আসুন ঘড়ির কাঁটাকে একটু পিছনের দিকে ঘোরানো যাক। মনে করুন সেই রক্ত ঝরা কালো দিন। গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল পহেলগামের চিনার বন। লুটিয়ে পড়া নিরীহ পর্যটকদের রক্তে ভিজে গিয়েছিল ভূস্বর্গ কাশ্মীর। তারপর অপারেশন সিঁদুর। ভারতের যুদ্ধ শুরু হল পাকিস্তানের সঙ্গে। যুদ্ধবিরতিও হল। আর এসবের ভিতরেই বিশ্বমঞ্চে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াতে শুরু করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কী বললেন? মনে করানোর দরকার নেই। ভারতীয় হিসেবে সেই অপমান আমরা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাইনি। তবু বলছি। ট্রাম্প সাফ বলে দিলেন, ভারত-পাক যুদ্ধবিরতির পুরো কৃতিত্বই নাকি তাঁর। এখানে একটা কথা বলে রাখি, বলা দরকার, সেটা হল যুদ্ধবিরতির কথা কিন্তু আগে ট্রাম্প বলেছেন, তারপর মোদি সরকার। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে বিদেশে একটানা বলে গিয়েছেন সেই একই কথা –ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ তিনিই থামিয়েছেন আর একমাত্র তিনিই থামিয়েছেন। ভারতের এখানে কোনও কৃতিত্বই নেই।
মজার কথা হল, ট্রাম্পের এই ঘন ঘন আস্ফালনের পরেও কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি একটি শব্দও বলেননি। একবারও বলেননি, না, ট্রাম্প ঠিক বলছেন না। বলেননি, ভারত নিজের দায়িত্বেই এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, এবং পাকিস্তানের নাভিশ্বাস ওঠার পর নিজের দায়িত্বেই এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। এরপর বিরোধীরা চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল, রাহুল গান্ধী তো সরাসরিই বললেন, ট্রাম্প ফোনে বলেছেন নরেন্দার সারেন্ডার, ব্যাস যুদ্ধ শেষ। মোদি কিন্তু তখনও চুপ। এরপর, বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রি জানালেন ভারত-পাক যুদ্ধে কোনও তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু মজা দেখুন, কোথাও একবারের জন্যও ট্রাম্পের নাম শোনা গেল না। ট্রাম্পের প্রসঙ্গ এলেই মোদিজির মুখে কুলুপ।
এরপরের ঘটনা ‘ট্যারিফ পে ট্যারিফ, ট্যারিফ পে ট্যারিফ’। সোজা বাংলায় ট্যাক্সও চাপালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুখের উপর জবাব দিল চীন। পাল্টা ট্যাক্সের পাহাড় চাপাল আমেরিকার উপর। কিন্তু মোদিজি কী করলেন? যা করেছেন তাই, অর্থাৎ মুখ বুজে থাকলেন। বিরোধীরা সরাসরি বলছে, মোদিজি কি ট্রাম্পকে ভয় পান? এভাবে ভারতের উপর ট্যাক্স চাপানোর পরেও মোদিজি কেন চুপ? কিন্তু, মোদিজি প্রমাণ করে দিলেন মুখে কুলুপ আঁটাই তাঁর মহা অস্ত্র। মাঝখানে কিছুদিন গোঁসা করেছিলেন ট্রাম্প, দূরে ছিলেন মোদিজির থেকে। কিন্তু কোথা থেকে কী হল, ট্রাম্প আবার ফিরে এসেছেন নরেন্দ্র মোদির জীবনে। এবার মোদিজির প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেছেন, “মোদি একজন মহান মানুষ, তিনি ট্রাম্পকে ভালোবাসেন”। এখন, এই ভালোবাসাবাসি নিয়ে যে কথা উঠতে পারে, সেটা ট্রাম্প বিলক্ষন জানেন, আর তাই এটাও বলেছেন, “আমি চাই না কেউ কথাটা ভুলভাবে নিক, বা ওর রাজনৈতিক জীবনের ক্ষতি হোক।”
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কোথায় চলেছে দেশ? ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?
