আগের দিন কেবল বিবেকানন্দ নিয়েই আলোচনাটা সীমাবদ্ধ ছিল, আজ পুরো আলোচনাটা করা যাক। আগের দিনই বলেছিলাম যে লেক্স ফিডারম্যান বলে আদতে রাশিয়ান আপাতত আমেরিকান আলেক্সেই আলেকজান্দ্রানভিচ ফ্রিডম্যানের সঙ্গে পডকাস্টে বসে মোদিজি অনেক কথা বলেছেন, প্রচুর কথা, কারণ ওই লেক্স ফ্রিডম্যান তো ভারতীয় স্বাধীন সাংবাদিক নয়, এবং সম্ভবত তিনি কোনও তেমন প্রশ্ন করতেও চাননি। প্রায় পুরোটাই মনোলগের মতো মোদিজিই বলে গেছেন, এবং যা হয়, বেশি বলার একটা খারাপ দিক হল প্রচুর বলা মানেই ভুলভাল বলা, তো তিনিও বলেছেন। আমরা ওনার পুরো বক্তৃতা থেকে ওনার নিজের গলাতেই, নিজের বক্তব্যেই যে মিথ্যে, যে স্ববিরোধিতাগুলো বেরিয়ে এসেছে সেগুলো নিয়েই কথা বলব।
সেই ডাহা এবং ভূরি ভূরি মিথ্যের, স্ববিরোধিতার কিছু কথা আজ তুলে ধরব। এক নম্বর – মোদি সেই পডকাস্টের একটা জায়গাতে জোর গলায় বলছেন যা তিনি প্রায়শই বলেই থাকেন, “আমার শক্তি আমার একার নয়, আমার পেছনে ১৪০ কোটি ভারতীয়ের সমর্থন আছে।” মানে যা বোঝাতে চান তা হল তাঁর প্রতিটা কাজ, সিদ্ধান্ত আসলে মানুষের সিদ্ধান্ত। মানুষের সমর্থনেই তিনি সেইসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাই যদি হয় তাহলে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নিল কে? সেই সিদ্ধান্তের আগে কোনখানে, কোন পদ্ধতিতে মোদিজি, আপনি দেশের মানুষের সমর্থন চেয়েছিলেন? নির্বাচনের সময়ে বলেছিলেন যে আমি ক্ষমতায় এলেই নোটবন্দি করব? তারপর ধরুন কৃষি বিল, সেই আইন পাশ করিয়ে তো নিলেন, মানুষের সমর্থন ছিল তার পেছনে? যদি ছিলই তাহলে ফেরত নিলেন কেন? এই চূড়ান্ত অবিমৃষ্যকারিতার জন্য ৭৫০ জন মানুষ মারা গেছেন, এটাই আপনার শক্তি? আপনার পেছনে ১৪০ তো ছেড়েই দিন ৫০ কোটির সমর্থনও কি আছে? ওই ১৪০ কোটির সমর্থনের কথাটা ডাহা মিথ্যে। তাঁর নিজের চূড়ান্ত ক্ষমতা আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁকে উন্মাদ করে তুলেছে। তিনি বলছেন তার শক্তি ১৪০ কোটি ভারতীয়ের কাছ থেকে আসে আর তিনি একজন ‘বিনম্র সেবক’, কিন্তু সেই বিনম্র সেবক এ তাবৎ সবচেয়ে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি বলেও গর্বিত, তিনি ছাড়া কেউ জানত না নোটবন্দির কথা, এটা তিনি সেই সময়ে বার বার বলেছেন, আর এখন তো সেই নোটবন্দির কথা ভুলেও মুখে আনেন না।
দ্বিতীয় ডাহা মিথ্যে, স্ববিরোধিতা, যেটা তিনি প্রায় রোজ জোর দিয়ে বলেন, “গণতন্ত্রের আত্মা হল সমালোচনা, আমি এটাকে স্বাগত জানাই।” বাপ রে, হিটলার, স্তালিন কবরে পাশ ফিরে শোবে, মুচকি হাসবে। গণতন্ত্রের আত্মা? যিনি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে দল ভাঙার সবচেয়ে বড় কারিগর, তিনি বলছেন গণতন্ত্রের কথা? মহারাষ্ট্র ২০১৯-এ শিন্ডেকে ভাঙিয়ে এনে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার তৈরি করা। মধ্যপ্রদেশ ২০১৮ সালে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস জিতে কমলনাথের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। কিন্তু ২০২০ সালে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেসের ২২ জন বিধায়ক দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। এর ফলে কংগ্রেস সরকার পড়ে যায়, আর বিজেপি শিবরাজ সিং চৌহানের নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরে আসে। কর্নাটক (২০১৯): ২০১৮ সালে কর্নাটকে জেডি(এস) ও কংগ্রেস মিলে জোট সরকার গঠন করে, এইচডি কুমারস্বামী মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু ২০১৯ সালে এই জোটের ১৭ জন বিধায়ক (কংগ্রেস ও জেডিএস থেকে) বিদ্রোহ করে বিজেপিতে যোগ দেন। এর ফলে সরকার ভেঙে পড়ে, আর বিজেপি বিএস ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। মহারাষ্ট্র: ২০২৩ সালে এনসিপি-তে বড় ধরনের ভাঙন ধরিয়ে শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার তার গোষ্ঠী নিয়ে বিজেপি ও শিন্ডে গোষ্ঠীর শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁধেন। অজিত পাওয়ার উপ-মুখ্যমন্ত্রী হন। এই ভাঙনের ফলে বিজেপি মহারাষ্ট্রে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গোয়া ২০১৭ সালে গোয়ায় বিজেপি সরকার গঠন করে জোটের সাহায্যে। ২০১৯ সালে কংগ্রেসের ১৫ জনের মধ্যে ১০ জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপির সরকার আরও নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে। অরুণাচল প্রদেশ: ২০১৪ সালে অরুণাচলে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। কিন্তু ২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের বেশিরভাগ বিধায়ক প্রথমে পিপলস পার্টি অফ অরুণাচলে (পিপিএ) যোগ দেন, তারপর বিজেপিতে চলে যান। এর ফলে বিজেপি ক্ষমতায় আসে, আর কংগ্রেস সরকার উৎখাত হয়। এই হল মোদিজির গণতন্ত্র।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিচারপতি তোমার বিচার হবে কবে?
কিন্তু ওই পডকাস্টেই তিনি বলে ফেলেছেন, “আজকাল যেটা দেখি, সেটা আসল গণতন্ত্র নয়, কারণ এই বিরোধীদের গণতন্ত্রে তারা সমালোচনা না করে দুর্বলতা ধরার বদলে সোজা অভিযোগে করতে শুরু করে, গালাগালি করে।” মানে খুব পরিষ্কার, তিনি শুধু সেই সমালোচনা পছন্দ করেন বা করবেন যেটাকে তিনি নিজে ঠিক বলে মনে করেন, বাকিগুলোকে হল সবটাই গালিগালাজ। তো সামনে পেলে জানতে চাইতাম, একটা ঠিকঠাক সমালোচনার উদাহরণ দিন না, আমরাও বুঝতে পারি। তিন নম্বর ডাহা মিথ্যে এবং স্ববিরোধিতা। মোদি ভারতকে শান্তির দেশ বলেন, “ভারতীয়রা ঝগড়া-বিবাদের জন্য তৈরি না, আমরা সম্প্রীতি আর শান্তির পক্ষে।” কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এটাও বলেন যে ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, ঘরে গিয়ে মারার কথা বলার দরকারটা কোথায়? যাঁরা আমাদের দেশে যুদ্ধটা সত্যিই করেছিলেন তাঁরা কিন্তু হুমকি দেননি, দেশ আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করেছিলেন, জওহরলাল নেহরু বা ইন্দিরা গান্ধী, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে