আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো জেলেনস্কি নন, এক ডন মাফিয়া প্রেসিডেন্টের সামনে হেঁ হেঁ করেই ফেরেন। কিন্তু দরকার হলেই মনকি বাত বলতে যান, নিজের মতো আগডুম বাগডুম বলেন, বহু চেষ্টার পরেও সেই মন কি বাত-এর ভিউয়ারশিপ আসলে কমছে। তো সেই মন কি বাত-এর ১১৯ নম্বর এপিসোডে তিনি বললেন, বিজ্ঞান দিবসে আপনারা একদিনের জন্য বিজ্ঞানী হন, একদিন সায়েন্স মিউজিয়ামে যান, বিজ্ঞান চর্চা করুন। শুনুন উনি ঠিক কী বলেছেন। তো যিনি ক’দিন আগে ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট পরে মহাকুম্ভে ডুব দিয়ে এসে একরাশ মিথ্যে দিয়ে গড়া ১৪৪ বছরের এক অবিজ্ঞানকে তুলে ধরেন, তিনি তো সারা বছর বিজ্ঞান চর্চা করবেন না, একদিনই করবেন, ঠিক সেটাই দেশের মানুষকেও বলছেন। এদিকে এক সিপিএম বিজ্ঞানকর্মীও কী আশ্চর্য, একদিনের জন্য তাগা তাবিজ খুলে রেখে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার কথা ফেসবুকে বলেছেন। তিনি লিখেছেন, আজ জাতীয় বিজ্ঞান দিবস।
সি ভি রমনকে স্মরণ করে অন্তত আজকের দিনটাতে আংটি তাবিজ মাদুলি খুলে রাখি, বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য নয় এমন চিন্তা না করি, তেমন কথা না বলি। তো লোকজন ব্যাপক খিল্লি করেছে, এবং ওনার বক্তব্য আর মোদিজির বক্তব্য যে এক হয়ে গেছে সেটা বুঝেই খানিক এডিট করেছেন কিন্তু অন্তত একদিনের জন্য আংটি তাবিজ খুলে রাখার কথাটা ওনার ওয়ালে জ্বলজ্বল করছে। তবে মনে হয় না সিপিএম দল এসব কথাকে সমর্থন করবে, আজ না হয় কাল মোদিজির আদর্শ প্রচারের এই পোস্ট তিনি তুলে নেবেন। কিন্তু মোদিজি তো অন্য কথা বলবেন না। উনি থালা বাজানোর কথা বলবেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোর কথা আবার বলবেন। ১৪৪ বছর পরে মহাকুম্ভের ঢপবাজি চালিয়েই যাবেন। এবং সেই তিনিই নিজেকে নন বায়োলজিক্যাল বলেছেন, আবার বলবেন। সেই সময়ে আমার এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন, আগে আমরা জানতামই যে উনি মানে আমাদের চৌকিদার লজিক্যাল নন, আমরা সবে সেটা মেনে নেওয়া প্র্যাকটিস করছিলাম, সেই মুহূর্তে জানা গেল উনি বায়োলজিক্যালও নন। কী কাণ্ড। হ্যাঁ, গঙ্গাস্নান করে আমাদের মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার এক সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন যে তিনি মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেননি, মানে পৃথিবীতে যেভাবে আর পাঁচজন জন্মায় তিনি সেভাবে জন্ম নেননি, ভগবান স্বয়ং তাঁকে নিজের হাতে তৈরি করে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েছেন মাত্র, মানে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন।
পৃথিবীতে আসার পরে প্রথম শিক্ষক আমার বাবা বলতেন চোখ কান খোলা রাখবি কারণ যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, সত্যিই কত কিছু দেখেছি, শিখেছি, এবার যেটুকু বাকি ছিল তাও পূর্ণ হল, নিজের চোখে অবতার দেখে ফেলেছি, আহা চোখে কার্টিয়ের সানগ্লাস পরা, পকেটে মঁ ব্লাঁ পেন, দিনে তিন চার বার পোশাক পরিবর্তন করা এক অবতার দেখে ফেলেছি আমরা, যিনি আবার বলছি বায়োলজিক্যালি জন্মই নেননি, মানে জীবন বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে এক শুক্রাণু, এক ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে তাঁর জন্ম হয়নি, তিনি ঈশ্বরসৃষ্ট অবতার হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন, এমনিতে উনি জন্মদিন নিয়ে বিস্তর মিথ্যে বলেছেন তবুও ধরে নেওয়া যাক ওই সেই দিনটা যেদিন দেশ সুদ্ধ মানুষকে তিনি থালা গ্লাস বাজাতে বলেছিলেন, সেই দিনই ছিল তাঁর ধরাধামে অবতীর্ণ হওয়ার দিন। জোকস অ্যাপার্ট, কোনও সুস্থ মানুষ আজ এই সময়ে এরকম কথা বলতে পারে? বললে তাঁর সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? না, উঠবে না। কারণ বহুবার বহু শাসকের মধ্যে নিজেকে ঈশ্বরের অবতার মনে করার রোগ ইতিহাসে আছে, মেগ্যালোম্যানিয়্যাক এক মানুষই ক্ষমতা পেলে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, সেই জন্যই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত স্বৈরাচারীরা নিজেদের ঈশ্বরের অংশ বা ঈশ্বরসৃষ্ট বা ঈশ্বর প্রেরিত অবতার বলেই মনে করতেন। মধ্যযুগের প্রায় প্রত্যেক শাসক একথা মনে করতেন, অন্তত সেটাই মানুষকে বলা হত, হীরকের রাজা ভগবান, এ তো আমরা জানি, শুনেছি। এর আগে আমরা নরেন্দ্র মোদির মন্দির দেখেছি, সেখানে পুজো-অর্চনা দেখেছি, ভেবেছি ওসব অন্ধভক্তদের বাতুলতা, পুজোর আসনের পাশে জ্যোতি বসুর ছবিও তো আমরা দেখেছি, তেমন অন্ধ ভক্তের কাজ বলেই আমরা এড়িয়ে গেছি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ম-এ মজুরি, ম-এ মহাকুম্ভ, ম-এ মিথ্যে, ম-এ মোদি
উনি ছিলেন চৌকিদার, তারপরে প্রধান সেবক, তার কিছুদিন পর থেকে হিন্দু হৃদয় সম্রাট বলা শুরু হল, তারপর বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র সম্বিত পাত্র তিনি বলেছিলেন জগন্নাথদেব মোদিজির ভক্ত, আমরা ভেবেছিলাম মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, তারপর বুঝেছি তা নয়, মোদিজি নিজেই বলেছেন উনি ঈশ্বর প্রেরিত অবতার। আচ্ছা আধুনিক ইতিহাসে আমাদের দেশে বা বিদেশে এরকম গণতান্ত্রিক দেশে এমন উদ্ভট কথা কেউ বলেছে? আছে, হিটলার নিজের খুব দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে ঈশ্বর প্রদত্ত বলেছেন আর সেটাকে নিয়েই এক বিশাল মিথ তৈরি করেছিলেন গোয়েবলস, সেভিয়ার অফ সিভিলাইজেশন নামে এক বিশাল কনক্লেভে ডেকে শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, লেখক বুদ্ধিজীবী ইত্যাদিদের দিয়ে বলানো করিয়েছিলেন হিটলার ঈশ্বর প্রেরিত দূত, যদিও হিটলার সে অনুষ্ঠানের সবটাই উপভোগ করেছিলেন কিন্তু নিজে ভগবান বা ওই আমার জন্ম বায়োলজকালি নয় গোছের মূঢ়তা দেখাননি। মুসোলিনি পোপের মতো ব্যালকনিতে এসে হাত নাড়াটাকে আয়ত্ত করেছিলেন, সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন এক ধাপ এগিয়ে নিজেকে নাইব-এ-খুদাই বলে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি নিজেকে কোনওরকম বিচারের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ঘোষণা করে। আসল কথাটা এটাই, এরকম ঘোষণা, মানে নিজের উপর দেবত্ব ঘোষণা আসলে নিজেকে আইন কানুন সংবিধানের উপরে নিয়ে যাওয়ারই এক কায়দা মাত্র। কেবল হিন্দু ধর্ম, মুসলমান, মসজিদ, রামমন্দির করেও কিছু হচ্ছে না এখন তাই নিজেই ভগবান হয়ে ওঠার কথা বলছেন মোদিজি। অনেকেই এই ঘোষণা এক বাচালের বাতুলতা বলে মনে করেন, সেভাবেই এই কথার ব্যাখ্যা করছেন, বিষয়টা অনেক গভীরে। আসলে এই আরএসএস -বিজেপির মূল ধারণাটাই এসেছে ওই হিন্দুত্ববাদ থেকে, যা আর দশজন সাধারণ হিন্দুর মতবাদ নয়, যা এক প্রবল হিন্দুত্ববাদ যা এক জঙ্গি রাষ্ট্রবাদের জন্ম দেয়, যা এক নয়া অবতারের, এক মসিহার কল্পনা করে, যা দেশের সংবিধানের বিরোধী, সেই মতবাদেরই এক বহির্প্রকাশ হল এই ঈশ্বরের দূত হওয়ার চেষ্টা। কিন্তু কেবল ধার্মিক হলেই চলবে না, সেটাও জানেন, তাই মাঝে মধ্যে বৈজ্ঞানিক হওয়ার ভড়ংবাজি।
