মাত্র ক’দিন আগে দেখছিলাম, হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রীতে গবু মন্ত্রী বিকাশের ডেফিনেশন দিচ্ছিল, মানে বিকাশ কাকে বলে সেটা বোঝাচ্ছিল, বড়বড় রাস্তা, হুশ করে ছুটবে রথ
বড় বড় দোকান, মধ্যে চওড়া রাজপথ
দেশ বিদেশে যা পাওয়া যায়,
সব কিছু, পাওয়া যাবে হেতায়।
চক মেলানো বাড়ি, সাত ঘোড়ায় টানা গাড়ি
মসলিন শাড়ি, খাবার দাবার রকমারি
রাজ কোষাগার, ভর্তি থাকবে বারো মাস
একেই, সংক্ষেপে বলে বি কা আ আ শ।
কাল সেই গবু মন্ত্রীকে দেখলাম সুলতানপুরে, পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতে বায়ুসেনার বিমান থেকে নামতে, সে এক ব্যাপার, তিনি নামবেন বলে মেক শিফট রানওয়ে তৈরি হল, এতদিন ছোট এলাকায় যাবার জন্য হেলিকপ্টার চড়তেন, ফকির তো, তাই এবার বিমানে চেপে আসার সাধ হল, কম বেশি ৮ কোটি টাকা খরচ হল কেবল মেক শিফট রানওয়ে তৈরি করে, তেনার বিমান নামাতে। তারপর তিনি মঞ্চে উঠলেন, ভাষণ দিলেন, ৪৭ থেকে কোনও বিকাশই যে হয়নি, দেশের প্রতিরক্ষার, সেনাবাহিনী, নৌসেনা, বায়ুসেনাদের আগে যে কিছুই ছিলনা, তা মানুষকে বললেন, বোঝালেন, দেশের প্রতিরক্ষা আর বিকাশ তো হচ্ছে এই সাত বছর, কঙ্গণা রানাওয়ত যখন থেকে স্বাধীনতা পেয়েছেন, তখন থেকে।
ক্লাস থ্রিতে মগরমচ্ছ ধরা আমাদের গুলবাজ প্রধানমন্ত্রীকে কে বোঝাবে, যে এর আগে তিন তিনটে যুদ্ধে আমাদের দেশ পাকিস্থানকে পরাজিত করেছিল, নির্লজ্জ আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল, সে সব ইতিহাস জালি এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্সের ডিগ্রি নেওয়া মোদিজীর জানা নেই, জানা নেই দেশের ইস্পাত, বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা, ভাখরা নাঙ্গলের কথা, ভিলাই, রউরকেল্লা, বোকারোর কথা, জানা নেই বিশ্বের দীর্ঘতম রেলওয়েজের কথা, জানা নেই রাষ্ট্রায়ত্ব কয়লা শিল্প বা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার কথা, অসংখ্য বিমান বন্দর, জাহাজ বন্দরের যা তিনি এখন বেচে দিচ্ছেন আদানি, আম্বানিদের কাছে।
যাই হোক সামনে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন, দেশের চওকিদার প্রত্যাশা মতোই মিথ্যের ঝোলা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে হাজির হয়েছেন, দেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় যে প্রকল্প তৈরি হল তার উদ্বোধনে গিয়ে, দেশের যাবতীয় ইতিহাসকে অস্বীকার করার পুরনো খেলা কালও দেখলাম, কেবল তার সামনে বোম্বাগড়ের সেই বৃদ্ধ মন্ত্রী ছিলেন না, যিনি প্রশ্ন করবেন।
কিন্তু মুখ ?
চিন্তিত মুখ, এই বুঝি এগোনো, এই বুঝি পেছোনো
সারা দিন টানতে থাকা চাকা, টাকা টাকা টাকা
সুখ থাকবে তো ? কোকিল গাইবে তো
তোমার বিকাশ, বাচ্চাগুলো খেলার মাঠে
নিতে পারবে তো নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ?
মানুষ কে মানুষকে করতে পারবে তো বিশ্বাস?
