ত্রিপুরার পুরনির্বাচনের ফলাফল হাতে এল, তৃণমূলের ভোট ২৪ শতাংশ, বামেরদের ভোট ২০শতাংশ, মানে ত্রিপুরাতেও তৃণমূল উঠে আসছে, এই মেরুকরণ চলতে থাকলে সামনের বিধানসভায়, যেখানে এরকম অবাধ ভোটলুঠ চলবে না, ফলাফল অন্যরকম হতে বাধ্য। জমিতে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধিতার প্রথম মুখ হয়ে উঠছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বললেন খেলা হবে, অখিলেশ বলছেন খেল হোই, সুহেলদেব পার্টির ওমপ্রকাশ রাজভর বলছেন খদেড়া হোবে, তাড়িয়ে ছাড়ব। মমতার দুয়ারে সরকার, গোয়াতে বিজেপি সরকার এর নতুন প্রকল্প সরকার তুমছা দ্বারি, আপনার দরজায় সরকার।
মমতার লক্ষীর ভান্ডার, পঞ্জাবে কেজরিওয়াল গিয়ে বললেন, আমরা রাজ্যে লক্ষীর ভান্ডার চালু করবো। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো, টেনিস প্লেয়ার লিয়েন্ডার পেজ, সন্তোষমোহন দেবের কন্যা অসমের কংগ্রেস নেতা সুস্মিতা দেব তৃণমূলে এলেন, তৃণমূলে এলেন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়, এই সেদিনে রাষ্ট্রিয় কার্যকারিণী সদস্য নির্বাচিত হলেন তৃণমূল থেকে বিজেপি তে যাওয়া রাজীব ব্যানার্জী, তিনি তৃণমূলে, সম্ভবত অস্বস্তি এড়াতে তিনি ত্রিপুরাতেই কাজ করবেন, মেঘালয়ের মুকুল সাংমা দলবল নিয়ে চলে এলেন তৃণমূলে, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব, এখনও পর্যন্ত যা খবর তাতে ২০-২৫ টা আসন ছেড়ে দিচ্ছেন তৃণমূলকে, কর্ণাটকেও কিছু নেতা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তৃণমূল নেত্রী দিল্লি গেলে মিডিয়া উপচে পড়ছে।
ন্যাশনাল মিডিয়াতে তৃণমূল জায়গা নিচ্ছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন, মহুয়া মৈত্র দিল্লি লুটিয়েন্সদের কাছে সমাদৃত, সে মহলে তাদের কদর বাড়ছে। মোদী সরকার, যাদের ওপর পেগাসাস নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ, তাদের মধ্যে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধায়। মানে সব মিলিয়ে মমতা, তৃণমূল দল, দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটা জায়গা করে নিয়েছে, তাদের অগ্রগতি অব্যাহত। মিডিয়াতে অনেকেই রুঢ় ভাষায় সমালোচনা করছেন, বাম বুদ্ধিজীবী, বাম দলের মত হল, মমতা মোদিজীর হয়ে কংগ্রেস মুক্ত ভারত তৈরি করছেন, এ রাজ্যে সি পি আই এম এর তরুণ নেতা সুজন চক্রবর্তীও এই কথা বলেছেন, সেই দিদি মোদি সূত্র, বিজেপি তৃণমূলের তলায় তলায় যোগাযোগের পুরনো কথা, মিডিয়ার একাংশ তৃণমূলের এই পদক্ষেপকে মমতার উচ্চাকাংখ্যা বলে হাসাহাসিও করছেন, ওহ তো পি এম বন না চাহতি হ্যায়। একবারও ভাবছেন না, বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসী নেতারা বিজেপি তে না গিয়ে তৃণমূলে আসায় কার লাভ হল, কার ক্ষতি হল।
এটা ভাবছেন না যে কোন কারণে মমতা সারা দেশেই এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, হ্যাঁ আমি সচেতনভাবেই মমতা বলছি, তৃণমূল নয়, এখনও নয়। এখনও ফোকাস মমতাতেই, এবং এইখানেই মোদি মডেলের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মমতা, যিনি নরেন্দ্র মোদীর দিদি ও দিদি কে উপেক্ষা করেও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, কোমরে দড়ি বেঁধে আনার কথা অনায়াসে বলতে পারেন, মানুষ দেখছে টিট ফর ট্যাট। দেখছে ঢিল ছুঁড়লে পাটকেল খেতে হয়, দেখছে মারের বদলা পালটা মার আছে, সেই রোখ আছে, সেই অ্যাগ্রেসিভনেস আছে, মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই এর ধক আছে এমন একজন নেতাকে, আর কে আছে? কেজরিওয়াল? দিল্লির আয়তন ১৪৮৪ স্কোয়ার কিলোমিটার, আমাদের রাজ্যের ছোট্ট জেলা হাওড়া, ১৪৬৭ স্কোয়ার কিলোমিটার। এবং মাথায় রাখুন দিল্লির হাতে পুলিশ নেই, দিল্লি এক ইউনিয়ন টেরিটরি, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।
