আমেদাবাদে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে কংগ্রেস নেতারা বসে আলোচনা করছেন, কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়? কোথায় আছে সেই ঘুরে দাঁড়ানোর চাবিকাঠি। সিপিএমও এই ঘুরে দাঁড়ানোর খোঁজ খবর চালিয়ে যাচ্ছে গত ১০ বছর ধরে। কিন্তু সিপিএম আর কংগ্রেসের একটা তফাৎ আছে, সিপিএম তার ক্ষয়কে রোধ করতে পারেনি, কংগ্রেস যেভাবেই হোক অবিরাম ক্ষইতে থাকার যে প্রবণতা, সেখানে খানিকটা হলেও ব্রেক দিতে পেরেছে। আমরা কংগ্রেসের সেই জেনিথ, সেই চূড়া থেকেই হিসেবটা একবার দেখে নিই। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পরে ৮ম লোকসভায় ৫৪৩টা আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪১৪, ভোট শতাংশ ছিল ৪৯.১০ শতাংশ সেই চূড়া থেকেই পতনের শুরু। ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসের আসন কমে ১৯৭-এ নেমে আসে এবং ভোট শতাংশ হয় ৩৯.৫৩ শতাংশ। ১৯৮৪-এর তুলনায় ২০০-র বেশি আসন এবং প্রায় ১০ শতাংশ ভোট হারায়, এবং তারপর থেকে ক্রমাগত শক্তিক্ষয় আর রক্তক্ষরণ দেখেছি আমরা। এরপর থেকে কেন্দ্রে জোট সরকারের যুগ শুরু হয়। ১৯৯১-এ আসন বেড়ে ২৪৪ হলেও ভোট কমে ৩৬.২৬ শতাংশ হয়। রাজীব গান্ধীর হত্যার পর সহানুভূতি ভোট তাদের কিছুটা সাহায্য করে। ১৯৯৬ সালে আসন কমে ১৪০-এ এবং ভোট ২৮ শতাংশ, এই প্রথম কংগ্রেসের জাতীয় ভোট শতাংশ ৩০ শতাংশের নীচে নেমে গেল, যা স্বাধীনতার পর প্রথমবার। ১৯৯৮-এ ১৪১ আসন এবং ২৫.৮২ শতাংশ ভোট পায়। মানে আসন প্রায় এক থাকলেও ভোট আরও কমল। ১৯৯৯-এ আবার ভোট খানিকটা বেড়ে ২৮.৩০ শতাংশ হলেও আসন কমে ১১৪-এ নামে, যা সেই সময়ে কংগ্রেসের কম আসনের রেকর্ড। ২০০৪-এ ১৪৫ আসন এবং ২৬.৫৩ শতাংশ ভোট, মানে আসন বাড়ল কিন্তু আবার ভোট কমল, আর তাই নিয়েই কংগ্রেস ইউপিএ গঠন করে সরকারে আসে। ২০০৯-এ ২০৬টা আসন এবং ২৮.৫৫ শতাংশ ভোট পায়, যা ১৯৯১-এর পর সবচেয়ে ভালো ফল। মনে করা হয়েছিল কংগ্রেস সম্ভবত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু ২০১৪-এ মাত্র ৪৪ আসন এবং ১৯.৩১ শতাংশ ভোট পায়, যা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ। ২০১৯-এ ৫২ আসন পেলেও ভোট প্রায় একই থাকে ১৯.৪৯ শতাংশ। ২০২৪-এ ৯৯ আসন আর ২১.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তারা কিছুটা ভালো করে, এবং বলা হচ্ছে কংগ্রেস নাকি তার ক্ষয় আটকাতে পেরেছে, মানে তার ভোট ওই ২০ শতাংশের তলায় আর নামবে না।
ওদিকে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থার ছবিটাও একবার দেখে নিন–
উত্তরপ্রদেশ: ১৯৮৫-এ ২৬৯ আসন ভোট শতাংশ ৩৯.২ শতাংশ থেকে ২০২২-এ ২ আসন ভোট শতাংশ ২.৩৩। আর এই পতন কাদের কারণে? আসলে বিজেপি কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের ভোট, এসপি, বিএসপি কেড়েছে নিম্নবর্ণ আর মুসলমান ভোট। সব মিলিয়ে কংগ্রেস এখন ইউপিতে প্রান্তিক শক্তি।
