স্বাধীনতা এসেছিল কেবল দেশ বিভাজন নিয়েই নয়, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা প্রত্যেক ভারতীয়কে যে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছিল, সেই আনন্দ ক’দিনের মধ্যেই মুছে যায়, প্রথমত দেশভাগের পরে দাঙ্গায়, দেশভাগের বিভীষিকা তখন চোখের সামনে, ট্রেনে করে লাশ আসছে, বদলে লাশ পাঠানো হচ্ছে। দেশের সর্বত্র দাঙ্গা হিংসা, মার কাট খুনোখুনি। অন্যদিকে জম্মু-কাশ্মীরে শুরু হল এক বিরাট সংঘর্ষ, যুদ্ধ। দেশভাগের পর, পাকিস্তানের মদতে উত্তর-পশ্চিম কাশ্মীরের উপজাতি মানুষজন মূলত কাশ্মীরি আর পস্তু ভাষাভাষী অঞ্চলের ওয়ার লর্ডসদের নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দলে দলে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে, যার ফলে কাশ্মীর, যা নাকি সবে ভারতে অন্তর্ভুক্তি মেনে ভারত ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে সেই অঞ্চলই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে তাদের স্বাধীনতার প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। এই সময় কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং আনেক্সেশন ডিড সই করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম দিকে এই যুদ্ধ ছিল মূলত অনিয়মিত গেরিলা আক্রমণের মতো। অস্ত্রধারী উপজাতিরা একের পর এক কাশ্মীরের ভিতরে ঢুকে পড়ে, তাদের লক্ষ্য ছিল শ্রীনগর দখল করা। ভারতীয় সেনা দ্রুত প্রতিরোধে নামে, কিন্তু কঠিন আর অচেনা ভূপ্রকৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সরবরাহ সমস্যার কারণে তারা শুরুতেই প্রবল চাপে পড়ে যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়— যেমন পুঞ্চ, উরি, জোজিলা এবং শ্রীনগরের উপকণ্ঠে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
এই দুঃসময়ে, যখন কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক অদ্ভুত দোলাচল তৈরি হয়েছিল, তখন কিছু ভারতীয় সেনার অসাধারণ সাহস এবং আত্মত্যাগ পরিস্থিতি বদলে দেয়। ছোট ছোট ইউনিটে থাকা তরুণ অফিসার ও সৈনিকরা, যারা অনেক সময় এক্কেবারে একা বা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন, তাঁদের বীরত্বই যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন মেজর সোমনাথ শর্মা, পরমবীর চক্র (মরণোত্তর) এই যুদ্ধের প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে প্রতীকী বীর হলেন মেজর সোমনাথ শর্মা, ৪ কুমায়ুন রেজিমেন্টের। ১৯৪৭ সালের ৩ নভেম্বর তাঁর ‘ডি’ কোম্পানিকে পাঠানো হয় শ্রীনগর বিমানবন্দরের কাছে বাদগাম গ্রাম রক্ষা করতে— যেটা ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট, কৌশলগত জায়গা। মজার কথা, তাঁর বাঁ হাত ভেঙেছিল তার ক’দিন আগেই, সেই সময় ভাঙা হাতে প্ল্যাস্টার করা ছিল, তবুও তিনি দায়িত্বে ছিলেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাহিনীকে। প্রায় ৭০০ উপজাতি আক্রমণকারী আর পাকিস্তানি সেনা আক্রমণ চালায় মাত্র ১০০ জন সৈনিকের ওই কোম্পানির ওপর, যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর শর্মা। তীব্র গুলি, মর্টার আক্রমণের মধ্যেও মেজর শর্মা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় দৌড়ে বেড়িয়েছেন, সৈনিকদের মনোবল জুগিয়েছেন, নিজ হাতে গোলাবারুদ বিতরণ করেছেন। শেষ মুহূর্তে, মৃত্যুর ঠিক আগে, তিনি হেডকোয়ার্টারে বার্তা পাঠান, “শত্রু মাত্র ৫০ গজ দূরে। আমরা প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে। আমি এক ইঞ্চিও পিছু হঠব না। শেষ মানুষ এবং শেষ গুলির আগ পর্যন্ত লড়ব।”