দেশের প্রথম পাঁচটা বড় রাজ্যের মধ্যেই আছে বাংলা, গুরুত্বের দিক থেকে মহারাষ্ট্রের পরেই বাংলা, কার্টিসি আমাদের কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা, ৪২ জন সাংসদ নিয়ে সংসদেও গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এই মুহূর্তে মমতা যে লাইমলাইটে আছেন, বহুবছর আগে জ্যোতি বসুও সেই আলো পেয়েছিলেন, সেবারও আলো ছিল জ্যোতি বসুর জন্য, সিপিএম এর জন্য নয়, প্রকাশ কারাত নিজের গুরুত্ব না বুঝে কালিদাস হয়েছেন, সে এক অন্য গল্প। সে সব কারাত ইত্যাদি তৃণমূলে নেই, থাকার কথাও নয়, এখানে একটাই পোস্ট, একজনের আলোর ছটাতেই দল আলোকিত, তা বুঝতে পারেন দলের প্রত্যেক নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। তাকিয়ে দেখুন না, আছেন তো রাজস্থানের গেহলট, ছত্তিসগড়ের বাঘেল, ছিলেন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং, এঁদের কে নরেন্দ্র মোদীর সামনে রাখুন, ১০০ ওয়াটের হ্যালোজেনের সামনে মোমবাতি মনে হবে।
আছেন কেরালায় পিনারাই ভিজয়ন, ভাল কাজ করছেন, দক্ষ প্রশাসক, রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, দেশের মধ্যে অন্যতম এগিয়ে থাকা রাজ্য, কিন্তু রাজ্যে লড়াই কাদের সঙ্গে? যাদের সঙ্গে তাঁর দল বাকি দেশে নির্বাচনী জোট করে, হাতে হাত মিলিয়ে চলছে, তাদের সঙ্গে। যদিও তাঁর নিজের রাজ্যে কংগ্রেসের বড় বড় নেতা সি পি এম এ যোগ দিচ্ছে, সুজন চক্রবর্তি না চাইলেও দিচ্ছে, এবং পিনারাই ভিজয়ন তাঁদের কে বুকে টেনে নিচ্ছেন, কারণ তিনি জানেন, তাঁর লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে। রইল বাকি বিজু পট্টনায়েক এর লিগ্যাসি নিয়ে চলা নবীন পট্টনায়েক, তিনি ওড়িষ্যার বাইরে এই বিরাট দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন বলেই মনে হয় না, উৎকল নিয়েই তিনি খুশি।
অন্ধ্র দু’ভাগে ভেঙে এখন মাঝারি রাজ্য, তেলেঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও, মন বেশি রাজনীতিতে ডুপ্লিকেট শরদ পাওয়ার, দারুণ যোগাযোগ সব্বার সঙ্গে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবার ইচ্ছে বা সামর্থ তাঁর নেই, তিনি শরদ পাওয়ারের মত বুঝে গেছেন কিং মেকার হওয়াটা কাজের কাজ। অন্ধ্রপ্রদেশের জগন রেড্ডি, নিজের মুখ্যমন্ত্রীত্বের বাইরে আপাতত হাত বাড়াবেন না, বয়স কম, অনেক সময় পড়ে আছে, তিনি জল মাপছেন, যেদিকে ঢাল, সেদিকে বয়ে যাবেন। ওদিকে মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে, কংগ্রেস আর এনসিপি সামলাতেই দিন চলে যায়, মহারাষ্ট্রের বাইরে তাঁর কোনও এজেন্ডা নেই, থাকলেও সেটা মোদির বিরোধিতা, সেখানে তিনি কার্যকরী ভূমিকা নিতেই পারেন, নেতৃত্ব নয়। অর্থাৎ মোদীর বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকায় কেবল মমতা।