আহা রে! মোদিজির কতই না খেয়াল রাখেন ট্রাম্প! আমাদের দেশের বিরোধীরা যদি সেটা বুঝতো। যাই হোক, এই ভালোবাসার কথার পরেই ট্রাম্প জানিয়েছেন, মোদি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করবে। এই প্রসঙ্গে ট্রাম্পের আরও দাবি, এর ফলে রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করা হবে। সোজা কথায়, আবার যুদ্ধ থামাতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু কেন? এবারের মতো নোবেল শান্তি পুরস্কারও তো আর জুটল না। পরের বারের জন্য টার্গেট করছেন? যাকগে সে কথা, আসল ঘটনা এই, মোদিজি কিন্তু এবারও ট্রাম্পের কথার কোনও প্রতিবাদ করলেন না। তাহলে দুনিয়া কী দেখছে? দেখছে যুদ্ধবিরতি হোক বা রাশিয়ার থেকে তেল কেনা – যেকোনও বিষয়েই ভারত সরকার কিছু বলার আগে, নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ঘটনা যে ভারতের সম্মান বাড়াচ্ছে না, তাতে কোনও সন্দেহ আছে কী?
১১ অক্টোবর ২০২৫, নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন সার্জিও গোর। কে এই সার্জিও গোর? মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এখন এর কথাই ভাবছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। সার্জিও গোর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন এবং উপহার দিলেন ট্রাম্পের সই করা একটি ছবি। যাতে লেখা ছিল, ‘MR. PRIME MINISTER YOU ARE GREAT’। মনে রাখবেন, এই উপহার দেওয়া হচ্ছে এমন সময় যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এখানে আরও একটু তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখা যাক। ভারত বলছে, সস্তা জ্বালানি দেশের ১.৪ বিলিয়ন নাগরিকের জন্য অপরিহার্য। বাজার বিশ্লেষক সংস্থা Kpler জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের মোট তেল আমদানির ৩৪ শতাংশ এখনও রাশিয়া থেকেই এসেছে—প্রায় ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে, বাস্তবে ভারতের রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ হয়নি। কিন্তু তবু ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন এসব বলছেন? আর মোদিজিই বা কেন চুপ করে আছেন। আরও দেখুন, বিদেশমন্ত্রকের তরফে রণধীর জয়ওসয়াল বলেছেন, তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারতীয় গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু ট্রাম্প যে বললেন, মোদি জানিয়েছেন ভারত রাশিয়া থেকে আর তেল কিনবে না এই দাবি নিয়ে কিন্তু বিদেশমন্ত্রক একটি কথাও বলল না। এই যে রাহুল গান্ধী বারবার বলছেন মোদি ট্রাম্পকে ভয় পান, এবং একই সঙ্গে কংগ্রেস অভিযোগ করছে, ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখার জন্য দেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন করছেন মোদি- সেই নিয়েও কিন্তু মোদিজির মুখে একটা প্রতিবাদ নেই। মোদি কি শেষমেশ গান্ধিপন্থী হয়ে গেলেন ? খারাপ কথা শোনেন না, খারাপ কথা বলেন না।
এই হচ্ছে অবস্থা। মোদি আর ট্রাম্পের বন্ধুত্ব জমজমাট হচ্ছে। পাশাপাশি দুনিয়ার সামনে নষ্ট হচ্ছে ভারতের ভাবমুর্তি। আর শুধু এইচুকুই নয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই মুহুর্তে আরও দুর্বল হয়েছে ভারতীয় পাসপোর্টের অবস্থা। বুধবার ২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ হয়েছে। তাতে ভারতীয় পাসপোর্টের জায়গা ৮৫ নম্বরে। প্রথম স্থান পেয়েছে ফ্রান্সের পারপোর্ট। এরআগে পাঁচটি দেশের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতের পাসপোর্ট ছিল ৮০ নম্বরে। এভাবেই চলছে সবকিছু। ট্রাম্প যা খুশি বলছেন মোদি চুপ করে থাকছেন। দেশ টলমল করছে। প্রশ্ন এই ভাবেই চলবে সবকিছু? ডোনাল্ড ট্রাম্পের যা খুশির তাই বকবকানির জবাব কে দেবে? মোদিজি যে দেবেন না, সে তো বোঝাই গেছে। কে দেবে তবে জবাব? দেশ কবে পাবে তাঁকে?