সেই পড়েছিলাম, একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়, সেই কবে আড়াই হাজার বছর আগে রাঢ় বাংলার এক রাজপুত্র বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কা দখল করেন, সেদেশের কিছু লেখাতেও পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আমাদের রাঢ় বঙ্গের ইতিহাসেও তার সমর্থন মেলে, তবে ওই হেলায় লঙ্কা করিল জয়টা অতটা হেলাফেলা করেই এসেছিল কি না তা জানা নেই। কিন্তু তারপর থেকে যদি আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকান তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশে এমনকী রাজা রাজড়ারাও হাল্লার রাজা ছিলেন না, পররাজ্য দখল করার দিকে তাদের মন ছিল বটে, কিন্তু তা এই উপমহাদেশের সীমানার মধ্যেই। মানে দাক্ষিণাত্য থেকে চোল রাজারা এসেছেন উত্তর দখল করতে, উত্তর থেকে মৌর্যরা গেছেন দাক্ষিণাত্য জয় করতে, মারাঠারা জয় করেছিল দিল্লি, এইরকম আর কী। এসব বাদ দিলে চেঙ্গিজ, তৈমুর বা গ্রিসের আলেকজান্ডার বা আরও অনেক ইউরোপীয় রাজা রাজড়াদের সম্রাটদের মতো ভারতবর্ষের রাজা মহারাজা বা সম্রাটেরা এই উপমহাদেশের বাইরে রাজ্য দখলের জন্য যাননি। বরং আমাদের ইতিহাস ছিল সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের, সে ইতিহাস বিরাট। দলে দলে পরিব্রাজক আমাদের দেশে এসেছেন হিউয়েন সাং থেকে ইবন বতুতা থেকে ট্রাভেরনিয়ের থেকে আল বেরুনি, আর আমাদের দেশ থেকেও পণ্ডিত জ্ঞানীরা কোথায় কোথায় গেছেন তার ঠিক নেই। সেই জমানায় দুর্গম তিব্বতে চলে গেলন অতীশ দীপঙ্কর। বুদ্ধের শিষ্য কাশ্যপ মাতঙ্গ আর ধর্মরত্ন চলে গেলেন চীন দেশে ধর্ম প্রচারের জন্য। আমাদের দেশ থেকে প্রায় মুছে গেল বৌদ্ধ ধর্ম কিন্তু থেকে গেল চীনে, জাপানে।
সেই কবে থেকে পঞ্চশীল নীতির কথা বলে আসছে ভারতবর্ষ। নেহরু এই পঞ্চশীল নীতির কথাই বলেছিলেন, এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষের বিদেশ নীতি তার উপর দাঁড়িয়েছিল। তাতে যে পাঁচটা কথা বলা হয়েছিল তা হল, ১) পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে সেই রাষ্ট্রের সংপ্রভুতাকে স্বীকার করা। ২) একে অন্যকে আক্রমণ না করা। ৩) একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। ৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এটাই ছিল আমাদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সম্পর্কের ভিত্তি, বিশেষ করে আমাদের পড়শি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিই ছিল এই পঞ্চশীল তত্ত্ব। তা কি লঙ্ঘিত হয়নি? হয়েছে। বহুবার হয়েছে। পাকিস্তান বার বার আক্রমণ করেছে, চোরাগোপ্তা হানাদারি চালিয়েছে, কাজেই যুদ্ধও হয়েছে। চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, তা মিটেওছে। কিন্তু বাকি দেশেগুলোর সঙ্গে মোটামুটি সুসম্পর্ক ছিল আর বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পরে তো তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল আত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মুজিব দিল্লি আসেন, সেখান থেকে ঢাকা। পাকিস্তান আর চীন বাদ দিলে আমাদের সমস্ত পড়শিদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। সার্ক দেশভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক আদান প্রদান ছিল তা নয়, সিনেমা, গান, চিকিৎসা, বিভিন্ন আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদও ছিল। কিন্তু এরমধ্যে আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক মহামানবের আবির্ভাব হল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এক আজীবন অবিবাহিত মানুষ জনসংখ্যা বাড়ানোর জ্ঞান দিচ্ছেন