দ্বিতীয় কারণ হল এই নেতৃত্বের অশিক্ষা, চূড়ান্ত অশিক্ষা। এবং নিজের অশিক্ষার বাইরে শিক্ষিত মানুষজনদের প্রতি ঘৃণা। উনি অর্থনীতিবিদদের কথা শোনেন না, জ্যোতিষ, রামদেব, বাবাজি মাতাজিদের কথায় থালা বাজাও, দিয়া জ্বালাও ওনার নিদান। এক অশিক্ষিতের জন্য আবার অর্থনীতি বেহাল। দ্বিতীয় ওয়েভ যখন আসছে, তিনি ব্যস্ত ছিলেন বাংলার নির্বাচন নিয়ে, ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন এবং তখনও মহা পুণ্যভূমির কুম্ভস্নানের জন্য আসা পুণ্যার্থীদের বধাই দিচ্ছিলেন, স্বাগত জানাচ্ছেন। ফল সবার জানা। আসলে এই অশিক্ষা দেশকে ডোবাচ্ছে, সেই অশিক্ষার কথা কি তাঁরা নিজেরা জানেন না? জানেন বলেই মানুষের মধ্যে যেতে ভয়, সাংবাদিকদের সামনে এলে গলা শুকিয়ে যায়, এক গ্লাস জল খেয়ে ইন্টারভিউ থেকে পালিয়ে বাঁচেন, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। য়ার সেই বিচ্ছিন্নতা কাটাতেই নিজেকে আরও মহান করে তোলার চেষ্টায় মোদিজী নিজেকে অবতার বানিয়ে ফেললেন, ধর্মেও থাকলেন জিরাফে তো তিনি আছেনই। ২০২১ হরিদ্বারে অর্ধকুম্ভ হয়েছিল, ২০২৫-এ মহাকুম্ভ হয়ে গেল। ভাবা যায় এই মিথ্যাচার! ভাবা যায় এই অপপ্রচার, কিন্তু তাঁরা সফলও হচ্ছেন। মানুষ উদ্ভট তত্ত্বে বিশ্বাসও করছেন, রাম এক অনৈতিহাসিক কল্পনার চরিত্র, তাঁর জন্মদিন, জন্মভূমি মায় আঁতুড়ঘর পর্যন্ত খুঁজে, সারা দেশের মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন, ওই বাবরি মসজিদের তলায় ছিল রামের জন্মভূমি।
কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে বা কিছু মানুষকে বিশ্বাস করানো গেছে, যে রাম সেতু হল এক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিস্ময়, সেখান থেকে নাকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নতুন সূত্র পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই বালখিল্য কথা বলেছেন, যে গণেশের মাথায়, হাতির মাথা নাকি প্লাস্টিক সার্জারিতে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, আর এক মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরার, তিনি মনে করেন কুরুক্ষেত্রে মহাভারতের যুদ্ধের সময় ইন্টারনেট ছিল, এসব আজগুবি খবর এমনি এমনি দেওয়া হচ্ছে না, দেওয়ার পেছনে পরিকল্পনা আছে, প্রথমে কাউকে দিয়ে, সে যেই হোক, প্রধানমন্ত্রী, বা দলের স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা হোক, একটা কথা ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারপর তা নিয়ে বড় করে কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে, বলা হল গণেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারির কথা, তারপরে আয়ুর্বেদ পাশ ডাক্তারদের, সার্জন হিসেবে সার্টিফিকেট দেবার কথা বলা হচ্ছে, আরে কাটা মাথায় যদি সেই তখনকার আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা হাতির মাথা জুড়ে দিতে পারেন, তাহলে সার্জারি তো আয়ুর্বেদের হাতের মুঠোয়। এদিকে অসুখ করলে অমিত শাহ চলে যাবেন, স্পেশালিটি হাসপাতালে। সাধারণ মানুষ তাদের দেহ সঁপে দেবে আয়ুর্বেদাচার্যদের হাতে, যার হাতে যা মানায়, ওসির হাতে পিস্তল, কনস্টেবলের হাতে ডান্ডা। অ্যালোপাথি পড়ে সার্জনরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছেন, ওদিকে অ্যালোপাথি চিকিৎসাকে ক্রমশ মহার্ঘ বানিয়ে, বিশাল প্রাইভেট পুঁজি এনে, সাধারণ মানুষের কাছে কবেই ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন তার বিকল্প আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি। নেতা মন্ত্রী, আম্বানি আদানিদের জন্য থেকে গেল বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, কেমন মজা।
পদ্ধতিটা এক, প্রথমে একটা কথা ভাসিয়ে দাও, তারপর তা নিয়ে এবারে একদিনের বিজ্ঞানী হওয়ার কথা বললেন স্বয়ং মোদিজি, ভক্তের দল দ্বিগুণ উৎসাহে এই অবতারকে তুলে ধরবেন আর সেটাই আগামী দিনে বিজেপির হাতিয়ার। অন্তত মোদিজি সেটাই মনে করেন। তিনি সময় মতো নিজেকে বদলান, জামাকাপড় ছেড়ে কখনও বিজ্ঞানী, কখনও সনাতনী, কখনও চরম কুসংস্কার আর অশিক্ষায় আচ্ছন্ন এক মানুষ, সব মিলিয়ে বলাই যায় যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ধর্ম জিরাফ বিজ্ঞান কুসংস্কার, যুক্তি, যুক্তিহীনতা নিয়ে সত্যিই নন বায়োলজিক্যাল হয়ে উঠেছেন।