ওদিকে তখন দিল্লি আর ভারতের অন্য জায়গা থেকে সৈন্যবাহিনীকে কাশ্মীরে আনা হচ্ছে, জানতে পেরেছে পাকিস্তানিরাও, তারা প্রাণপণে চেষ্টা করছিল শ্রীনগর এয়ারপোর্ট দখল নেওয়ার। কিন্তু মেজর শর্মার সাহসিকতা শ্রীনগর বিমানবন্দর বাঁচিয়ে দেয়, এবং তিনি ভারতের প্রথম পরমবীর চক্র পান—মরণোত্তরভাবে। ওই একই যুদ্ধে নায়েক যদুনাথ সিং, পরমবীর চক্র (মরণোত্তর) পদক পেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, রাজপুত রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়নের নায়েক যদুনাথ সিং কাশ্মীরের নৌশেরা সেক্টরের এক গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে ছিলেন। তাঁর ছোট্ট দলের উপর একের পর এক আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রথম আক্রমণে তাঁর চারজন সৈনিক আহত হন। তারপরও তিনি সাহস হারাননি। নিজের হাতে স্টেন গান তুলে নিয়ে দ্বিতীয় আক্রমণ রুখে দেন। তাঁর ডান হাত তখন গুলিতে জখম, বাকিরা সবাই আহত। কিন্তু তিনি লড়াই থামাননি। স্টেন গান শেষ হয়ে গেলে, তৃতীয়বার শত্রু আক্রমণ করলে তিনি ছুটে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে আক্রমণ চালান এবং শত্রুদের পিছু হঠতে বাধ্য করেন। এইভাবে তিনবার লড়াই চালিয়ে তিনি প্রাণ দেন, কিন্তু তাঁর সাহসে সেই পোস্ট বেঁচে যায়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ধর্ম, আরএসএস, বিজেপি আর ২৫ বৈশাখ
আমরা বড় সেনানায়কদের গল্প শুনি, কিন্তু অজানা থেকে যায় বিভিন্ন সেক্টরে লড়তে থাকা এই জওয়ানদের আত্মত্যাগ। মেজর সোমনাথ শর্মা ও নায়েক যদুনাথ সিংয়ের আত্মত্যাগ ভারতীয় সেনার মধ্যে এক ধরনের ব্যাটল টু দ্য লাস্ট পয়েন্ট ‘শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়াই’ মনোভাব তৈরি করে। তাঁরা দেখিয়েছেন, কখনও কখনও যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এক বা দুই জনের সাহসে। তাঁদের গল্প শুধু ইতিহাস নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম আর বীরত্বের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। আজ শেষ করব ওই লড়াইয়ের আর এক গল্প দিয়ে, সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাস। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত তখন দেশভাগের ক্ষত আর এক প্রবল অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে, জম্মু ও কাশ্মীরকে ঘিরে পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, আগেই বলেছি। পাকিস্তান সমর্থিত পাঠান উপজাতি বাহিনী কাশ্মীর উপত্যকায় আক্রমণ শুরু করে এবং দ্রুত শ্রীনগরের দিকে এগোতে থাকে। এতদিন ধরে পাকিস্তানেও যাব না, ভারতেও যাব না, স্বাধীন হিসেবেই থাকব বলে জেদ করে বসে থাকা কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং এক চরম সংকটের মুখে পড়েন। তাঁর রাজ্য কার্যত অরক্ষিত ছিল এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন যে ভারতের সাহায্য ছাড়া কাশ্মীরকে বাঁচানো সম্ভব নয়, এটাও বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করে নিলে তিনি সর্বস্ব হারাবেন। তিনি সিগন্যাল পাঠান যে ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরণে তিনি রাজি। এই প্রেক্ষাপটে, ভারত সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে একটি উচ্চপর্যায়ের দলকে জরুরি ভিত্তিতে শ্রীনগরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এই দলে ছিলেন ভারত সরকারের রাজ্য দফতরের সচিব ভিপি মেনন, যিনি দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রধান কারিগর ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন কর্নেল (পরবর্তীতে ফিল্ড মার্শাল) স্যাম হরমুসজি ফ্রমজি জামশেদজি মানেকশ, যিনি তখন মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এবং