ঠিক সেভাবে উল্টোদিকেও দেখুন, একমাত্র যোগী ছাড়া বিজেপির কোনও মুখ্যমন্ত্রী, মোদীর মুখোমুখি হবার কথা স্বপ্নে ভাবলেও সকালে ডাক্তারের কাছে যাবেন, স্বপ্নদোষের চিকিৎসা করাতে, এবং ইদানিং যোগীও টের পেয়েছেন, যদি পার করতে হয় এই ভবসাগর, তাহলে তাঁর ভরসা সেই মোদিজী। মুখ্যমন্ত্রী নন, কিন্তু গান্ধী পরিবারের তো বটে, আছেন রাহুল গান্ধী, যিনি দলের নবীন, প্রবীণ, কোনো নেতাদেরকেই ধরে রাখতে পারছেন না। ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত, রুচিবান কিন্তু মোদিজীর সামনে পাপ্পুই রয়ে গেছেন। আঙুল তুলে খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ একজনই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তিনি আজ প্রাসঙ্গিক, কেবল তাই নয় ক্রমশ তাঁর আকার বাড়ছে। গোটা দেশ দেখছে, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এক কার্যকরী নেতার উঠে আসা।
২০২৪ এ কী হবে? সে অনেক পরের কথা, ততদিনে গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গ্যালন গ্যালন জল বয়ে যাবে, অনেক ভাঙা গড়া হবে, তা নিয়ে এখনই কোনও কথা বলছি না। কিন্তু এটা তো বলাই যায়, ঠিক এই মুহূর্তে বিজেপি বিরোধী শক্তি মমতার উপরে ভরসা রাখতে শুরু করেছে, এর সবথেকে ভাল দিক হল, অন্যান্য দল থেকে বিজেপিতে যে স্রোত বইছিল, তাতে ভাটা লেগেছে, কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতারা একটা যাবার যায়গা পাচ্ছেন, সেখানেই বিজেপি বিরোধী লড়াই এর সাফল্য, এর আগে একবার বলেছিলাম, সাম দাম দন্ড ভেদ, এর প্রত্যেকটাকে ব্যবহার করে বিজেপি আজ এই জায়গায়, উল্টোদিকেও একজন কে চাই যিনি এর প্রত্যেকটার ব্যবহার জানেন, মমতা সেই দায়িত্ব নিচ্ছেন, আপনি বিজেপি বিরোধী?
বিজেপি দুর্বল হলে আপনার খুশি হবার কথা, ফাইন টিউনিং নিয়ে ভাবার সময় এটা নয়, কমরেড স্তালিন ভাবেন নি চার্চিল কতটা কমিউনিস্ট বিদ্বেষী, ভাবেননি একবারও যে রুজভেল্ট রাশিয়ার বন্ধু হয়ে উঠবে, কিন্তু জোট বেঁধেছিলেন, আজ বিজেপি বিরোধীরা সেইভাবেই জোটে আসবে, মমতা সেখানে অন্যতম মুখ। আচ্ছা কংগ্রেসও কি পারবে দূরে থাকতে? কটা আসন পাবেন? দারুণ ফল করল কংগ্রেস ২০২৪ এ, কতগুলো আসন? ১০০/১১০/১২০? তারপর? বাকি সংখ্যা কোথা থেকে আসবে, গাড়ি তো তিনচাকায় চলে না, স্টেপনি দরকার, খুব দরকার, চারনম্বর চাকাটা থাকবে মমতার হাতেই, আর এখনই এত হিসেবের কি দরকার?
কারণ আগেই বলেছি, অনেক কিছুই হবে, মমতার দলে এখনও সেই অর্থে বড় বড় ন্যাশন্যাল লিডার রা তো যোগ দেন নি, যদি দেন? কংগ্রসের জি ২৩ কী করবেন? তাঁরা কিসের অপেক্ষা করছেন? কাজেই ২০২৪ থাক, আপাতত যা ঘটছে সেদিকে চোখ রেখে বলাই যায়, যেখানে বিজেপি পিছিয়ে পড়বে, সেখানেই লাভ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, উত্তরপ্রদেশে হারলে লাভ মমতার, পাঞ্জাবে কংগ্রেস জিতলেও লাভ মমতার, গোয়া বা ত্রিপুরা বা এর কোনও একটাও যদি হাতে আসে, তাহলেও অনেকটা এগিয়ে যাবেন উনি। এই মুহূর্তে অ্যাডভান্টেজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কারণ তিনি বিজেপি কে হারিয়েছেন, তাঁর রাজ্যের অর্থনৈতিক সামাজিক প্রকল্প নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা হচ্ছে, তাঁর স্লোগান দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে উঠেছে, খেল হোই, খদেড়া হোবে। তাই বলছি, হ্যাঁ খেলা হবে, হবেই।