আজ আলোচনা জগদীপ ধনখড় আর বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেকে নিয়ে। জগদীপ ধনখড় যিনি জোরে হাসতে গেলে বাঁধানো দাঁতের পাটি খুলে বেরিয়ে আসে এবং যিনি একজন আইনজীবী, যাঁদের মনে নেই তাঁদের মনে করিয়ে দিই ইনি সলমন খানের সেই মদ্যপ অবস্থায় ফুটপাথে গাড়ি তুলে মানুষ মারার মামলায় সলমন খানের পক্ষের উকিল ছিলেন। যাঁদের মনে নেই তাঁদের মনে করিয়ে দিই যে ইনি আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া প্রায় প্রত্যেক দল করেছেন, জনতা দল, কংগ্রেস দল সব দলেই উনি গেছেন বেরিয়েছেন এবং শেষমেশ বিজেপিতে। তো তিনি বলেছেন দেশের আইনসভাই হল সুপ্রিম, সর্বোচ্চ, তার উপরে কোনও কথাই চলতে পারে না। মানে খুব সোজা কথায় ১২ জুন, ১৯৭৫-এ এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারক ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছিলেন, তা আইনত সিদ্ধ নয়, কারণ ইন্দিরা গান্ধী সেদিনেও সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই সরকারে ছিলেন। কী আশ্চর্য! ওনার কথা বলার মানে হল যাঁরা এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসবে তারা যা খুশি তাই করতে পারবে। অনেকে বলেন এই লোকটি আহাম্মক, আমি বলছি না কিন্তু তিনি যাই হোন, তাঁর এই ধারণা প্রজাতন্ত্রের নয়, এক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কথাই তিনি বলছেন, আমাদের দেশ প্রজাতন্ত্র। অন্যজন হলেন নিশিকান্ত দুবে, যিনি অনায়াসে সংসদে বসেই সংখ্যালঘু সাংসদকে অশালীন গালিগালাজ করতেই পারেন, তো সেই তিনিও বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত কি সংসদের চেয়েও বেশি পাওয়ারফুল? এবং তারপর আরও একটু এগিয়ে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালতের চিফ জাস্টিস দেশে গৃহযুদ্ধ লাগানোর তালে আছেন। আসুন এই দুই রত্নের কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
এমন নয় যে এটা শুধু আমাদের দেশেই আছে, যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর চারটে মূল স্তম্ভ আছে। ১) আইন সভা: যেখানে মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন তৈরি করবে। গোটা দেশের জন্য লোকসভা, রাজ্যসভা আছে। রাজ্যের জন্য বিধানসভা, কোথাও কোথাও বিধান পরিষদ। ২) প্রশাসন: সেই আইন লাগু করবে, আইনমাফিক বিলি বন্দোবস্ত করবে। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, সংসদে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করবে, সরকারকে সেই খরচের খতিয়ান দেবে। তাঁদেরই এক অংশ পুলিশ, যদি মনে হয় কেউ বেআইনি কাজ করছে, আইন ভঙ্গ করছে তাহলে তা খতিয়ে দেখবে, প্রয়োজনে তা বিচারের জন্য হাজির করবে। ৩) বিচার ব্যবস্থা: যারা বিচার করবে, আইন প্রয়োগে স্বাধীনভাবে রায় দেবে। নাগরিক আর রাষ্ট্রের বিবাদে নিরপেক্ষ বিচার করবে। ৪) সংবাদমাধ্যম: যারা এই তিন স্তম্ভের কাজ নিয়ে লিখবেন, সমালোচনা করবেন, সমর্থন করবেন, প্রয়োজনে জনসমর্থন তৈরি করবেন। এই চারটে স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
