রাহুল বলেছিলেন হাইড্রোজেন বোমা ফাটাবেন। মঞ্চে এসে জানালেন, হাইড্রোজেন বোমার প্রিপারেশন চলছে, কিন্তু মধ্যের এই সময়টাতে যা ফাটালেন তা খুব কম বা ছোট কিছু নয়। আওয়াজ তো হুয়া। সেই কবে ভগৎ সিং বলেছিলেন কালাদের, যারা কানে শোনে না তাদের শোনানোর জন্য বিরাট জোরেই শব্দ করতে হয়। হ্যাঁ সেই শব্দ কাল শোনা গেছে দেশ জুড়ে। গতকালও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘ভোট চুরির প্রমাণ’ তুলে ধরলেন রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi)। কেন্দ্রীয় ভাবে সফ্টঅয়্যার ব্যবহার করে নাকি ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। যা ধরা পড়ায় জানা গেছে পদ্ধতিটা কিন্তু এই পদ্ধতিতে আরও কত নাম সত্যিই বাদ পড়েছে তা জানতে তো সময় লাগবে। গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত এক অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মানুষ তাদের প্রতিনিধিকে পাঠাবে, যাঁরা দেশের আইন ঠিক করবে, বিকাশ, উন্নয়নের পথ, দিশা নির্ধারণ করবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে যে কোনও স্বৈরশাসকের প্রথম লক্ষ্যই হল এই নির্বাচন পদ্ধতিকে বানচাল করে দেওয়া। আগে যা হত কোনও কোনও জায়গায় বুথ দখল আর ভোট লুঠ করে এখন সেটাই আরও ব্যপক, আরও বিস্তৃত চেহারায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। এক নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের (Election Commission) বদলে এক জো হুজুরের দলকে বসিয়ে গোটা নির্বাচন পদ্ধতিকে এক প্রহসন করে তুলেছে। একে একে সেই প্রহসনের সব তথ্য মানুষের সামনে আসছে, মানুষ বুঝতে পারছেন যে এটা আমাদের নির্বাচিত সরকার নয়। এইখান থেকেই একরাশ সমস্যা উঠে আসছে।
রাহুল গান্ধী বললেন নির্দিষ্ট সফ্টঅয়্যারের মাধ্যমে নকল আবেদন করে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তার উদাহরণও দিলেন, “অলন্দ কর্নাটকের একটি লোকসভা কেন্দ্র। কেউ কেউ ৬০১৮টি ভোট মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন। আমরা জানি না ২০২৩ সালের কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক কত জনের নাম বাদ গিয়েছে। কিন্তু সংখ্যাটা অবশ্যই ৬০১৮-র বেশি হবে। সমস্ত সাংবাদিকদের সামনেই তিনি স্টেজের পেছনে থাকা স্ক্রিনে কয়েকটা ফোন নম্বর তুলে বললেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফর্ম পূরণ করে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে ওই নম্বরগুলি থেকে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) দেওয়া সম্ভব হল, সেই প্রশ্ন তোলেন রাহুল। একটু বুঝিয়ে বলি, যদি ইলেকশন কমিশনের মধ্যেই কিছু লোকজন আপনাকে সাহায্য করার জন্য বসেই থাকে, তাহলে আপনি আমার নামটাকে আপনার নাম বলে চালিয়ে বলতেই পারেন যে আমি তো আর এখানে থাকি না, কাজেই আমার নামটা ডিলিট করা হোক। এবার সাধারণত এই সফটঅয়ারে নাম ডিলিট করার আগে একটা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড পাঠানো হবে, আমার মোবাইলে সেটা এলোও, কিন্তু আমি তো এরকম আবেদন কিছু করিনি তাই আমি সেটা ইগনোর করলাম, এবারে সেই কমিশনের ভেতরে ঢুকে থাকা লোকটাই যদি ওই ওটিপিটা একজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়, তাহলেই কেল্লা ফতে, আমার নাম বাদ। হ্যাঁ দেখা যাচ্ছে সারা দেশ জুড়ে একটা নেটওয়ার্ক চলেছে, বিভিন্ন রাজ্য থেকে আলাদা আলাদা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ভোটার তালিকা থেকে নাম মোছার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