২০১৪ থেকে এই ১০ বছরে দেশের খোলনলচে বদলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ছেড়েছেন আমাদের দেশের এই নেতা নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি। খেয়াল করে দেখুন প্রতিটা পড়শি দেশের সঙ্গে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সম্পর্ক খুব খারাপ। যদি কোনও ছাত্র বলে আমার সঙ্গে সব্বাই খারাপ ব্যবহার করে, আমাকে সবাই হিংসে করে তাই আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না, তাহলে বুঝবেন আসলে ছেলেটির একটা বড় সমস্যা আছে। হ্যাঁ, আমাদের বিদেশনীতিতেও সেরকম একটা সমস্যা আছে। আসলে রাষ্ট্রনীতি আর পররাষ্ট্রনীতি, সে আপনি যাই বলুন না কেন সবটাই আপাতত মোদিসখাদের উপর নির্ভরশীল, স্বার্থ দেশের নয়, স্বার্থ পড়শিদেরও নয়, একমাত্র বিবেচ্য হল আদানি আম্বানিদের স্বার্থ। ভুটান, একটা দেশ যাকে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ভারতবর্ষের অংশই মনে করত, সেই ভুটান ছিল চীন আর ভারতের মধ্যে একটা বাফার এরিয়া। সেই ভুটান এখন ভারত বিরোধী। আগে ভারতীয়রা অবাধে ভুটানে বেড়াতে যেতে পারত, এখনও পাসপোর্ট লাগে না কিন্তু বেড়াতে গেলে মাথাপিছু যে টাকা দিতে হয় তা চমকে দেবার মতো। আগে ট্রেনে করে ফুন্টশিলিং চলে যাও, তারপর ঢুকে যাও ভুটানে, এখন আগে এন্ট্রি পারমিট নিতে হবে আর তার জন্য ১২০০ টাকা প্রতি রাতের জন্য দিতে হবে। মানে ৭ দিন ভুটানে বেড়াতে গেলে ৮৪০০ টাকা কেবল ভুটান সরকারকে দিতে হবে, যা আগে কেবল বিদেশিদের দিতে হত, ভারতীয়রা ভুটানে বিদেশি ছিল না। এখন সেখানে যে কোনও আর্মি মুভমেন্ট-এর আগে ছাড়পত্র নিতে হয়, কাজেই ওই ভুটানে ডেরা বাঁধা উগ্রপন্থীদের অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির অনায়াসেই চলছে। আর তার উপরেই চীন রাস্তা তৈরি করছে যা আগে হত না। নেপালের লিপুলেখ অঞ্চলের ম্যাপ নিয়ে জটিলতা কাটেনি, নেপাল সেই অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করেছে। গোটা নেপাল জুড়ে আগে ১০০ টাকার ভারতীয় নোট অনায়াসে চলত, এখন তার দাম কমেছে আর নেপাল জুড়ে ভারত বিরোধিতা চোখে পড়ার মতো। ওদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই মনে করে ভারত অযথাই তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়, গলাচ্ছে, গলানোর চেষ্টা করছে। মালদ্বীপ তো এখন প্রায় শত্রু রাষ্ট্র, সেখানেও তীব্র ভারত বিরোধিতাকে সম্বল করে জিতে এসেছেন বর্তমান শাসকদল এবং নেতা মহম্মদ মুইজ্জু।
শ্রীলঙ্কাতে জনতা ভিমুক্তি পেরুমুনা মার্কসবাদে বিশ্বাসী, তারা দেশের পুরনো গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক চেহারাকে ফেরাতে চায় এবং তাদের এক তীব্র ভারত বিরোধিতা আছে, বরং চীনের সঙ্গে তারা আরও ঘনিষ্ঠ হতে চায়। আফগানিস্তানের তালিবানদের সঙ্গে নয়, সেই সরকারের বাণিজ্য নীতি অনুযায়ী সেদেশে বাণিজ্য করছে ভারত, বলা ভালো আদানি বা আম্বানি। কিন্তু তালিবানদের বিরুদ্ধে একটা কথা না বলে, সেখানে মানবাধিকার বা নারীদের অধিকার নিয়ে কোনও কথা না বলার শর্তেই বাণিজ্য করছে ভারত। রইল বাকি বাংলাদেশ, চোখের সামনেই রয়েছে সেই সম্পর্কের কঙ্কালসার চেহারা। সে দেশে নাকি র-এর বহু লোকজন অ্যাকটিভ ছিল, মজার কথা হচ্ছে তারা বুঝতেও পারেনি যে