প্রশ্নটা এখানেই। এই যে ২২৬০০ কোটি টাকা দিয়ে বিরাট রাজপথ, হু হু করে ছুটে যাবে গাড়ি, পণ্য সামগ্রী নিমেষে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, একদিনের মধ্যে অ্যামাজন পৌঁছে দেবে স্মোকড প্যাপরিকা, আপনার ঘরে তৈরি হবে রোটেশিয়র চিকেন, একদিনেই মুখ চিকন করার যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স গ্যাজেট, এখনতো হাতে আটা মাখাও ভুলে যাচ্ছেন অনেকেই, মাইক্রো অ্যাভেন চাই, চাই বারবিকিউ শস, আরও কত কিছু। কদিন আগে পেতেন? গত ২০ বছরে ছবিটা আলাদা হতে শুরু করেছিল, গত সাত বছরে এক্কেবারে হুস করে বদলে গ্যালো, সত্যিই বদলে গ্যালো? কাদের বদলালো? কতজনের বদলালো? কিরকম বদলালো? প্রধানমন্ত্রীর এই বিকাশ কাহিনী কি শুধুই প্রধানমন্ত্রীর? তাকি কেবল বিজেপির? তা কি কংগ্রেসের নয়? দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো সেই বিকাশের ক্ল্যাসিকাল ডেফিনেশনে বিশ্বাস করে না? তাদের কাছে বিকাশের অন্য কোনও মানে আছে? আজ তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
দেশের জনসংখ্যা কত? ১৩৫ কোটির কিছু বেশি। দেশের বিকাশ কথাটা অর্থহীন, আসল বিকাশ তো মানুষের, মানুষের জীবনযাত্রার, জীবনমানের, আসল বিকাশ তো গরিষ্ঠ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বাসস্থানের। আম্বানির আন্টিলাতে ৪৫টা ঘর আছে। তো? গোপাল আদেরকর, আন্টিলার উল্টোদিকের ফুটপাথে কলা বিক্রি করে, তার কী? সে তো রাতটা ফুটপাথে কাটায়।
দেশের প্রধানমন্ত্রীর পকেটে ৮০ হাজারের ম ব্লাঁ, কামাল হোসেন, স্কুলের খাতা পেন কেনার পয়সা নেই, তার কী এসে যায়? কিছু লোকের বিকাশ তো আসলে এক ভয়ঙ্কর তামাশা, কিছু লোকের জন্য গাড়ি বাড়ি, খাবার দাবার, বিলাস সামগ্রী, বিরাট মাইনে আর বাকি লোকেদের দুবেলা খাবার জুটবে না, তাকে বিকাশ বলে? কে বলছে দেশের বেশিরভাগ লোক খেতে পায়না, তাদের খাবার কিনে খেতে সরকারের দানের উপর নির্ভর করতে হয়? কে বলছে এ কথা? দেশের চা ওলা কাম চওকিদার, কাম প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ কথা বলছেন। তিনিই জানাচ্ছেন দেশের ৮৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হয়েছে, মানে সোজা, দেশের ৮৫ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান নেই, খাবার নেই। আম্বানি গেছেন নাকি ফ্রি রেশন নিতে? তাকিয়ে দেখুন আপনার চারপাশ, পেয়ে যাবেন বাকি ২০ কোটি মানুষ, যারা কোনও দিনও জীবনে রেশনের দোকানই দেখেন নি, যাঁদের জীবনের সমস্যাগুলো শুনলেই বুঝতে পারবেন, তাঁরা দেশের সেই লোকজন যারা বিকাশের থেকে ঝরে ঝরে পড়া প্রাচুর্যের ফোয়ারার মধ্যে বসে আছে।