গোছের মাস্তানি ভাষার প্রয়োগ তো করেননি। কিন্তু সেই তিনিই পডকাস্টে বসে বুদ্ধদেবের ভাষায় কথা বলছেন। মোদিজির চার নম্বর স্ববিরোধিতার ধারণা আজ নয়, এ তাঁর আরএসএস সূত্রেই, উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। মাঝেমধ্যেই খেয়াল করবেন তিনি বলেন, “দেশই সব, জনগণের সেবা করা মানে ঈশ্বরের সেবা… এটা আরএসএস-এর কথা,”আর সেটা বলতে গিয়েই তিনি বলেন “আমি ভারতকে প্রথমে রাখি।” আবার তিনি বিদেশ ভ্রমণে যাবেন, সেখানে আর এক রূপ, বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে তিনি বলেন, “এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ,” পৃথিবীকে “একটা বড় পরিবার” বলছেন। এটা বলে দেয় তাঁর জীবন দর্শন দেশের সীমানার মধ্যে আর বাইরে আলাদা আলাদা, খানিক রবি ঠাকুর বা গান্ধী পড়লে বুঝতে পারতেন। রবি ঠাকুর লিখছেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, সেই গানেই লিখছেন ওমা তোর চরণেতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা, হ্যাঁ এটাই সর্বজনীনতা, এটাই বসুধৈব কুম্ববকম, সাদা চামড়া দেখলেই বিশ্বপ্রেম জেগে ওঠার মতো ফাঁপা বিষয় নয়। সামনের লোকটাকে দেখে তাঁর ফোকাস শিফট করে, কখনও দেশে, কখনও পৃথিবীতে। মিথ্যে আর স্ববিরোধিতায় ভরা এই মোদিজির পঞ্চম স্ববিরোধিতা হল শিক্ষা নিয়ে। মোদি বলেন, “মানুষের ভেতরের ছাত্রটাকে কখনও মরতে দেওয়া উচিত না, শেখা বন্ধ করা উচিত না।” কিন্তু তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমার সরকারে কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না… প্রথমবারই নির্বাচনে লড়তে হয়েছে।”
এটা বোঝায় তিনি বড় দায়িত্ব নেওয়ার পর শিখেছেন, যেটা তার ‘সবসময় শেখার’ কথার সঙ্গে মিল খায় না। বা উনি সম্ভবত এটাই বলতে চান, সাধারণ বায়োলজিক্যালি জন্ম নেওয়া মানুষেরা প্রতিদিন শিখবে, আর তাঁর মতো স্বয়ম্ভুরা দরকার পড়লেই ঝুপ করে শিখে নেবে। একটু আলাদা। আর সেই পথচলতি শিক্ষার বলে বলীয়ান তিনি বলেন, কোভিডের সময় তিনি সব বিশ্বের তত্ত্ব মানেননি, ‘মৌলিক জিনিসের’ ওপর ভরসা করেছেন। কোন মৌলিক জিনিস? দিয়া জ্বালাও? থালা বাজাও? এবংতার আগেই বলেছেন, নোবেল জয়ী আর অর্থনীতিবিদরা তাঁকে বিশ্বের পরামর্শ আর উদাহরণ দিয়ে বিরক্ত করতেন, যা তাঁর কাছে বোঝা বা আবর্জনা বলে মনে হত। আসলে তিনি নিজেকে এক সম্পূর্ণ জ্ঞানী, প্রগাঢ় পণ্ডিত হিসেবেই মনে করেন, এ বিশ্বাস তাঁর বড্ড গভীর, একে সাইকোলজিস্টরা বলেন এক্সট্রিম সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, যা মানুষকে অহং বোধ যা মানুষকে তার স্বরচিত বৃত্তের মধ্যেই আটকে রাখে, এ এক ধরনের কঠিন মানসিক ব্যাধি। আরও আছে, দেখবেন মোদি প্রায়ই বলেন, “আমি রাজনীতিতে ক্ষমতার খেলার জন্য আসিনি, সেবার জন্য এসেছি… ক্ষমতার থেকে উৎপাদনশীলতার দিকে বেশি মন দিই।” কিন্তু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, অনেক নির্বাচনে জেতা, আর বড় পদে থাকাটাই দেখিয়ে