তাদের পেয়ারের বেগম হাসিনাকে উৎখাত করার পরিকল্পনা নিয়েই ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে, না তাঁরা জানতেনও না, হাসিনা দেশ ছাড়ার পরে তাঁরাও দেশ ছেড়েছেন। আমাদের দেশে যার নামে ওয়ারেন্ট জারি আছে সেই জইশ ই মহম্মদের মাথা মাসুদ আজহারকে কেন পাকিস্তান আশ্রয় দিয়েছে, এই কথা বলার সময় আমাদের মাথায় এখন তো থাকবে শেখ হাসিনার কথা। তিনিও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী অপরাধী, তাঁকে এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, আর তা নিয়ে কোনও ব্যাখ্যাই নেই, তিনি এ দেশে বসেই তাঁর দলের সভায় ভার্চুয়াল বৈঠকে হাজিরা দিচ্ছেন। কাজেই ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক খুব তাড়াতাড়ি ভালো হওয়ার তো কোনও কারণ দেখছি না। ওদিকে আদানি সে প্রিমিয়াম দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করার চুক্তি করেছিল শেখ হাসিনার সময়ে, যা মানতে বাধ্য নয় এখনকার সরকার, এদিকে আদানির পিছনে আছেন মোদিজি, কাজেই বাণিজ্যিক দিক থেকেও আদানির বিদ্যুৎ আর আম্বানির গ্যাস বাংলাদেশের মানুষ আর সরকার মেনে নেবে না, সেখানেও সমস্যা। বাকি রইল চীন, তারা তো আমাদের দেশের ইলেকট্রনিক্স আর খেলনা বাজারের সিংভাগ দখলে নিয়েছে, আমাদের উত্তর সীমানা বরাবর বিরাট রাস্তা তৈরি করেছে, করছে, তারা জানে এ সরকারের ওই ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে বা ছপ্পন ইঞ্চ কা সিনা ইত্যাদি বাওয়াল কেবল ওই পাকিস্তানের জন্যই রাখা আছে।
মানে যে পঞ্চশীল নীতি নিয়ে ভারতবর্ষ একদিন তাদের পড়শিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছিল, কিছুটা সফলতা পেয়েছিল সেই পঞ্চশীলের নীতিতে বিশ্বাসই করে না এই আরএসএস-বিজেপি। এক হিন্দু জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে নিয়ে এক আগ্রাসী ভারত গড়ে তুলতে চায় তারা, কাজেই মোদিজি ইউক্রেন কা ওয়ার রুকয়া দিয়া পাপা এখন খোরাক, হাসির আর তাচ্ছিল্যের বিষয়, মোদিজি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁর সখা আদানি আম্বানির কথা ভেবেই, কিন্তু তাকে পুনর্বহাল করা তাঁর সাধ্যের বাইরে। কাজেই আরএসএস-বিজেপির তীব্র হিন্দু জঙ্গি জাতীয়তাবাদের এক কাউন্টার কাউন্টার ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, যার তাপ উত্তাপ সইতে হচ্ছে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধদের। এদেশে মোদি-শাহ, আরএসএস-বিজেপির এই হিন্দুত্বকে মোকাবিলা না করে, আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষজনদের সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার, সম অধিকারের গ্যারান্টি না থাকলে পড়শি দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার কথা বলা যাবে না। কারণ আমাদের দেশের হিন্দু মৌলবাদীদের মতো সে দেশেও মুসলিম মৌলবাদীরা সেন্টার স্টেজ দখল নিচ্ছে। দু’ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষকে দু’ দেশের এই চূড়ান্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, দু’ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আবার বাঁচিয়ে তোলার সেটাই একমাত্র উপায়।
The post Fourth Pillar | দেশের চারপাশে শত্রু তৈরি করতে এক নরেন্দ্র মোদিজি যথেষ্ট first appeared on KolkataTV.
The post Fourth Pillar | দেশের চারপাশে শত্রু তৈরি করতে এক নরেন্দ্র মোদিজি যথেষ্ট appeared first on KolkataTV.