২০১৪ সাল থেকেই আমরা দেখেছি, মোদিজি একজন ইভেন্ট ম্যানেজার। দেশ শাসন, নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, শিল্প বা কৃষির উন্নয়ন ইত্যাদি ওনার প্রায়োরিটি নয়। ইভেন্ট চাই, অনুষ্ঠান, জাঁকজমক, বাজনা, ছবি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, খবরের কাগজে ছবি, নিউজ চ্যানেলে চ্যানেলে ঢাকের বাজনা, উন্নয়ন আর বিকাশ, বিকাশ আর উন্নয়ন, যাকে দেখা যাবে না, ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু শোনা যাবে। এর আগে আমাদের দেশের কথা তো ছেড়েই দিন, অন্য কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে ঢোকার আগে ওরকম ইভেন্ট দেখেছেন? সটান শুয়ে পড়লেন, চোখে জল, আবেগ বিহ্বল মোদিজি গণতন্ত্রের পীঠস্থানকে সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করছেন, ভক্তরা বলিল আহা আহা। ক’দিন পরেই বোঝা গেলো, ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়ানো হচ্ছিল, বলি চড়ানো হবে বলে, গণতন্ত্রের ন্যূনতম রীতিনীতিও তিনি মানেন না।
নেক্সট বড় ইভেন্ট ডিমনিটাইজেশন, না অর্থমন্ত্রী জানেন, না অর্থ সচিব, তিনি মন কি বাতেঁ বলার জন্য সোজা টেলিভিশনে এলেন, বিগ ইভেন্টের ঘোষণা করলেন, দেশ শুদ্ধ মানুষ এটিএম লাইনে, টাকা পেলে হাঁড়িতে চাল ফুটবে, ভক্তরা কহিল আহা আহা। জিএসটি’র ঘোষণা, স্বাভাবিক ভাবে সংসদের অধিবেশন ডাকা যেতেই পারতো, দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশন, আরে ধ্যাৎ, তাহলে ইভেন্ট হবে কী করে? মাঝরাতে অধিবেশনে জিএসটি পাস হল, পরদিন থেকে খুচরো ব্যবসা লাটে উঠল, ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। এর আগে দেশে বহুবার বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতিও বহুবার এসেছেন, কিন্তু মোদিজির ব্যাপার আলাদা, ইভেন্ট চাই, বিগ ইভেন্ট। রাস্তার ধারে পাঁচিল তুলে ট্রাম্প সাহেবকে নিয়ে এসে স্টেডিয়ামে গলা জড়াজড়ি, দেখো সাদা চামড়ার সাহেবও আমাকে মান্যি করে, ভক্তরা কহিল আহা আহা। এদিকে করোনা ছড়াচ্ছে, আবার ইভেন্ট চাই, প্রথমে জনতা কারফিউ, বিকেলে ঘন্টা বাজানো, অমিতাভ বচ্চনও ঘন্টা বাজালেন, সফল ইভেন্ট ম্যানেজারের মুখে হাসি, ভক্তরা কহিল, গেল, গেল করোনা। কিন্তু ভবি ভোলার নয়, করোনা আরও ছড়াচ্ছে, আবার নতুন ইভেন্ট, দিয়া জ্বলাও, বাত্তি জ্বালাও, আলোর তেজে নাকি করোনা পটল তুলবে। হাসপাতালে বেড নেই, ভেন্টিলেটর নেই, অক্সিজেন নেই, মানুষ মরছে। আবার ইভেন্ট চাই, তিনি পিএম কেয়ার ফাণ্ডের ঘোষণা করলেন, ভাবখানা এরকম পিএম রিলিফ ফাণ্ড দিয়ে করোনা সামলানো যায় না, তাই আর একটা নতুন ফাণ্ড, এরপর ডাক্তারদের জন্য পুষ্পবৃষ্টি, ইভেন্টের পর ইভেন্ট, ইভেন্ট ম্যানেজার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি, তিনি বিলক্ষণ জানেন, নিজের ঢাক নিজেই পেটাতে হয়, এ ওনার গুরুদেবের শিক্ষা, সাভারকার। বিনায়ক দামোদর সাভারকার, এটাই ছিল তাঁর গুরুদেবের নাম। যাঁকে আরএসএস, বিজেপিই নয় অনেকেই বীর সাভারকার বলে ডাকে, ইতিহাস বইতেও ওই বীর সাভারকারই লেখা থাকে, তো এই বীর উপাধি