দেয় অনেক কিছু, প্রতিদিন তিন চারবার জামাকাপড় বদলানো, ব্র্যান্ডেড চশমা, পেন ঘড়ি জুতো ব্যবহার করা, ঘরে বসে ময়ূর খাওয়ানো থেকে নিজের সুরক্ষা আর বিশাল প্লেনের ব্যবস্থা, এসব কথা শুধু সেবার কথার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। মিথ্যের পাহাড়ে বসলে যা সকলের হয়, তাই ওনারও হয়েছে, আগের কথার সঙ্গে পরের কথাটা মেলে না। মোদিজি এই পডকাস্টেও তাঁর শিক্ষা আর শেখার কথা অনেক জায়গায় বলেছেন। তবে তার কথায় ভরপুর স্ববিরোধিতা অপমানজনকভাবেই হাস্যকর।
প্রাথমিক শিক্ষা: মোদি এই আলোচনাতে বলেছেন তিনি ভাডনগরে জন্মেছেন আর সেখানে প্রাথমিক পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে থাকতে তিনি গ্রামের ইতিহাস নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। এটা সাধারণ স্কুল শিক্ষার কথা।
স্কুলের বাইরে শেখা: তারপরে তিনি সেই চায়ওলার গল্পে ফিরে গেছেন, বাবার চায়ের দোকানে বসে বিভিন্ন মানুষের কথা শুনে তিনি নাকি অনেক কিছু শিখেছেন। তাদের কথা আর ভাবভঙ্গি দেখে শিক্ষা পেয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়াও তাঁর শিক্ষার বড় অংশ। তাহলে স্কুলে গেলেন কখন? তিনি চায়ের দোকানে শেখার কথা বলেন, আর শেখার চেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন অভিজ্ঞতার উপরে। ওদিকে তিনিই আবার সরকারে কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই এক লাফে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আসলে শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা নিতান্তই গোলমেলে। পুরোটা শুনলে হাসিই পাবে। এই আলোচনাতেই উঠে এসেছে তার সেই সব সাংস্কৃতিক ধারণা যেগুলো সাধারণভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক। যেমন ধরুন:
হিন্দু জাতীয়তাবাদ: তিনি আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত, যারা হিন্দু জাতীয়তার কথা বলে। তিনি দেশ, সমাজ, সংস্কৃতিকে রামের গল্প আর হিন্দু ঐতিহ্যের বৃত্তের মধ্যেই রাখেন। এটা অন্য ধর্ম বা সংস্কৃতির মানুষকে আলাদা করে দেবে, যেটা গণতন্ত্রের বিপরীত ধারণা, কিন্তু সে প্রশ্ন তো তাঁকে এখানে কেউ করেনি।
বাছাই করা সমালোচনা: তিনি সমালোচনাকে স্বাগত জানান, কিন্তু শুধু ‘আসল’ আর ‘ভালো’ সমালোচনা চান। এটা বোঝায় তিনি সেটাকেই সঠিক সমালোচনা বলে মনে করেন যেটা তাঁর কাছে ঠিক বলে মনে হয়, মানে প্রশ্ন হলে ওই আম চেটে খাবে? চুষে খাবে? না কেটে খাবের মধ্যে থাকলেই তিনি খুশি।
গোটা পডকাস্ট জুড়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে আর স্ববিরোধিতার এক নিজের রচিত জালে আটকা পড়ে গেছেন। প্রতিটা কথায় ধরা পড়ে যাচ্ছে তাঁর শিক্ষার দৈনতা, তাঁর বোধবুদ্ধির অভাব আর এক মধ্যযুগের চিন্তাভাবনা। এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে তিনি যা বলেছেন তা নিয়ে কাটাছেঁড়া তো চলবেই, কিন্তু ভারতের এক প্রধানমন্ত্রীর এই নিম্ন মেধার উদাহরণ নেট দুনিয়াতে থেকেই যাবে, এ এক লজ্জা।