চার রাজ্যেই কংগ্রেস জিতলে, বা চারটের মধ্যে তিনটেতে জিতলে কোনও মিডিয়া বলতো না যে মোদি ম্যাজিক ফিনিস, বলতো না যে নিজের নামে ভোট চেয়েছেন মোদিজী, এবার ২০২৪ এ তঁর বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে, একজনও বলত না যে কংগ্রেস বার মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। মিডিয়া হারের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনা শুরু করতো এই বলে যে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট এক নয়, বলতো যে ২০১৮ তেও তো কংগ্রেস জিতেছিল, ২০১৯ এ বিজেপি তাদের হারিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু চারটের মধ্যে তিন রাজ্যে অনায়াস জয়ের পরেই বলা শুরু হয়েছে মোদি ম্যাজিকের কথা, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, কেবল তাই না এই জয় যে আসলে ২০২৪ এর জয় কে আরও সুদৃঢ় করলো তা ব্যাখ্যা করছে চ্যানেলে চ্যানেলে বসা উচ্ছিষ্টভোগী পন্ডিতেরা। এবং তার চেয়েও বড় মজার কথা হল থমকে গেছেন সেই সব মানুষ যাঁরা বিজেপির হার চাইছিলেন, যাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান চাইছিলেন, এঁদের অনেকেই ভাবছেন তাহলে এই ধর্মনিরপেক্ষতা, কদিন আগেকার নফরত কি বাজার মে মহব্বত কি দুকান খোলও ইত্যাদি কি তাহলে নিছক বাওয়াল, তাহলে কি দেশ শুদ্ধু মানুষ বিজেপির ঐ সাম্প্রপদায়িক আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদের এজেন্ডাকেই সমর্থ করেছেন? ঠিক এইরকম একটা সময়ে একটা ঠিক ঠাক বিশ্লেষণ জরুরি, অবস্থা টা আসলে কী, সেটা না জানলে তার পরিবর্তনও করা যায় না, কিভাবে পরিবর্তন সম্ভব সেটা জানাও সম্ভব হয় না। আসুন আমরা বরং সরাসরি ফলাফল নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করি। প্রথম যে কথা সেটা হল কংগ্রেস কে কি মানুষ প্রত্যাখ্যান করলো? এই চার রাজ্যে তো মূলত কংগ্রেসই লড়েছে বিজেপির সঙ্গে, সেই দলকে কি মানুষ মুখের ওপর না বলে দিল? এককথায় উত্তর, না। কংগ্রেস ২০১৮ তে যত ভোট পেয়েছিল, এবারে চার রাজ্যের ভোট মেলালে কিছুটা বেশিই পেয়েছে কম নয়। আপনি বলবেন স্ট্যাটিসটিক্স এর জাগলারি, সংখ্যাতত্বের নাচন কোঁদন।
তাহলে আসুন দেখা যাক, রাজস্থানে কংগ্রেসের কত ভোট ছিল ২০১৮ তে? ৩৯.৩০%, এবারে? কংগ্রেস পেয়েছে ৩৯.৫৩% ভোট। ভোটদানের হারে সামান্য বৃদ্ধি ধরলে সেটা আরও খানিক বেড়েছে। ২০১৮ তে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৪০.৮৯%, এবারে তা দাঁড়িয়েছে ৪০.৪০%। ঐ ২০১৮ তে ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৪৩%, এবারে তা সামান্য কমে ৪২.২৩% হয়েছে এবং তেলেঙ্গানাতে ২০১৮ তে কংগ্রেসের ভোট ছিল ২৮.৪%, এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৪%, মানে ১১% এর বৃদ্ধি। তারমানে কংগ্রেসের যে ভোট ছিল, তা হয় একই আছে, নাহলে বেড়েছে, কমেনি। তাহলে? বিজেপির ভোট বেড়েছে, বিরাটভাবেই বেড়েছে, ছত্তিশগড়ে ২০১৮ তে বিজেপির ভোট ছিল ৩৩%, এবারে ১৩% এরও বেশি বেড়েছে, তা এসে ঠেকেছে ৪৬.২৭% তে। মধ্যপ্রদেশে ভোট ছিল ৪১.০২%, এবারে হয়েছে ৪৮.৫৫%, ৮.৯৫% বৃদ্ধি। রাজস্থানে ছিল ৩৮.০৮%, হয়েছে ৪১.৬৯%, প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি তেলেঙ্গানাতেও, যেখানে তারা মাত্র ৮ টা আসন পেয়েছে সেখানেও মাত্র ৫ বছর আগে ভোট ছিল ৬.৯৮%, এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩% তে, ৬% বৃদ্ধি। তাহলে মোদ্দা কথাটা হল কংগ্রেসের ভোট কমেনি, বিজেপির ভোট বেড়েছে। তো এই ভোট এল কোথা থেকে? এই ভোট এসেছে বাকি ছোট ছোট দল আর নির্দল প্রার্থীদের কাছ থেকে মানে আদারস বলে যে ক্যাটাগরি আছে, সেখান থেকেই এবারে অক্সিজেন পেয়েছে বিজেপি, চার রাজ্যের আদারস, অন্যান্যদের ভোটের এক বিরাট অংশ নিয়ে তাদের ভোট বাড়িয়েছে বিজেপি, যেটুকু ভোট বেড়েছে, তা কিন্তু এসেছে ঐ অন্যান্যদের কাছ থেকেই।
