গতকাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা ব্যাটে যা খেলেছেন তাকে কাজি নজরুলের ভাষায় বলতে গেলে এটাই বলতে হয়, দে গরুর গা ধুইয়ে। মোদিজি সম্ভবত এই সপাট জবাবের কথা বহুদিন মনে রাখবেন। এমনিতেই তিনি খানিক ব্যাকফুটে আছেন, তো সামলে খেলার বদলে হঠাৎ মেরে খেলার ইচ্ছে হল এবং তারপর যা হওয়ার হয়েছে, আপাতত রাজ্য সভাপতি মিডিয়ার সামনে তোতলাচ্ছেন। কতটা নির্লজ্জ হলে এমন একটা সময়ে তিনি বাংলার নির্বাচনের ঢাকে কাঠি বাজানোর কথা ভাবলেন? দেশের বিরোধী নেতারা দেশের হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরছেন, কেন? দেশের অবস্থান বোঝানোর জন্য। তো ৮৬০০ কোটি টাকার প্লেনে চেপে ফেকুবাবু কি বেড়ু বেড়ু করতে গিয়েছিলেন? এতদিন ধরে এই রাষ্ট্রপতি, সেই প্রধানমন্ত্রী গলা জড়িয়ে কী আহ্লাদি সব ছবি? আজ দেশ পাকিস্তানের উগ্রপন্থার জবাব দেওয়ার জন্য হাতে অস্ত্র ধরেছে, একজনও নেই? একজনও না। পাকিস্তানের পাশে চীন আছে, আজারবাইজান আছে, তুর্কমেনিস্তান আছে, টার্কি আছে, ভারতের পাশে কেউ নেই? নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানও নন বাংলাদেশের মুহম্মদ ইউনুস, তিনিও চিকেন নেকের ধমকি দিচ্ছেন। একবার নয় ৯ বার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ট্রাম্প সাহেব, আমেরিকা জানিয়েছে তাঁদের মধ্যস্থতার জন্য যুদ্ধ বিরতি হয়েছে। মুখ পুড়েছে ভারতের। দেশের অবস্থানের কথা বলতে বিরোধীরাও সমালোচনা বন্ধ করে একসঙ্গে বিদেশে গেছেন আর উনি বাংলায় এসে নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়লেন?
এবং তারপরেই মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে ভাষণে ওই যে বললাম দে গরুর গা ধুইয়ে, সেটাই করে ছেড়েছেন। আসলে মোদিজি অন্যের ভদ্রতা, অন্যের শৃঙ্খলাকে দুর্বলতা বলে মনে করেন, তার জবাব আজ তিনি পেলেন। তিনি এই বাংলাতে সঙ্কট দেখলেন, সারা দেশের অর্থনীতি গোবরজলে, পারচেজিং পাওয়ার কমছে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে আসল আয়, রিয়েল ইনকাম কমছে, স্টার্ট আপ কোম্পানি ভোগে গেছে, ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে মন্দা, ইনভেস্টমেন্ট আসছে না, উনি বাংলাতে সঙ্কট দেখতে পেয়েছেন। কী রকম? পাঁচটি ‘সঙ্কটের’ কথা বলেছেন তিনি। মোদির কথায়, ‘প্রথম সঙ্কট, সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা এবং অরাজকতা। ভাবা যায়, মোদিজী হিংসা আর অরাজকতার কথা বলছেন। মাত্র ২৮ মে- আলিগড়ে বজরং দল এবং অন্য আরও কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকেরা চার যুবককে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করেছিল। যাতে চার যুবকের প্রাণ সংশয় হয়েছিল। দেড় ঘণ্টা বাদে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল। তাঁর মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছিল। তিনি এখনও ট্রমা কেয়ার সেন্টারে আছেন। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বিপন্মুক্ত। বাকি তিনজন শরীরে অসংখ্য আঘাত এবং ক্ষত নিয়ে এখন সাধারণ বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। কেন মারধর করেছিল? কারণ ওই চারজন নাকি গোমাংস পাচার করছিল। আর গোমাংসের কথা বলে যে চার যুবককে প্রাণে মারতে চেয়েছিল, জানা গেল সেই মাংস গরুর নয়। বুধবার মথুরার ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থেকে যে রিপোর্ট পুলিশের কাছে এসেছে, তাতে পরিষ্কার জানানো হয়েছে গাড়িতে থাকা মাংস গোরু বা বাছুরের নয়। অথচ গোমাংসের অভিযোগ করে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের পেটাল।