কে দিলেন? ইতিহাস বলছে, সাভারকার নিজেই অন্য এক ছদ্মনামে বই লেখেন, সাভারকারের জীবনী লেখেন, মানে নিজের জীবনী নিজেই লেখেন, সেখানেই প্রথম সাভারকার কে বীর সাভারকার বলা হয়েছিল। মোদিজি ওনারই সফল শিষ্য মাত্র, ঢাক পেটানোটা ভালই রপ্ত করেছেন। মানে ইমেজ বিল্ডিং, দুষ্টু লোকেরা বলেন মোদিজির একটা টিম আছে, যাদের কাজ এই ইমেজ বিল্ডিং। সবচেয়ে খারাপ ঘটনাকেও কাজে লাগিয়ে মোদিজির ইমেজ তৈরি করা তাঁদের কাজ। ধরুন না পুলুওয়ামা, চূড়ান্ত পাহারাদারির মধ্যে আরডিএক্স চলে এল, অতজন জওয়ানের প্রাণ চলে গেলো, অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী হলে পদত্যাগের দাবি উঠত, মোদিজির বেলায় পুলুওয়ামা সাপে বর, আমি বলছি না, অর্ণব গোস্বামী বলছেন।
অতিমারি, লোকজন মারা যাচ্ছে, দেহ ভাসছে নদীর জলে, ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেটে মোদিজির ছবি, মনে করিয়ে দেওয়া, বাপু হে মোদিজি না থাকলে ভ্যাক্সিনেশন কি পেতে? মোদিজির কৃপায় বেঁচে গেলে, ইমেজ বিল্ডিং। আমেরিকা গেলেন, সাংবাদিকদের সামনে গণতন্ত্রের পাঠ পড়িয়ে দিলেন সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বললেন দেশে গণতন্ত্রকে রক্ষা করুন। ফিরলেন, আবার ইমেজ বিল্ডিং। বিরাট বিরাট পোস্টার হাতে ভক্তরা, টুইট করা হল নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতা, পৃথিবীর, হ্যাঁ দেশের নয়, পৃথিবীর সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আশা ভরসা নাকি মোদিজি, এমনটাই নাকি লেখা হয়েছে সাহেবদের পত্রিকায়, নিউ ইয়র্ক টাইমসে, ভেতরে নয়, প্রথম পাতায়। ভক্তগণ কহিল আহা আহা। দুষ্টু লোকেরা জানিয়ে দিল, সেদিনের নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় মোদিকে নিয়ে কোনও খবরই ছাপা হয়নি, সবটাই ইমেজ বিল্ডিং। এরও ক’দিন আগে আরও বড় নাটক হয়ে গেছে, মোদিজির জন্মদিন, রাজা রাজড়াদের দেখা যেত, যদিও একান্তই হিন্দু রীতি তবুও মোঘল সম্রাটদেরও দেখা গেছে, জন্মদিনে এলাহি উৎসব আয়োজনের মধ্যে, নিজেকে সোনা বা রুপো দিয়ে ওজন করাতে, সেদিন ঢাক বাজত, খাবার বিলানো হত, নাচ গান যাদুর ব্যবস্থা থাকত, তা হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রীই বা বাদ যায় কেন? মোদিজির জন্মদিন বলে কথা, এইখানে বলে রাখি, তথ্য বলছে মোদিজির কিন্তু একটা জন্মদিন নয়, সেখানেও ভারি বিভ্রান্তি আছে, তবুও আপাতত, ১৭ সেপ্টেম্বরকেই ওনার ভক্তরা জন্মদিন বলেই মেনে নিয়েছে, জন্মদিন জানা যাবে কী করে? স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট নিয়েই তো বিস্তর গণ্ডগোল, সে যাই হোক আপাতত ১৭ সেপ্টেম্বর, সেই পূণ্যতিথি। অতএব ঢাকঢোল পেটাতে হবে। ঠিক হল তেনার জন্মদিনে ৩ কোটি পোস্ট কার্ড বিতরণ হবে, পোস্টমাস্টারদের কাছে সে খবর দেওয়াও হল, এদিকে কেমন করে যানা নেই এই বঙ্গের তিনজন পোস্ট মাস্টারমশাই সেই ফতোয়া অনশুনা, অনদেখি করেছেন, মানেননি। ব্যস, সাসপেন্ড, আপাতত চাকরি নট।