কিন্তু রাহুলেরই ভাষায় ধরা পড়ে গেল আর দশটা অপরাধ যেমন হঠাৎ করেই ছোট্ট কোনও ব্যাপার থেকে ধরা পড়ে যায় তেমনই এই অলন্দের জালিয়াতিটা শুরুতেই ধরা পড়ে গেল। একজন মহিলা ভোট কর্মীর আত্মীয়ের নামও বাদ পড়েছিল, সেটা দেখতে গিয়ে গোটা জালিয়াতিটাই সামনে আসে। এবার এমন তো হতেই পারে যে কিছু লোক বদমাসি করে কিছু নাম ডিলিট করার চেষ্টা চালিয়েছিল, যদিও ৬০০০ এর বেশি ভোট একটা বিধানসভা কেন্দ্রে, তাও আবার অলন্দের মত কেন্দ্রে যেখানে আসন বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়েছে সামান্য ভোটে, সেখানে বেশ বড় ব্যাপার। কিন্তু এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতেই পারতো। কিন্তু না এরপরেই গোটা অভিযোগটা কেন নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে সেটাও বুঝুন, কর্ণাটক ভোটের আগে এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে, মানে ২০২২ সালে। তো কমিশন কী করছিল? তারা কি এই দু বছরে খুঁজে বার করেছে, কারা এই কাজের পেছনে আছে? রাতের দিকে একটা বিবৃতি দিয়ে কমিশন জানিয়েছে, কর্নাটকের অলন্দ বিধানসভা এলাকায় ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়ার জন্য ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অনলাইনে প্রায় ৬০১৮টা আবেদন জমা পড়েছিল। এত বেশি সংখ্যক আবেদন সন্দেহজনক মনে হওয়ায়, প্রতিটা আবেদন খুঁটিয়ে দেখে কমিশন। দেখা যায় মাত্র ২৪টা আবেদন সঠিক। ৫৯৯৪টা আবেদন ভুয়ো। তাই শুধু ওই ২৪টা গ্রহণ করে বাকি আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে কমিশন। কিন্তু কমিশন এই খবর আগে তো কোথাও জানান নি, সাংবাদিক সম্মেলন করেই নির্বাচন কমিশনের এই বিরাট কৃতিত্বের কথা ওনারা জানাতেই পারতেন। না ওনারা জানান নি। উল্টে তথ্য প্রমাণ দিয়েই রাহুল গান্ধী জানাচ্ছেন ‘ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া’ সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কর্নাটকের সিআইডি কমিশনকে ১৮ বার চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু উল্টো দিক থেকে কোনও উত্তর মেলেনি। তো কমিশনের মাথায় বসে আছেন নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার, স্বাভাবিকভাবেই ‘ভোট চুরি’র অভিযোগের সূত্রেই রাহুল আক্রমণ করলেন নির্বাচন কমিশন এবং দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে। “দেশে স্বচ্ছ এবং অবাধ নির্বাচনের বিষয়টি সুনিশ্চিত করার বদলে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে নির্বাচন কমিশন। যাঁরা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে খর্ব করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জ্ঞানেশ কুমারজি ভোট চুরিকে রক্ষা করছেন। এটা নিয়ে এখন আর কোনও সংশয় নেই। হ্যাঁ এই কথাগুলো রাহুল গান্ধির। এই কনফারেন্সের পরে নির্বাচন কমিশন কী জানালেন? ১) জানিয়েছেন যে হ্যাঁ অলন্দে এরকম একটা চেষ্টা হয়েছিল যা ধরা পড়ে। ২) জানান নি যে ২০২২ থেকে আজ অবদি সমস্ত তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন এই ঘটনার পেছনের দোষীরা ধরা পড়েনি। ৩) জানান নি যে কোন চাপে পড়ে, কার নির্দেশ পালন করেই এই অপরাধের সম্পুর্ণ তথ্য কর্ণাটক সি আই ডি র হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না। কোন পদ্ধতিতে এই কাজ করা হচ্ছে? রাহুল বলেছেন “একটা সফ্টঅয়্যার বুথের ভোটার তালিকায় থাকা প্রথম নামটা বেছে নিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কেউ এই কাজ চালাচ্ছেন। তিনি কেবল নিশ্চিত করছেন এটাই যে, আবেদনকারী যেন বুথের প্রথম ভোটার হন। তার পর নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা করা হচ্ছে। এটা সাধারণ কর্মীদের কাজ নয়।”