২৪ মে শনিবার শনিবার সকাল ৯টা নাগাদ আলিগড়ের আলহাদপুর স্টেডিয়ামের কাছে একটি ম্যাক্স গাড়ি আটকায় বজরং দল এবং অখিল ভারতীয় হিন্দু সেনার লোকেরা। তারা দাবি করতে থাকে গাড়িতে যে মাংস আছে সেটা গরুর। ৫০ জনের বেশি লোক জড়ো হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পরে গাড়িতে থাকা চারজনকে টেনে নামায় হিন্দুত্ববাদীরা। নাম জিজ্ঞেস করে হিন্দুত্ববাদীরা জানতে পারে চারজনের নাম আরবাজ, আকিল, কাদিম এবং দিলওয়ার। এরপরে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মারতে শুরু করে। তাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয়। মারতে মারতে দিল্লি-কানপুর হাইওয়েতে নিয়ে আসে। রক্তে ভেসে যায় রাস্তা। তারপরেও তাদের মারতে থাকে। মাংসের গাড়ি ভাঙচুর করে রাস্তায় উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় হিন্দুত্বের উন্মত্ত বাহিনীর থেকে চার জনকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মোদিজি বাংলায় এসে হিংসা আর অরাজকতার কথা বলছেন। যাজক হোসে থমাসের পুত্র জোশুয়া হোসে থমাস, জানিয়েছেন যে তাঁরা পরিবার মূলত কেরালার মানুষ হলেও তারা গত ৩৫ বছর ধরে ছত্তিশগড়ের কবীরধাম জেলার কাওরধায় বসবাস করছেন। পরিবারের বাকি সদস্যরা হলেন হোসে থমাস (৫৬), স্ত্রী লিজি থমাস (৪৬), এবং দুই ছোট ভাই জোয়েল থমাস (১৮) ও জোসেফ থমাস (১৭)। গত ১৮ মে, রবিবার গির্জার প্রার্থনার সময় আরএসএস ও ভিএইচপি-র লোকজন এসে হামলা চালায়। তাদের অভিযোগ, পরিবারটি জোর করে ধর্মান্তকরণ করাচ্ছে। হামলায় তার মা ও ছোট ভাই আহত হন। পুলিশ কিন্তু পরিবারকে সাহায্য না করে বরং যাজক হোসে থমাসকে গ্রেফতার করে। মিথ্যা এফআইআর দায়ের করা হয় এবং থানাতেই পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। গোটা পরিবার এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা অরাজকতা নয়? উনি বাংলার অরাজকতা দেখতে এলেন?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ধর্ম, আরএসএস, বিজেপি আর ২৫ বৈশাখ
এখানেই থামেননি ওনার দিব্যচক্ষে দ্বিতীয় সঙ্কট, মা-বোনেদের নিরাপত্তার অভাব, তাঁদের উপরে অত্যাচার। মোদিজি জানেন না নাকি ভুলে গেছেন মণিপুরের কথা? সেখানে যেতে কি ৫৬ ইঞ্চি সিনাওলা মোদিজির সাহসে কুলোচ্ছে না? মোদিজি জানেন না ওনার সরকারের তৈরি ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্টে মহিলাদের উপরে ক্রাইমের তালিকার শীর্ষে কোন রাজ্য আছেন? শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে উপরে উত্তরপ্রদেশ, ৬৫৭৪৩টা ঘটনা সেখানে ঘটেছে, দু’ নম্বরে মহারাষ্ট্র, তিন নম্বরে রাজস্থান। মোদিজি বাংলার কথা বলতে এলেন। মাত্র গত পরশু ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের উপর থেকে সব মামলা তুলে নেওয়া হল, পুলিশ কোনও প্রমাণই দিতে পারেনি, যে লোকটার বিরুদ্ধে আমাদের সোনাজয়ী কুস্তিগিরেরা অভিযোগ আনল সে ছিল বিজেপির সাংসদ, এখন তার ছেলে সাংসদ। সেই বিজেপির উনিজি এসে বাংলার দিকে আঙুল