রাজার জন্মদিন বলে কথা। এতেই কি ক্ষান্ত? না আরও আছে। রাজার থুড়ি মোদিজির জন্মদিনে দেশের প্রশাসনের উপহার, আড়াই কোটি ভ্যাক্সিনেশন, ভাবুন একবার? আড়াই কোটি একদিনে। এরকম পারফরম্যান্স হলে, ৫৪ দিনেই ১৩৫ কোটি দেশবাসী ভ্যাক্সিন পেয়ে যেতেন, বিশাল ইভেন্ট। তো আমরা একটু খোঁজ খবরে নেমেছিলাম, আমরা মানে দুষ্টু সাংবাদিকরা, যা পেলাম, তা আপনাদের জানানো যাক। গোদি মিডিয়াগুলোতে, যখন আড়াই কোটি ভ্যাক্সিন নিয়ে তুমুল জয়জয়কার হচ্ছে তখন জানা গেলো, আশুতোষ শর্মা, মধ্যপ্রদেশের আগরমলওয়া জেলা, ভূপাল থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তিনি মেসেজ পেলেন যে, তাঁর মা, বিদ্যা শর্মাকে কোভিড ১৯ এর সেকেন্ড ডোজ ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, এখন সমস্যা হল, ওনার মা বিদ্যা শর্মা, মাত্র ৪ মাস আগে এই কোভিডেই আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, তাঁর হাতে এখন দুটো সার্টিফিকেট, একটা তাঁর মায়ের ৪ মাস পুরনো ডেথ সার্টিফিকেট, অন্যটা তাঁর সেই মায়ের ১৭ সেপ্টেম্বরের ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেট। ওই জেলারই পিঙ্কি বর্মা, জুন ৮ তারিখে প্রথম ডোজ পেয়েছিলেন, সেই হিসেবে তাঁর পরের ভ্যাক্সিন নেবার ডেট ছিল ৭ সেপ্টেম্বর, কিন্তু তিনি শরীর খারাপ থাকায় সেই ভ্যাক্সিন নিতে পারেননি, তাতে কি? তাঁকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে, ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর দ্বিতীয় ভাক্সিন সফলভাবে দেওয়া হয়েছে, তাঁর এখন প্রশ্ন, এবার তিনি দ্বিতীয় ডোজ পাবেন তো? ভূপালের মীরা সুতাও এরও একই কেস, উনি ৫ মার্চ ভ্যাক্সিন নিয়েছিলেন, তারপর শরীর খারাপ হওয়ায় পরেরটা নিতে পারেননি, তিনিও নেক্সট মেসেজ পেয়ে গেছেন যে, তাঁকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে, ওই ১৭ সেপ্টেম্বরেই। এসব প্রশ্ন ওঠার পরে সরকার জানাচ্ছে, এসব ক্লারিকাল মিসটেক, প্রশ্ন হল সবকটা মিসটেক ১৭ সেপ্টেবরেই কেন? এর পেছনে রহস্যটা কী? কতজন এমন আছেন? সেটাও জানানো হচ্ছে না।
এবার আসুন বিহারে, সেখানে আবার অন্য কায়দা, ১৫ বা ১৬ সেপ্টেম্বরে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সার্টিফিকেট ১৭ সেপ্টেম্বর, এরকম একটা আধটা নয়, শয়ে শয়ে ঘটনা সামনে এসেছে। মজা হল, ১৭ সেপ্টেম্বর আমাদের দেশে আড়াই কোটি মানুষকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হল, বেশ। ১৮ সেপ্টেম্বর কতজন পেলেন? দেখা যাচ্ছে কমবেশি ৪০ লক্ষ মানুষের ভ্যাক্সিনেশন হয়েছে, ১৯ সেপ্টেম্বর? আবার প্রায় সেই একই সংখ্যা, ৪০ লক্ষ। তাহলে ১৭ তারিখ রাজার জন্মদিনে বিগ ইভেন্ট তৈরি করা হল? কে করল? কেন করল? করে কী লাভ? লাভ একটাই, ইমেজ বিল্ডিং। মোদিজির জন্মদিনে আড়াই কোটি ভ্যাক্সিনেশনের গল্প, আসলে ঢাক পেটানো। এই সরকার প্রথম দিন থেকেই ঢাক পেটানোর সরকার, প্রতিটা বিষয়ে কাজের বদলে প্রচার, কেবল প্রচার চালিয়ে এক লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তৈরি করতে চায়, সেই বিরাট হীরক রাজার মূর্তি। সময় এসেছে সেই মূর্তি ভাঙার, একসঙ্গে বলুন, দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।