সন্দেহ তো আরও বড় হতে বাধ্য যখন দেখা যাচ্ছে যে কর্নাটকের যে ১০টা বুথে সবচেয়ে বেশি ভোটারদের নাম কাটা গিয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। এখানে ডিলিশন মানে নাম কাটার ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের রাজুরা বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা তুলে ধরে রাহুলের দাবি, সেখানে অনলাইনে ৬৮৫০ জন ভোটারের নাম অবৈধ ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যেই ভোটার তালিকায় এই সংযোজন-বিয়োজন চলছে। রাহুল গান্ধির অভিযোগে মূল বিপজ্জনক জায়গাটা কী? সেটা আগেই বলেছি, ভোট চুরি করতে গেলে আর রিগিং, বুথ দখল করতে হবেনা। এমনকি যা করতে হবে, তাতে খুব বেশি হইচইও হবেনা। একটা ৫/৭ হাজারের কমিটেড বাহিনী হলেই চলবে, তারাই সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন ভোটের সময়ে এই কাজটা চালিয়ে যাবেন। ধরুন একটা বিধানসভায় ৩ লাখ ভোট। জয়-পরাজয় হয় ধরুন ৫/৭ হাজারের ফারাকে। সেটা মোট ভোটের বড় জোর দু আড়াই শতাংশ। এরকম প্রচুর বিধানসভা আছে। আমাদের এই বাংলাতেই আছে। এবার আপনি যদি এক পক্ষের ৩ শতাংশ ভোট কমিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই কেল্লা ফতে, আপনার হাতে এক্সট্রা টু এ বির মত গোতা ২৫/৩০ আসন। মানে ১০০ জনে ৩ জন বাদ যাবে। ৫ করতে পারলে তো জয় বড় ব্যবধানে। ধরুন একটা বিধানসভায় ১০০০ বুথ। তার মধ্যে ৫০০ ধরুন একটা দলের দিকে ঝুঁকে। প্রতিটা থেকে, মাত্র ২০ টা করে লোক কমিয়ে দিতে পারলেই ১০০০০ ভোট কমে গেল। এটাই হল সেই সাইলেন্ট রিগিং। এতে হইচই কিচ্ছু হবেনা। ১০০টা লোক ভোট দিতে গেছে, ৫ জন দেখেছে নাম নেই। সে তো হতেই পারে। কিন্তু এই কাজ করাটা তো রামা শ্যামার কাজ নয়, যে সে করতে পারবেনা। বুথগুলো ঠিক করে বাছতে হবে। কোন বুথে কোনদিকে কত ভোট পড়েছে জানা দরকার। কোথায় বিজেপি বিরোধী দলের বেশি সমর্থন আছে সেটা জানা জরুরি। যে বুথে উল্টোদিকের প্রচুর ভোট পড়েছে, সেগুলোই চিহ্নিত করতে হবে, নইলে সব ঘেঁটে ঘ। এই তথ্য কার কাছে থাকে? নির্বাচন কমিশন। এটা গেল কেবল চিহ্নিত করা। তারপর হল বাদ দেওয়া। বাদ দিতে গেলে আবেদন করতে হবে। কারা সেই আবেদন মঞ্জুর করবে? নির্বাচন কমিশন। এটা একটা খুব পালিশ করা পদ্ধতি। ভোট-দখলের যে প্রথাগত পদ্ধতি, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটার উপর দাঁড়িয়েই ওরা ভেবেছিল চারশো পার হবে। অত আগে থেকে ৪০০ পারের শ্লোগান প্রধানমন্ত্রী নিজে সংসদে দিচ্ছিলেন কিসের ভরসাতে? এখন সেটা পরিস্কার। কিন্তু একবার বুঝুন জমিনি হকিকৎ, গ্রাউন্ড রিয়েলিটি তাহলে কী ছিল? অবস্থা এতই খারাপ ছিল, যে, এই ৩-৫% ভোট সরিয়েও ২৪০ পার করা যায় নি। কিন্তু জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানেশ কুমার। কারণ তো একটাই, এই কমিশনার তো বিজেপির রিক্রুট, প্যানেলে আছেন একজন প্রধানমন্ত্রী অন্যজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী আর নারায়ণ শিলার মত রাখা হয়েছে বিরোধী দলনেতাকে, যার কোনও মানেই হয় না, কারণ প্যানেল ২ – ১। কাজেই আমাদের উনিজি মনোনীত, উনিজি আশ্রিত, কমিশনার, কোনো আদালত যাঁকে জীবদ্দশায় স্পর্শ করতে পারবেনা বলেই তাঁর ধারণা তিনি অনায়াসেই কি এই ভোট চুরিটা বুক ফুলিয়ে চালিয়ে গেছেন। তা যদি সত্যিই হয়, তাহলে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে এর থেকে খারাপ আর কিছু হতেই পারেনা। হ্যাঁ এরকম অবস্থাতেই মানুষ রাস্তায় নামে, তারা চিৎকার করে, চোর চোর, ঐ যায় ভোট চোর, ভোট চোর। ধর ধর ঐ যায় ভোট চোর, ভোট চোর।