তুলছেন? তৃতীয় সঙ্কটের কথা যা উনি বলেছেন শুনলে হেসে ফেলবেন, যুবকদের মধ্যে ঘোর নিরাশা, বেকারত্বের যন্ত্রণা। গত চার বছর ধরে এমপ্লয়মেন্ট-এর কোনও তথ্যই মোদিজির সরকার বের করছে না, কেন? কারণ তা আগের সব রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে, অন্য রাজ্যের কথা ছেড়েই দিন সিকিম, ছত্তিশগড়, ত্রিপুরা, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানাতে আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি আর হতাশা দেখছেন বাংলাতে? চোখে ন্যাবা আছে এবং যথারীতি মিথ্যে বলছেন।
মোদিজির দেখা চার নম্বর সঙ্কট, ঘনঘোর দুর্নীতি এবং তার ফলে নাকি এখানকার প্রশাসনের উপরে জনতার বিশ্বাস একনাগাড়ে কমতে থাকা। তো মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে সরকারের উপর থেকে আর বিজেপির ভোট কমছে তো কমছেই, এ তো বেশ মজার ব্যাপার। এখানে কত কোটি টাকার দুর্নীতির কথা আপনি বলবেন মোদিজি, হাজার? দেড় হাজার? নীরব মোদি, তাঁর বউ অমি মোদি, ভাই নেশাল মোদি আর কাকা আমাদের নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজির মেহুল ভাই, মেহুল চোকসি, এরা মিলে ১২৬৩৬ কোটি টাকার জোচ্চুরি করেছে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে, যতীন মেহতা, উইনসাম ডায়মন্ডের মালিক ৭০০০ কোটি টাকার ঘাপলা, আইপিএল-এর ললিত মোদি ১২৫ কোটি টাকার ঘাপলা, স্টারলিং বায়োটেক লিমিটেড-এর দুই ডিরেক্টর, চেতন জয়ন্তীলাল সান্দেসারা আর নীতিন জয়ন্তীলাল সান্দেসারা, ৫০০০ কোটি টাকার জোচ্চুরি করেছে, আশিস জবানপুত্র, এবিসি কটস্পিন প্রাইভেট লিমিটেডের ৭৭০ কোটি, হিরে ব্যবসায়ী রীতেশ জৈন ১৫০০ কোটি, সুরেন্দ্র সিং, অঙ্গদ সিং, হরসাহিব সিং ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স থেকে ৩৯০ কোটি তুলে ধাঁ, সঞ্জয় ভান্ডারি ১৫০ কোটি টাকা ট্যাক্স না দিয়ে পগার পার। সরকার বসে আছে, ইডি তো এসবের কথা জানে বলেও মনে হয় না। ওদিকে নীরব মোদিকে লন্ডনের রাস্তায় দেখা গেল, ১০ হাজার পাউন্ডের জ্যাকেট পরে ঘুরতে। সবকটা গুজরাটি, হ্যাঁ মোদিজির রাজ্যের বাসিন্দা, তিনি এলেন এই বাংলাতে দুর্নীতির সঙ্কটের কথা বলতে? ফাজলামি? পঞ্চম সঙ্কট, তৃণমূল নাকি গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নিতে থাকা ক্ষমতাসীন স্বার্থপর রাজনৈতিক দল। মোদিজীর মনেই নেই, ২০২১, ২০১৪ এর কথা, মনেই নেই দিদি ও দিদি বলে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করার পরে বাংলার মানুষের জবাবের কথা, মনেই নেই যে ওই এক উনিশ বাদ দিলে বিজেপির ভোট লাগাতার কমছে, প্রতিটা উপনির্বাচনে হারছে বিজেপি, হ্যাঁ কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক, সিআরপিএফ, নির্বাচন কমিশন সব্বাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েও তৃণমূলকে হারানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। গরিব মানুষ এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আস্থা রাখে, আস্থা রেখেই চলেছে, ২০২৬-এ আবার তার প্রমাণ পাবেন। এখানে এসে এসব ভুলভাল না বকে মোদিজি আপনি বরং সামনের লোকসভার অধিবেশনের জন্য তৈরি হন, ছাল ছাড়িয়ে নুন লাগানোর কথা শুনেছেন, হ্যাঁ আমি শশার কথাই বলছি, বাংলার লোকাল ট্রেনের এক সাধারণ হকারও জানেন কেমন করে ছাল ছাড়িয়ে নুন লাগিয়ে দিতে হয়।