মহারাষ্ট্র: ১৯৮৫-এ ১৬১ আসন ভোট ৪৩.৪ শতাংশ থেকে ২০২৪-এ ১৬ আসন। একসময়ে কংগ্রেসের দুর্গ এই রাজ্যে এখন শিবসেনা, এনসিপি, বিজেপির বোলবালা।
বিহার: ১৯৮৫-এ ১৯৬ আসন ভোট শতাংশ ৩৯.৩ থেকে ২০২০-এ ১৯ আসন আর ভোট শতাংশ ৯.৬। এখানে আরজেডি, জেডি(ইউ) তাদের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামিয়েছে।
তামিলনাড়ু: ১৯৮৪-এ ৭৩ আসন ভোট শতাংশ ১৬.৩ থেকে ২০২১-এ ১৭ আসন ভোট শতাংশ ৪.৩। ডিএমকে, এআইএডিএমকের উত্থানের ফলেই কংগ্রেস পিছিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ: ১৯৮৭-এ ৪০ আসন থেকে ২০২১-এ ০ আসন। এ রাজ্যে কংগ্রেসের যা ছিল তা তৃণমূলের কাছেই গেছে, আর বাকিটা সিপিএম-এর হাত ধরতে গিয়ে হারিয়েছে।
একই অবস্থা অসম, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশে। মোদ্দা কথা হল সারা দেশে কংগ্রেসের সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে যে পতন তাকে এক গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির তলানিতে এসে ঠেকা বলাই যায়। কিন্তু কী আছে? আছে যা তাও কম নয়, সারা দেশে কংগ্রেসের প্রতিটা রাজ্যে, প্রতিটা জেলায়, প্রতিটা ব্লকে কর্মী আছে, সমর্থক আছে, যা অন্য কোনও দলের নেই, সারা দেশের বিজেপি বিরোধী দলগুলো দুই অঙ্কের ভোট শতাংশ পায় না, কংগ্রেস সেখানে ২১ শতাংশ ভোট পায়, এবং এটাই তার বেস লেভেল বলেও মনে করা হয়, মানে এখান থেকে পতন হবে না। দুই হল এক ভারতের ভাবনা, আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া, একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, এক মুক্ত চিন্তার দেশ, এক মুক্ত বাণিজ্যের দেশ যা রাষ্ট্রের পরিচালনায় চলবে। এক সংবিধান, এক বহুস্বরের রাজনীতি, এই যে ধারণা এটা কংগ্রেসের আছে, এখনও কংগ্রেস এর প্রত্যেকটা বহন করে, কোথাও কোথাও বিচ্যুতি তো আছে, কিন্তু একটা বেসিক আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া বহন করে এই গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি। আর আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের লিগাসি, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকার, কারণ গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, সুভাষ, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের এক সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস এই গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি বহন করে। তাহলে অসুবিধে হল কোথায়? কেন কংগ্রেস পিছিয়ে পড়ল?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এক উন্মাদ ট্রাম্পের জন্য বিশ্বের অর্থনীতি বিপন্ন, বিশ্ব বিপন্ন
১) আঞ্চলিক দলের উত্থান: তৃণমূল, তেলুগু দেশম, বিজেডি, এইরকম স্থানীয় দলগুলো তাদের আইডেন্টিটি পলিটিক্স দিয়ে রাজ্যের বিষয়ে কথা বলার অধিকার করে নিয়েছে যা আদতে কংগ্রেসের জমি জায়গা কেড়ে নিয়েছে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রী লালু, মুলায়মরা কংগ্রেসের নিম্নবর্ণের ভোট, সংখ্যালঘু ভোট কেড়ে নিয়েছে।