আর এই চারটে কাঠামোই স্বাধীনভাবেই তাদের কাজ করবে, অন্তত করার কথা। এক আইডিয়াল ডেমোক্রাটিক স্টেটে এই চারটে স্তম্ভ স্বাধীনভাবেই কাজ করবে এটা ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট প্রশ্ন থেকেই গেল। এই চার স্তম্ভের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কে? কার হাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা। বার বার এই বিবাদ প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতে এসেছে, এবং প্রত্যেকবার শেষমেশ একটাই উত্তর এসেছে, না এই চার স্তম্ভের কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়, কেউ একে অন্যের উপরে খবরদারী করতে পারে না কারণ এদের সবার উপরে আছে সংবিধান, প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রজাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে যখন তার এক সংবিধান থাকে, আর সেই সংবিধান মেনেই সেই রাষ্ট্রের কাজ চলে, এই চার স্তম্ভকেই ওই সংবিধান মেনেই কাজ করতে হয়। উদাহরণ দিয়ে বলি, ধরুন একটা আইনে আছে যে কেউ ধার্মিক উত্তেজনা ছড়াতে পারে না, অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করতে পারে না। ধরা যাক সরকারে যে দল আছে সেই দলেরই একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি সেই কাজটা করছে, সেক্ষেত্রে কি তাকে প্রশাসন ছেড়ে দেবে? না, প্রশাসন আইন মেনে কাজ করবে, তাকে গ্রেফতার করবে এবং আদালতে পেশ করবে, আদালত আইন মেনেই তার বিচার করবে, আর গোটা পদ্ধতিতে কে শক্তিমান? কার হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা? সংবিধানের হাতে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চীনে এবার চিচিং ফাঁক
আবার এমনও তো হতেই পারে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলেই এক দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়েই এমন আইন পাশ করে দিল। যেখানে এক ধর্মের লোক বা সংখ্যাগুরু ধর্মের লোকজন অনায়াসেই সংখ্যালঘু ধর্মের লোকজনদের উপাসনা স্থল ভেঙে ফেলতেই পারে, তাদেরকে সংখ্যাগুরুদের ধর্ম পালনের আদেশ দিতে পারে। হ্যাঁ, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এমন আইন পাশ তো করাই যায়, কিন্তু তা নিয়ে কেউ আদালতে গেলে আদালত তা খতিয়ে দেখে সেই আইনকে বাতিল বলে ঘোষণা করতেই পারে। এক্ষেত্রেও খেয়াল করুন আসলে সর্বশক্তিমান কিন্তু ওই সংবিধান, যা ধ্রুবতারার মতো আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোকে দিক নির্দেশ করছে। কিন্তু, হ্যাঁ এখানে কিন্তু আছে, আছে কারণ এই সংবিধান তো এক লিখিত দলিল, তার বহু অধ্যায়, বহু অনুচ্ছেদ, ওদিকে দণ্ড সংহিতা, সেই আইনেরও বিভিন্ন ধারা আর তার সবটাই সেই সংবিধানের অনুচ্ছেদের, সেই আইনের ধারার ব্যখ্যার উপর নির্ভর করে। আর সেখানেই বিরাট সমস্যা তৈরি হয়। এবারে সমস্যা দুটো জায়গা থেকে শুরু হয়েছে। ১) ওয়াকফ বিল। ২) রাজ্যপাল সংক্রান্ত কিছু মামলা থেকে। ওয়াকফ বিল সংসদে পাশ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাই পাশ হয়েছে, কিন্তু ওই যে বললাম, সেই আইন সংবিধান সম্মত কি না সেই আইন সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে কি না তাই নিয়ে বেশ কিছু আপিল জমা পড়েছে। এবং মামলার বিচারের শুরুতেই সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে যে এই মামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ওই যে আইন পাশ করানো হল তার বেশ কিছু ধারা লাগু হবে না।
