশাল। এবং সব্বাই জানে বাবু যত বলে পারিষদগণে বলে তার শতগুণ। বাবুর পারিষদেরা বলতে শুরু করলেন এরা সব ওই টুকরে টুকরে গ্যাং, হিন্দুদের বিভক্ত করে দিয়ে মুসলমানদের সুবিধে করে দিতে চাইছে। নানান তত্ত্ব ভেসে এল, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে গান্ধী আর সাভারকর দুজনেই নাকি একসঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তার ইতিহাস খাড়া করা হল। ঘটনা হচ্ছে সাভারকর হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ মানতেন না কারণ তিনি জানতেন যে কেবল হিন্দু উচ্চবর্ণের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা অসম্ভব। কাজেই তিনি সেই দলিতদের জন্য এক আলাদা মন্দিরও বানিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে অভিযান ছিল অচ্ছুৎ-হরিজনদের সম্মান দেওয়ার জন্য। তাঁরাও হিন্দু, হিন্দু জাতির এক অংশ, তাঁদেরও এই রাষ্ট্রের সম্পদের উপরে সমান অধিকার আছে তা বলার জন্যই গান্ধীজি জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সে যাই হোক, সেই আর্বান নকশাল ইত্যাদিতেই থেমে থাকেনি প্রচার অভিযান। নব্য হিন্দু হৃদয় সম্রাট যোগী আদিত্যনাথ তাঁর ভাষণে বলেছিলেন বঁটেঙ্গে তো কটেঙ্গে। মানে সাফ, যদি আমরা বিভাজিত হতে থাকি তাহলে ওরা আমাদের কেটে ফেলবে। ওরা মানে মুসলমানেরা। মোদিজি আর একটু নরম করেই বললেন, এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়।
রাহুল গান্ধী বা দেশের সোশ্যালিস্টদের জাতিভিত্তিক জনগণনাকে এক বিভাজনের চক্রান্ত বলে প্রচারে নেমেছিল বিজেপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল, নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের চৌকিদার, নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি। তারপর হঠাৎ কী হল যে মোদিজি জাতিগণনার ঘোষণা করে দিলেন? হ্যাঁ, বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী প্রচার কিছুটা হলেও বিরোধীদের আগের পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার রাস্তা থেকে সরিয়ে এনে কিছুটা সফট হিন্দুত্ব, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলতে বাধ্য করেছে। ঠিক সেই রকমই দেশের সোশ্যালিস্ট, লোহিয়াপন্থী, জয়প্রকাশপন্থী বা কাশীরামের আন্দোলন এবং শেষে সেই আন্দোলনে কংগ্রেসের নেমে পড়া বিজেপিকে বাধ্য করেছে এক ইউ টার্ন নিতে। কতটা নৌটঙ্কি, কতটা কেবল ভোটের প্রচার তা নিয়ে বিচার পরে হবে, কিন্তু বিজেপি এক কবর খোঁড়ায় হাত দিল যা নিয়ে তাদের পরে পস্তাতে হবেই। আসুন সমস্যাটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। ভারতের সমাজ কাঠামো অনেক পুরনো এবং জটিল। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগাভাগি শুধু সামাজিকভাবে নয়, অনেক সময় তা মানুষের জীবনধারায়, পেশায়, এমনকী শিক্ষার সুযোগেও বিরাট বড় প্রভাব ফেলেছে। স্বাধীনতার পর সংবিধানে এই জাতি-ভিত্তিক বিভাজনকে দূর করার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা সর্বত্র রয়ে গেছে, এখনও তার ছাপ স্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে। একদিকে কেউ কেউ বলছেন, এটা সমাজে বিভাজন আরও বাড়াবে, অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন— এই তথ্য ছাড়া প্রকৃত সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জাতপাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান বাস্তবতাটা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? ভারতীয় সমাজে জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষকে বর্ণ ও উপবর্ণে ভাগ করার ঐতিহ্য তো আজকের নয়, বহু পুরনো। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— এই চার প্রধান বর্ণের ভিতরেও রয়েছে হাজার হাজার উপবর্ণ বা জাতি। এই ব্যবস্থায় জন্মই ঠিক করে দেয় কার কী কাজ, কার কেমন জীবনযাপন হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে জাতপাতের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠলেও তা মূলত উচ্চবর্ণের সুবিধাভোগী ব্যবস্থার স্বরূপকেই বজায় রেখেছে, তার বাহ্যিক সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে বটে, কিন্তু আদতে তা একইভাবে কার্যকরী। এদিকে স্বাধীনতার পর ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে সমানাধিকার দিয়েছে— জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ এখনও বিভিন্নভাবে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে পিছিয়ে পড়ে আছে। সরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান— সব ক্ষেত্রে এই বৈষম্য স্পষ্ট। সংরক্ষণ নীতি লাগু করে এই বৈষম্য কিছুটা কমানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সেই নীতির কার্যকারিতা বিচার করতে গেলে নির্ভরযোগ্য ও আপডেটেড তথ্যের দরকার। মানে কিসের ভিত্তিতে সংরক্ষণ হবে? সেটা তো আগে জানা দরকার। সেইজন্যই দরকার জাতিভিত্তিক জনগণনা। বর্তমানে ভারতের জনগণনায় শুধু তফসিলি জাতি (SC) ও তফসিলি উপজাতি (ST)-র তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে ওবিসি (OBC)-দের নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। ২০১১ সালের জনগণনায় সরকার কিছুটা চেষ্টা করেছিল জাতিভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করার, তবে সেই তথ্য আজও প্রকাশিত হয়নি। সরকার বলেছে, ডেটা বিশ্লেষণ করা কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর, তাই তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কেন কঠিন? কেন তা আজও হল না, সরকার কিন্তু তা নিয়ে মুখ খোলেনি। এই যুক্তি স্বাভাবিকভাবেই অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি সরকারি নীতির লক্ষ্য হয় সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠা, তবে ঠিক কত মানুষ পিছিয়ে আছে, তারা কোন পেশায় যুক্ত, তাদের আয় বা শিক্ষার স্তর কী— এসব তথ্য জানা অত্যন্ত জরুরি। জাতিভিত্তিক জনগণনা করলে এসব তথ্য সামনে আসবে, যা সরকারের নীতিনির্ধারণে সাহায্য করতে পারে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি চান মুখে তালা ঝোলাতে
তাহলে জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতার কারণটা কী? সবাই যে এর পক্ষে, তা তো নয়। যাঁরা এই জনগণনার বিরোধী বা কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই বিজেপি দল বলেছে, জাতিভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করলে জাতপাতের ভিত্তিতে রাজনীতি আরও বাড়বে। এতে সমাজে বিভাজন তৈরি হতে পারে, সংঘাত বাড়তে পারে। কেউ কেউ বলছেন, জাতপাতের ধারণা বিলোপের দিকে এগোনোর বদলে তা আরও জোরালো হবে। আবার অনেকে মনে করছেন, এই তথ্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, যার ফলে প্রকৃত সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, জাতপাতের অস্তিত্ব কেবল সমাজে নয়, নীতিনির্ধারণেও পরিষ্কার বোঝা যায়। যদি এই জাতিগত বিভাজন এখনও আমাদের সমাজে কাজ করে, তবে তা কেবল লুকিয়ে রেখেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। বরং স্বচ্ছতা ও তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক নীতি নেওয়া গেলে বিভাজন কমানো সম্ভব। ভারতের সংবিধান যে সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলে, তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করাটা খুব জরুরি। জাতিভিত্তিক জনগণনার মাধ্যমে জানা যাবে কে কতটা পিছিয়ে, কারা এখনও সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত, কারা