২) বিজেপির শক্তি: হিন্দুত্ব নিয়ে বিজেপি অনেক ভোটারকে টেনেছে, এক বিশাল সংখ্যক হিন্দু মানুষ কংগ্রেসকে হিন্দু বিরোধী হিসেবে মনে করেছে আর কংগ্রেস তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে গেছে।
৩) সমাজ-অর্থনীতির পরিবর্তন: নতুন মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের চাহিদা কংগ্রেস পূরণ করতে পারেনি, রাজীব গান্ধী তরুণদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, হঠাৎই নরসিমহা রাও বা মনমোহন এসে তাকে এক খোলাবাজারের অর্থনীতির দিকে টেনে নিয়ে গেল, যা জন্ম দিল নতুন চাহিদার, সেই চাহিদা কংগ্রেস মেটাতে পারেনি।
৪) নেতৃত্বের সমস্যা: শক্তিশালী নেতার অভাব, দলের ভিতর ঝগড়া, এবং দুর্বল সংগঠন তাদের ক্ষতি করেছে। তার সঙ্গে জুড়েছে বিভিন্ন বড় বড় ইস্যু, মণ্ডল কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার, রাম জন্মভূমি আন্দোলন যা ভোটারদের অন্য দিকে টেনে নিয়ে গেছে। কংগ্রেসের এখনকার নেতৃত্বকে দেখলে মনে হবে যে তাঁরা কোনও কিছুর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন, মানে কখন বিজেপি একটা প্রকাণ্ড ভুল করে বসবে, কখন জাতীয় স্তরে অর্থনীতিতে এমন এক অবস্থার জন্ম নেবে যা এই সরকারের ভিত্তিভূমি কেড়ে নেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে বিজেপি নিজেই ডুববে, আর সেই বিজেপির পতনের পরে আবার কংগ্রেস ফিরে আসবে, আপাতত ক্রিজ ধরে খেলে যাও, সুযোগের আশায় বসে থাকো। মাঝেমধ্যে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির সেই চেহারা যাতে মানুষ না ভুলে যায়, তার জন্যই রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ইমেজ বাড়ানোর জন্য কিছু কর্মসূচি নাও। এই কাজ তাঁরা মন দিয়ে করছেন। এটা ঘটনা যে বিজেপির মধ্যে এক ধরনের ক্ষয় শুরু হয়েছে, দলের সেই পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স-এর বদলে আর পাঁচটা পার্টির মতোই বিভিন্ন দুর্নীতিতে ওনাদের নাম আসছে, এক বিরাট টিম ওয়ার্কের বদলে এক মোদি তাঁর লার্জার দ্যান লাইফ ছবি তৈরি করে বাকিদের উচ্চতা কমিয়ে দিচ্ছেন। কাজেই বিজেপির তেমন এক দুর্দিন আসতেই পারে, আর সেটার জন্যই নাকি অপেক্ষা করে আছেন রাহুল গান্ধী। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতি তেমন নয়, এসব ইউরোপে চলে, শাসক শাসন করে, বিরোধী দল শাসকের ভুলগুলোকে তুলে ধরে মানুষকে বোঝায়, ক্ষমতার বদল হয়।