সমস্যা কী? দেড় লাখ টাকা দামের লাইটার কাজ করছে না, সারানোর মিস্ত্রি পাওয়া যাচ্ছে না, কি বিরাট সমস্যা বলুন তো? ডাভিডফ কফি যে লোকটা দিত, তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এবার কী হবে? ৯টা গাড়ি আছে, কিন্তু নতুন বি এম ডব্লুউর মডেলটা তার আগে আরেক গবুচন্দ্র কিনে নিয়েছে, বিরাট সমস্যা।
এরা বিকাশের বাচ্চা বললেও কম বলা হয়, এ বিকাশের খবর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাখেন না, এক কর্মীসভায় বলতে শুনেছি, মানুষের কত টাকা দরকার? টাকা কি চিবিয়ে খাবে, উপস্থিত অনেকেই অস্বস্থিতে ছিলেন, তাঁদের টাকা খরচ করার অনেক পদ্ধতিই জানা আছে, যা মমতা ব্যানার্জির জানা নেই। সিপিএম দলের কর্মসূচির ১১২ ধারা মেনে, সিপিএম রাজ্যের ক্ষমতায় বসেছিল, কী ছিল সেখানে? বলা হয়েছিল, যদি দেখা যায়, অঙ্গরাজ্যে জনগণের আশু সমস্যাবলী প্রশমনের, এক বিনম্র কর্মসূচিতে অঙ্গীকারবদ্ধ এক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে, তাহলে পার্টি নিশ্চয়ই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। মানে, সরকারে এসে আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়, তারা যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের নজর সেই গরীবস্য গরীব মানুষজনের জন্য এখনই যা করা দরকার, তাই করবে, তাদের খানিক রিলিফ দিতেই তাদের ক্ষমতায় আসা। এই সরকার, এই ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের বিকাশের কথা ভাবে না, এই ব্যবস্থায় তা ভাবাও যায় না, অতএব সরকারে এলে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের আশু সমস্যাগুলো খানিক মেটানোর জন্যই, ক্ষমতায় বসা।
তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিকাশের কী হবে? তা কবে হবে? সিপিএম বলেছিল, এই ব্যবস্থায় বসে তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, তার জন্য দরকার সমাজ বিপ্লব। আপাতত গরীবস্য গরীবদের কিছুটা পাইয়ে দেওয়া, সেটা পাইয়ে দিতেই তাঁরা টাটাবাবুকে ডেকে এনে সস্তায় জমি পাইয়ে দিচ্ছিলেন, কী হবে সেই কারখানা তে? ছোট্ট গাড়ি। রবীন দেব চড়বেন। তো মানুষ এই বাকতাল্লা ধরে ফেলেছে, এবং ওদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি আদতে তেমন কিছুই করছেন না, কেবল তস্য গরীব মানুষগুলোকে কিছু পাইয়ে দিচ্ছেন, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি, সি পি এম এর গোপাল ভাঁড় সৌরভ পালোধি থেকে এখনও তরুণ নেতা সুজন চক্রবর্তী থেকে বিজেপির দিলীপ ঘোষ, এই কথাই বলেন। স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েদের সাইকেল, সবার জন্য স্বাস্থবীমা, বিরাট টাকার নয় কিন্তু এখনই দরকার হলে স্বাস্থ্যসাথী আছে, বিরাট হাসপাতাল তৈরি না করে, ছোটলোকেদের চিকিৎসা হচ্ছে। এই মুরগি দাও তো ওই হাঁস দাও, কেবল পাইয়ে দাও। সেই লোকগুলোকে বিনা পয়সায় রেশন দাও, আচ্ছা এটাই কি কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল না?
এবার, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কমিউনিস্ট নন, তিনি শিল্প সম্মেলনও করছেন, দেশের বিকাশ মডেলেও আছেন, আবার গরীব মানুষজন যাতে কিছুটা পায়, চুঁইয়ে পড়া হোক, তাই সই, তাদের ঘরেও যেন খাবার ঢোকে। আর সেখানেই এ রাজ্যে মমতার ভিত্তি, তৃণমূলের ভিত্তি কি না তা পরে আলোচনা করা যাবে।
বিকাশ নিয়ে কি বক্তব্য বিজেপির? তারা ঠিকই করে নিয়েছে, দেশের বিত্তবান, বিলিওনিয়র, মিলিওনিয়র, উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত হল তাদের এই বিকাশের ক্ল্যায়েন্ট। গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদী, হাইওয়ে তৈরির বরাদ্দ ৩ গুণ বাড়িয়েছেন, রেল বললে ভুল হবে রেলে পণ্যবহনের জন্য বরাদ্দ ৪ গুণ বাড়িয়েছেন, হাইওয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ান, গুণে দেখবেন প্রতি ৪০/৫০ টা ভারি ট্রাক পিছু একটা যাত্রীবাহী বাসও দেখা যাবে না, রাতে তো নয়ই, তখন কেবল পণ্য পরিবহন। মানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে শিল্প, তার সহজ পরিবহণের ব্যবস্থার দিকে সরকারি নজর রয়েছে, ওই তস্য গরীব লোকজনের কি কোনও লাভ নেই? আছে তো, কুলি কামিন, মজুর, মুটে চুঁইয়ে পড়া বিকাশের ঝোল, মাংস, মেটে, আলু যারা খাবার তারাই খাচ্ছে। খানিক ঝোল ওই মানুষদের জন্য বরাদ্দ আছে বৈকি, সেটাই আমাদের পরধান সেভক কাল বোঝালেন, এবং সেসব বোঝানোর পর দেশপ্রেম আর মনোরঞ্জন, বিমান বাহিনীর ইয়া ইয়া যুদ্ধ বিমান গর্জন করতে করতে নেমে পড়ল ওই পূর্ভাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতেই, খানিক যুদ্ধের মহড়াতে গা সেঁকে নিল সব্বাই। সেগুলোও অবশ্য আমাদেরই পয়সায়, আমাদের ট্যাক্সের পয়সায়, তার জন্যও মোদিজী আরেক বাহিনী তৈরি করেছেন, মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারা রেকর্ড পরিমাণ ট্যাক্স জমা দিচ্ছেন, সেই টাকায় রাফাল আসছে, কিকব্যাক কারা পাচ্ছে, তা তো আপনারা জানেন, তেনারা কিকব্যাকের টাকার খানিক ট্যাক্সেও দিচ্ছেন, আবার আরও বেশি কিকব্যাক পাচ্ছেন। বিকাশের গবুচন্দ্র মডেলের নিট রেজাল্ট? হাঙ্গার ইন্ডেক্স এ আমরা নেপাল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার তলায়, আমাদের গ্রামে স্বনিযুক্ত, মানে নিজের ব্যবসা বা কাজ করে যারা রোজগার করেন, তাদের ২০১৭ তে দিনের রোজগার ছিল ২১ টাকা ১০ পয়সা, ২০২০ তে সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ৯০ পয়সাতে, সুখবরও আছে, শহরে স্বনিযুক্ত মানুষজনের দৈনিক রোজগার এই সময়ে ১৩৯.৯০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪১ টাকা ৩০ পয়সা হয়েছে, ভাবা যায়? ১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের চওকিদারের বন্ধু মানুষ, গৌতম আদানি, চৌকিদারি শুরু হবার আগে এই দেশে মোট ৪৪ টা প্রজেক্টের মালিক ছিলেন, ২০১৮ তে তা বেড়ে ৯২ টা আর ২০২০ তে সেঞ্চুরি পার, তাঁদের সম্পদ বেড়েছে ২৫০% এর বেশি, মোদিজী যেটাকে বিকাশ বলছেন। শীত আসছে, চোখ রাখুন খবরের কাগজের পাতায়, কেবল উত্তর ভারতে কমবেশি ৪০০/৫০০ জন মারা যাবেন, শীতে কুঁকড়ে, সে সব লাশ পড়ে থাকবে না ফুটপাথে, লজিস্টিক রেডি, হুস করে দেহ চলে যাবে মুর্দাঘরে, বিকাশের তান্ত্রিকরা যজ্ঞে বসেছে, কিছু লাশ তো পড়বেই, বিকাশের কোল্যাটারাল ড্যামেজ।