যেমন ওয়াকফ কমিটিতে অমুসলমান নিয়োগ বন্ধ থাকল, ইন ফ্যাক্ট আদালত জিজ্ঞেস করেছে সরকারকে যে তিরুপতি মন্দির ট্রাস্টে কি মুসলমান আধিকারিক রাখা সম্ভব? আদালত আপাতত যে সব জায়গাতে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে ডিসপিউট আছে সেগুলোও যেরকম আছে সেরকমই থাকবে বলে জানিয়েছে। এ তো গেল ওয়াকফ বিল মামলা। ওদিকে বিভিন্ন অবিজেপি রাজ্য সরকারের অভিযোগ হল রাজ্যের রাজ্যপাল বিধানসভাতে পাশ হয়ে যাওয়া বিলগুলোকে ফেলে রেখেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছেও আটকে আছে। সেগুলো নিয়ে কিছু করা হোক, সেগুলোকে একটা সময়ের মধ্যে অনুমতি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা হোক। তা না হলে নির্বাচিত রাজ্য সরকার বিল পাশ করাবে আর রাজ্যপাল সেটাকে আটকে রাখবে এই বা কেমন কথা। এসব মামলার বিচারের শুরুতেই সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে এরকমটা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। রাজ্যপাল বিল ফেলে রাখলে চলবে না, রাষ্ট্রপতির কাছেও যদি তিন মাসের বেশি বিল পড়ে থাকে তাহলে তার একটা কারণ দেখাতে হবে। এই রায়ের পরেই দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় প্রায় বিজেপি নেতার ভূমিকায় নেমে পড়েছেন, ওনার বক্তব্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে আইন পাশ করেছে তা সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে আটকাতে পারে? সুপ্রিম কোর্ট কি সংসদের চেয়ে বড়? ওদিকে এক দুর্মুখ আছেন, আগেই বলেছি নিশিকান্ত দুবে, তিনি বলেছেন চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া দেশে গৃহযুদ্ধ লাগানোর চেষ্টা করছেন, আর্বান নকশাল বলেননি, এটাই তো যথেষ্ট। তিনি দেশের প্রধান বিচারপতিকে গৃহযুদ্ধ লাগাচ্ছেন বলার পরেই বিজেপির দুধুভাতু সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছেন, এটা দলের মতামত নয়, দল ওনার এই কথাকে সমর্থন করছে না।
তার মানেই হল এতদিনে এই নিশিকান্ত দুবের ভাগ্য ফিরল। কারণ দল থেকে এরকম ভৎর্সনার পরেই সাধারণত বিজেপি দলের সেই নেতাকে মন্ত্রী ইত্যাদি করা হয়, গিরিরাজ সিং বা নীতেশ নারায়ণ রানে বা অনুরাগ ঠাকুর ইত্যাদির কেরিয়ার গ্রাফটা দেখে নিন। অত্যন্ত কটু কথা বলার পরে দলের নিন্দা করার কিছুদিনের মধ্যেই এনারা মন্ত্রী হয়েছেন। তো যাই হোক এই যে বিতর্ক ধনখড় সাহেব বা এই দুর্মুখ নিশিকান্ত দুবে তুলে দিলেন, বলা ভালো খুঁচিয়ে ঘা করলেন, তার পরিণাম খুব ভালো হবে না, ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। বিরোধী শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে একটা মিছিল, একটা মিটিংয়ের জন্যেও বিজেপি নেতারা আদালতের আছে যাচ্ছেন এবং জাদুবলে রায় নিয়ে আসছেন সে সবই কিন্তু এবারে প্রশ্নের মুখে পড়বে। আর সারা দেশে অবকি বার ৪০০ পার বলার পরে সংবিধানটাকেই বদলে দেওয়ার চেষ্টার ফল কী হয়েছিল মনে নেই? ৩০৩ থেকে সংখ্যালঘু ২৪০-এ আছে বিজেপি। কাজেই সারা দেশে আবার এই সংবিধান বিরোধী কথা মানুষকে বিপক্ষে নিয়ে যাবে আর বিরোধী রাজ্যগুলোতে অবিজেপি দলেরা এবার আদালতের বিরুদ্ধে কথা বলার একটা লাইসেন্স তো অন্তত পেয়ে গেল। বিধানসভায় পাশ করা বিলকে আটকে রাখা এরপর আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে, আজ নয় সেই কবেই আমাদের বিধানসভা রাজ্যের নাম বদলের বিল পাশ করে পাঠিয়ে রেখেছে, হ্যাঁ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নির্বাচিত সরকারই সেই বিল পাশ করিয়েছে, এখনও কেন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায়ে নির্বাচিত সরকারের বিল দিল্লির সরকারের সম্মতি পেল না? রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেল না? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু এবারে উঠবে, তুলে দিলেন কে? মাননীয় জগদীপ ধনখড়, যিনি জোরে হাসতে গেলে বাঁধানো দাঁত খুলে বেরিয়ে আসে।