পুরো পরিস্থিতিটা সামলানোর জন্যই সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে যাচ্ছিলেন। এছাড়াও এই দলে ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার দেওয়ান। ২৫ অক্টোবর, ১৯৪৭, এই দলটা ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি ডাকোটা (DC-3) বিমানে দিল্লির পালাম বিমানবন্দর থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা দেয়। শ্রীনগর বিমানবন্দরে যখন তাঁদের বিমান অবতরণ করে, তখন পরিস্থিতি অত্যন্ত থমথমে। শহর ঘিরে তখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। ভিপি মেনন এবং কর্নেল মানেকশ খুব তাড়াহুড়ো করেই মহারাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। দীর্ঘ আলোচনার পর, ২৬ অক্টোবর মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির দলিলে (Instrument of Accession) সই করেন। এই দলিলটাই ভারতের জন্য কাশ্মীরকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার এক আইনগত ভিত্তি তৈরি করে দেয়। কারণ এই দলিল অনুযায়ীই কাশ্মীর হয় ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
এই গোটা আলোচনাতে কর্নেল মানেকশ শুধু একজন নীরব দর্শক ছিলেন। কিন্তু দলিলে সই হয়ে যাওয়ার পরে তিনি দ্রুততার সঙ্গে শ্রীনগরের সামরিক পরিস্থিতি দেখেছিলেন, বুঝেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্য পাঠানোর জন্য পরিস্থিতি কতটা প্রতিকূল আর এটাও বুঝেছিলেন কীভাবে দ্রুততার সঙ্গে সৈন্য এনে আক্রমণকারীদের আটকানো যায়। কিন্তু সৈন্য আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দিল্লিতে সেই দলিলটা তো পৌঁছতে হবে, তাই সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি আসে অন্তর্ভুক্তির দলিল সই হওয়ার পর, সেই রাতেই দিল্লি ফেরার সময়। শ্রীনগর বিমানবন্দর তখন আজকের মতো আধুনিক ছিল না। বিশেষ করে রাতের বেলায় বিমান ওঠানামার জন্য প্রয়োজনীয় রানওয়ে লাইটিং বা অন্য কোনও পরিকাঠামো সেখানে ছিল না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর তার মধ্যেই এই গুরুত্বপূর্ণ দলটি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সেই ঐতিহাসিক দলিলটিকে নিরাপদে দিল্লি পৌঁছনো ছিল প্রথম কাজ।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন কাশ্মীরের তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ এবং তাঁর অনুগামীরা। স্যাম মানেকশ স্বয়ং পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার কথা নিজেই বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, সেই রাতে রানওয়েতে বিমান নামানোর জন্য, আলোকিত করার জন্য কোনও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল না। তখন শেখ আবদুল্লা, জিএম সাদিক, বকশি গুলাম মোহাম্মদ এবং ডিপি ধারের মতো স্থানীয় নেতারা তাঁদের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পাইন গাছের ডাল বা কাঠ জ্বালিয়ে মশাল তৈরি করেন। সেই মশাল জ্বালিয়ে তাঁরা রানওয়ের দু’পাশে দাঁড়িয়ে সেটিকে আলোকিত করে তোলেন। সেই মশালগুলির আলোতেই তাঁদের বিমানটি রাতের অন্ধকারে শ্রীনগরের মাটি ছেড়ে দিল্লির পথে রওনা হতে পেরেছিল। শোনা যায়, তখন রাত প্রায় ৩টে বা ৪টে বাজে। এই ঘটনাটা কেবল একটা রিস্কি প্লেন টেক অফের গল্প নয়, এটা ছিল এক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধির নিদর্শন। স্যাম মানেকশর জন্য এটা ছিল তাঁর বর্ণময় সামরিক জীবনের অসংখ্য কাহিনির একটা। আগেই বলেছি, এই ঘটনার পরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী আকাশপথে শ্রীনগরে পৌঁছয় এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বীরত্বপূর্ণ লড়াই শুরু করে।