রাজস্থানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বি এস পি, ভারতীয় আদিবাসী পার্টি, বেনিওয়ালের লোকতান্ত্রিক দল নিয়ে একটা কথাও খরচ করেছেন? অমন বিপ্লবী সি পি এম নিয়ে একটা কথাও বলেছেন? না বলেন নি, ইগনোর করেছেন, আক্রমণের প্রতিটা তীর ছিল কংগ্রেসের দিকে, লড়াইটাকে বাইপোলার করার দরকার ছিল, সেটাই করেছেন। ফল হাতে নাতে, মানুষ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপিকে দিয়েছে, বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে দিয়েছে, তেলেঙ্গানা ছাড়া এই বাইনারি তৈরির চেষ্টা কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক এর কোনও ক্ষতি করেনি, কিন্তু কংগ্রেস বিরোধী সমস্ত ভোট বা বিরাট অংশের ভোট গিয়ে পড়েছে বিজেপির ঝোলাতে। ছত্তিশগড়ে ২০১৮ তে অন্যান্যদের ভোট ছিল ২৪%, এবারে ১১.৫%, ঠিক এই ভোটটাই গিয়ে পড়েছে বিজেপির বাক্সে। মধ্যপ্রদেশে অন্যান্যদের ভোট ছিল ১৮%, এবারে তা কমে ১১.৫%, বিজেপির ভোট বেড়েছে ৭% এর কিছু বেশি। একইভাবে ২০১৮ তে রাজস্থানে ঐ ই এস পি, সি পি এম, লোকতান্ত্রিক পার্টি ইত্যাদি মিলিয়ে অন্যান্যদের ভোট ছিল ২২.৬২%, এবারে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭৮% আর বিজেপির ভোট বেড়েছে প্রায় চার শতাংশ, পুরোটাই এই ভোট। তেলেঙ্গানাতে বি আর এস এর ভোট অনেকটা কেটেছে বিজেপি, আর কেটেছে বলেই কংগ্রেসের আসন বেড়েছে, বি আর এস এর যে ভোট বিজেপি কেটেছে তা না কাটলে কংগ্রেস এখানেও জিততো না, যদিও তার নিজের ভোট বেড়েছে, কিন্তু কেবল সেই বৃদ্ধির জন্যও এই জয় আসে নি। অতএব বিজেপি, বি আর এস কোনও ধরণের সমঝোতা হলেই কংগ্রেস বিপদে পড়বে, লোকসভা নির্বাচনে সেটা হতেই পারে। কারণ বিজেপির এক এবং একমাত্র চাহিদা বেশি আসনের, আদর্শ গেছে গড়ের মাঠে ঘাস খেতে, আসন চাই, বেশি আসন চাই, এই নির্বাচনের পরেও তাঁরা জানেন, যে তুমুল মেরুকরণ তাঁরাই ঘটিয়েছেন, সেই মেরুকরণের রেশ এত সহজে কাটবে না। গতবারে এই চার রাজ্যে মোট ৮২ টা লোকসভার আসনের মধ্যে ৬৫ টা পেয়েছিল বিজেপি, এবারের বিধানসভার হিসেব ধরলে কি তাই পাবে? অসম্ভব। সেরকম ফল পেতে গেলে আরেকটা পুলওয়ামা চাই। অন্তত তেলেঙ্গানাতেই তাদের আসন কমবে। তাহলে হঠাৎ করে মোদি ম্যাজিক মোদি ম্যাজিক ইত্যাদি বলা হচ্ছে কেন? কারণ সামনে লোকসভা নির্বাচন। থাক সে কথা, সে আলোচনা পরে হবে।
এখন বরং এই আলোচনা করা যাক, কোন সামান্য ফেরবদল হলেই এই ফলাফল পালটে যাবে, অন্তত সামনের লোকসভার নির্বাচনেই বদলে যেতে পারে? ধরুন রাজস্থান, আপ, হনুমান বেরিওয়ালের লোকতান্ত্রিক দল, সি পি এম আর ভারতীয় আদিবাসী পার্টির সঙ্গে যদি একটা ঠিক ঠাক সমঝোতা হয়, কেবলমাত্র তাহলেই এই বিধানসভার নির্বাচনেই কংগ্রেস জিতে যেত এমন বলছি না কিন্তু লড়াই এর মধ্যেই থাকতো এটা তথ্য বলছে। বাপ, মানে ঐ ভারতীয় আদিবাসী পার্টি অন্তত ১০ টা আসনে কংগ্রেসকে হারিয়েছে আর নিজেরা ৩ টে আসনে জিতেছে, মানে আল্যায়েন্স হলে কমবেশি ১০ টা আসন যোগ হত, সি পিএম দুটো আসনে হেরেছে, কংগ্রেসের ভোট যোগ দিলেই সেটা জিতে যেত অনায়াসে। এবং বেরিওয়ালের দল একটা আসন পেয়েছে, তাদের কে সঙ্গে নিলে খান দুই আসন আরও বাড়তো। কিন্তু কংগ্রেসের মনে হয়েছে এক ঐ চিরঞ্জিবী প্রকল্পই ওনাদের জিতিয়ে দেবে, খয়রাতি ভোট আনে কিন্তু একবার তো ভাবা উচিত খয়রাতি মোদি – শাহ যতটা করতে পারবেন, ততটা কি রাজ্যের পক্ষে করা সম্ভব? ঐ খয়রাতির লড়াই এর একটা সীমা আছে। একই হিসেব ছত্তিসগড়ে, সেখানে প্রাক্তন কংগ্রেস মূখ্যমন্ত্রী অজিত যোগীর ছেলে, সি পি আই এবং আরও কিছু দল মিলে জোট বেঁধে কম করে ৭ টা আসনে কংগ্রেসকে হারিয়েছে, আবার এক শক্তপোক্ত বাইনারির ফলেই তাদের ভোট চলে গেছে বিজেপির কাছে। মধ্যপ্রদেশে সমাজবাদী দল, আপ এর সঙ্গে কথাই বলতে রাজি হন নি, কমলনাথ। তিনি রোজ মহাকালের মাথায় জল ঢেলে হিন্দু হবার চেষ্টা করছেন, মোদিজীর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন, রাহুল যাচ্ছেন, প্রিয়াঙ্কা যাচ্ছেন তাঁদেরকেও মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, গোটা উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস মোদি শাহ, আর এস এস বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হিন্দুত্বের প্রশ্নে, কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রের প্রতিদন্দ্বিতা হলে যা হতে পারে তাই হয়েছে। মাত্র কদিন আগেই নফরৎ কি বাজার মে মহব্বত কা দোকানে গডরেজের তালা ঝুলিয়ে ওনারা বের হলেন সেই নফরতের একটা পুঁচকি দোকান খুলে বসতে, ফলও হাতে নাতে। কিন্তু সে প্রসঙ্গও আজ নয়, আজ কেবল এটাই বলা যে এত কিছুর পরে আসলে বিজেপি পরিকল্পিত ভাবেই এক মেরুকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সর্বত্র, মূল দলের সঙ্গে মেরুকরণ, আজ না জিতলেও, পরেরবার জিতবে তারা, এটাই স্ট্রাটেজি, আর সেইখানে বিরোধী দল একটা অসম্ভব সম্ভাবনা নিয়ে এক দেশজোড়া জোটের প্রস্তুতি পর্ব শেষ করার পরেও জোট না বেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেম সাইড গোল খেল। সবথেকে সতীত্ব বজায় রাখা বিপ্লবী দল সিপিএম, ঐ জোট প্রসঙ্গে বহুবার বলেছে এটা কোনও নির্বাচনী জোট নয়, এটা বিজেপির বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক জোট, সমস্ত দল মিলে এক আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁদের কথার মানে কেউ বোঝেনি, ওনারাও নিশ্চিত বোঝেন না কিন্তু মজার কথা হল এই হারের পরে আজ গণশক্তির প্রথম পাতায় লেখা হচ্ছে যে তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনের আগে তাঁদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি নাকি বহুবার আসন ভাগাভাগি করার কথা বলেছিলেন, কংগ্রেস শোনেনি সেই কথা, আহা কি মধুর আক্ষেপ, দলের বৈঠকে, পত্রিকাতে বার বার বলেছেন এটা নির্বাচনী জোট নয়, আজ সেই জোটের জন্য আক্ষেপ। ওনাদেরকথা বাদই দিলাম, কংগ্রেস এই জোটের বড়দল হিসেবেই তাদের দায় স্বীকার করুক, মাস খানেকের মধ্যে ৫৪২ না হোক ৫০০ টা আসনে একের বিরুদ্ধে একের লড়াই হোক, এখনও এই ছবি এক্কেবারে উলটো হয়ে যেতেই পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী জোট হয়, তার বাইরে আন্দোলনের জোট, নৈতিক জোট ইত্যাদি আসলে ভাবের ঘরে চুরি, টগর বোষ্টমীর নখড়াবাজী, ওসব ছেড়ে বিরোধীরা বার হলেই নতুন রাস্তা বেরিয়ে আসবে, নির্বাচনের পরে বুঝুম্ভুলের মত বসে থাকতে হবে না। আগামীকাল এই নির্বাচনের ফলাফল, বিজেপির লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।