আমাদের দেশের রাজনীতির ধরন অ্যাসার্টিভ, বিরোধী দলকে ক্রমাগত আন্দোলন, বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের মাধ্যমেই নিজেদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে আর সেই মানুষেরা পরিবর্তন আনবেন। বাইডেনের সারা রাজত্বকালে ক’বার ট্রাম্প কোন আন্দোলন করেছেন? জার্মানির বিরোধী দলনেতা আজ চ্যান্সেলর, ক’টা আন্দোলনে ছিলেন? কিছু সেমিনার, টিভি ডিবেট ইত্যাদিতে ছিলেন। আমাদের দেশে? জরুরি অবস্থার বিরোধিতা, রাম মন্দিরের আন্দোলন, দাঙ্গার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, আদবানি, মমতা প্রত্যেকে সেই ফায়ার ব্র্যান্ড রাজনীতিক যাঁরা ক্রমাগত লড়েছেন, পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের আইডিয়া অফ পলিটিক্স এখন রাহুলের হাতে, শেষ কবে রাস্তায় ছিলেন? ২০২৪-এ নির্বাচনের আগে পদযাত্রায়। এরমধ্যে হাজার একটা ইস্যু এসেছে, এই ওয়াকফ বিলের কথাই কি কম? এক কৃষক আন্দোলন মোদিজিকে বাধ্য করেছিল সেই কৃষি বিলকে ফেরত নিতে, কিন্তু ওয়াকফ বিল নিয়ে সেই রাস্তায় নামার কোনও প্রস্তুতি আছে? এখন আমেদাবাদে বসে রাহুল গান্ধীজি বলছেন আমাদের প্যাটেলের কথা বলতে হবে, প্যাটেল কংগ্রেসের ছিলেন, বিজেপির ছিলেন না। উনি এটা বলবেন আর বিজেপির সমর্থনে ৫ জন ঐতিহাসিক গবেষক কালকেই মাঠে নেমে দেখাবেন যে প্যাটেল নেহরুর কতটা সমালোচক ছিলেন, ব্যস হয়ে গেল, তারপরের দিন থেকে সেই যুক্তি বুলেট পয়েন্টে হোয়াটসঅ্যাপে চলে আসবে। কাজেই আপাতত কংগ্রেসের কাছে প্রথম কাজ হতে পারে–
১) রাস্তায় নামা: গ্যাসের দাম বৃদ্ধি থেকে বেকরের হার বৃদ্ধি থেকে ওয়াকফ বিল নিয়ে সংসদ ঘেরাও করা, দেশজুড়ে আন্দোলন তৈরি করা। ২) বন্ধু পেতে হবে, স্টেডি বন্ধু, একলাই কংগ্রেস লড়ে যাবে পাগলা জগাইয়ের মতো? তাহলে গায়ে ব্যথা হয়ে পড়ে থাকতে হবে। মাথায় রাখতে হবে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে আঁতাঁত করে বিজেপির উত্থান। ৩) নতুন মুখ আনতে হবে। সেই বৃদ্ধ, হেরো মুখ দিয়ে না হবে সংগঠন, না হবে লড়াই। ৪) কংগ্রেসের কোর কম্পিটেন্সির দিকে, আদত শক্তির দিকে নজর দিতে হবে, তা হল ১) উদার গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা। ২) এক সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ধারণা যা আমাদের সংবিধানেই আছে। ৩) এক কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা যা সামাজিক ন্যায়ের কথা বলে। ৪) এক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুক্তিবাদ, আধুনিক সভ্যতার উপর ভিত্তি করে নতুন ভারতের ধারণা। প্রথম তিনটে কংগ্রেসের আছে, কেবল তাকে সামনে আনতে হবে। আর শেষেরটা মানে ওই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুক্তিবাদ, আধুনিক সভ্যতার উপর ভিত্তি করে নতুন ভারতের ধারণাকে গড়ে তুলতে হবে, আরএসএস–বিজেপি, মোদি-শাহের মধ্যযুগীয় চিন্তার বিরুদ্ধে আজকে নতুন প্রজন্মকে এই অস্ত্র দিয়েই কাছে টানতে হবে। বিজেপি আর কংগ্রেস এই দুটো কেবল রাজনৈতিক দল নয়, এরা হল দুটো পরস্পর বিপরীতমুখী আইডিয়া, দুটো বিপ্রতীপ আদর্শ, কাজেই আপনি যদি বিজেপির এই মধ্যযুগের শাসনের অবসান চান তাহলে আপনাকে কংগ্রেসের আদর্শকে মাথায় রাখতেই হবে, সে আপনি বিজেপি বিরোধী যে দলেই থাকুন না কেন, ওই আদর্শ-ভিত্তি ছাড়া বিজেপিকে হারানো অসম্ভব।