শিক্ষায় বা চাকরিতে কম প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছে। এই তথ্য ছাড়া সংরক্ষণ নীতিও কার্যকর হতে পারে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনও রাজ্যে ওবিসি জনগোষ্ঠী ৫০ শতাংশ হয়, অথচ তারা সরকারি চাকরিতে মাত্র ২০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব রাখে, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই একটা বড় সামাজিক বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। এইখান থেকেই স্লোগান উঠেছে, যিসকি যিতনি ভাগেদারি, উসকি উতনি হিসসেদারি। আসলে এইসব তথ্য ছাড়া আমরা বুঝতেই পারব না নীতিগুলো কতটা কাজ করছে। ২০১১ সালের জাতিভিত্তিক জনগণনার তথ্য প্রকাশ না করার পরে একাধিক রাজ্য সরকার নিজেদের রাজ্যে আলাদা জনগণনার উদ্যোগ নিয়েছে। বিহার প্রথম এই পথে এগিয়ে গেছে। তখন তেজস্বী-নীতীশ কুমারের সরকার, সেই বিহার সরকার ২০২৩ সালে একটা সম্পূর্ণ জাতিভিত্তিক জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায় ওবিসি এবং ইডব্লিউএস (EWS)-এর সংখ্যা অনেক বেশি। এর ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তামিলনাড়ুও একই পথে হাঁটতে চাইছে। ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট যদিও এতদিন ধরে জাতিভিত্তিক জনগণনার পক্ষে ছিল না, কিন্তু তারাও বুঝেছে রাজ্যগুলোর এই পদক্ষেপ দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষের মধ্যে এই তথ্য জানার আগ্রহ এবং প্রয়োজন কতটা গভীর। কাজেই পাল্টি খেয়েছেন মোদিজি, ইউ টার্ন নিয়েই জানিয়ে দিয়েছেন জাতিভিত্তিক জনগণনা হবে। কিন্তু একটা বিতর্ক থেকেই গেছে, জাতিগত জনগণনা বনাম শ্রেণিভিত্তিক তথ্য, আর এই আলোচনায় এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে— আমরা কি শুধুমাত্র জাতিভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করব, নাকি আর্থিক শ্রেণিভিত্তিক তথ্যকেও গুরুত্ব দেব?
অনেকেই বলেন, এখন আর জাত নয়, আর্থিক সামর্থ্যই বেশি প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাস্তব বলছে— জাত এবং শ্রেণি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর মানুষরাই সবচেয়ে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত। ফলে একটি তথ্য অন্যটি ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। আমাদের দেশে কাস্ট আর ক্লাস একই সামাজিক অর্থনৈতিক মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কাজেই জাতিভিত্তিক জনগণনাই আগামী উন্নয়নের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে, যদি তা ঠিকভাবে, পদ্ধতি মেনে করা হয় এবং কেবল তথ্য আহরণই নয়, তারপর তার অ্যানালিসিস করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই কেবল তা সম্ভব। জাতিভিত্তিক জনগণনা কোনো জাদুমন্ত্র নয়, যা সমাজের সব সমস্যা মিটিয়ে দেবে। তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যাতে সমাজে কারা পিছিয়ে, কেন পিছিয়ে এবং কীভাবে সেই ব্যবধান কমানো যায়, তা বোঝা যায়। তথ্য গোপন না করে বরং স্বচ্ছভাবে তথ্য সামনে আনলে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব— এই তথ্যকে ভোটের কৌশল না বানিয়ে, ন্যায়বিচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। ভারত এক বহুমাতৃক, বৈচিত্রময় দেশ, ভাষা, ধর্ম, জাতি, শ্রেণি, সব দিক থেকেই বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আর তা সম্ভব তথ্যভিত্তিক নীতির মাধ্যমেই। তাই বলাই যায়, মোদিজির চমকবাজি নয়, বা কেবল জাতি নিয়ে খেলা করা কিছু রাজনীতিবিদদের বিভাজনের কাজ নয়, বরং একটি স্বচ্ছ, ইনক্লুসিভ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার দিকে এক দৃঢ় পদক্ষেপ।