সে কী গলাগলি, সে কী হাত ধরাধরি, স্লোগান দিয়ে ফেললেন অবকি বার ট্রাম্প সরকার, পাড়ার মোড়ের বখাটে ছেলেরা যেমন অমিতাভ বচ্চনকে বাংলার জামাইবাবু বলে আর একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে, তেমন আর কী। ট্রাম্প তো মেরা পুরানা দোস্ত হ্যায়, সেসব বিরাট বাওয়ালের পরে এমন এক আন্তর্জাতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে মোদিজির মুখে আর ট্রাম্পের নাম শোনা যাচ্ছে না। আর ট্রাম্প সাহেব তাঁর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে ধারাবাহিকভাবেই ভারতের পিন্ডি চটকাচ্ছেন বললেও কম বলা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন আমেরিকার মোদিজি, সব অর্থেই। চরম দক্ষিণপন্থী, জঙ্গি জাতীয়তাবাদী, অনর্গল ভুল আর মিথ্যে বলে যাওয়া ট্রাম্পের সঙ্গে মোদিজির তফাৎটা হল ট্রাম্প ১) যা করছেন দেশের স্বার্থেই করে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, উনি আসার পরে মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, উনি আসার পরে দেশের বেকার ছেলেমেয়েরা ভরসা পেয়েছে, চাকরি বাড়ছে এবং উনি দেশের যাবতীয় নিয়ম কানুন মেনেই প্রকাশ্যেই ওনার বন্ধুবান্ধব শুভানুধ্যায়ীদের বিভিন্ন সুবিধে বিতরণ করে যাচ্ছেন। ২) আমেরিকা বিশ্বের সবথেকে ক্ষমতাবান, সম্পদশালী দেশ। এই দুটো বাদ দিলে এক্কেবারে খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ। আগেও একবার এই অনুষ্ঠানেই বলেছিলাম দুজনেই বড় বড় কথার মালিক, দুজনেই জঙ্গি জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, দুজনেই ধুমধাড়াক্কা সিদ্ধান্ত নেন, আর দুজনেই নিজেদের দেশে দক্ষিণপন্থী ভাবনার পোস্টার বয়।
এদের মিল দেখলে বলাই যায় এনারাই সেই হবুচন্দ্র রাজা, গবুচন্দ্র মন্ত্রী। দুজনেই একই স্কুলে একই হেডমাস্টারের কাছে বক্তৃতা শিখেছেন! ট্রাম্প যেমন “মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” বলে গলা ফাটান, মোদিও “অচ্ছে দিন আনেওয়ালা হ্যায়” বলে ভোটের মঞ্চ মাতিয়ে দেন। দুজনেরই কথায় একটা জাদু আছে, ক্যারিস্মা আছে —হ্যাঁ ম্যাজিক আছে, শুনলে মনে হয়, এই তো, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু বাস্তবে কী হয়? উনি বললেন পাকিস্তানকে এমন সবক শেখাবো, এমন শিক্ষা দেব যা ওদের কল্পনার বাইরে, কী হল? ট্রাম্প সাহেব বললেন বাণিজ্য দেব, ব্যস, শেষ হয়ে গেল সবক শেখানো, উনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি। ট্রাম্পের আমেরিকা আর মোদির ভারত— দুটো জায়গাতেই মানুষ বলে, “ভাই, এই গ্রেটনেস আর অচ্ছে দিন কবে আসবে, একটু ডেটটা বলে দাও!” সে দিন আর আসে না, এঁরা ততক্ষণে নতুন কিছু নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” আর মোদীর “মেক ইন ইন্ডিয়া” এ দুটোও এক্কেবারে একই টাকার, একই কয়েনের এপিঠ ওপিঠ। ট্রাম্প বলেন, “বাইরের লোক এসে আমাদের চাকরি খেয়ে নিচ্ছে,” তাই তিনি মেক্সিকোর সীমান্তে দেওয়াল তুলে দিলেন। মোদিও বলেন, “ভারতীয়দের জন্য ভারতীয় পণ্য,” তাই “আত্মনির্ভর ভারত” নিয়ে এলেন। দুজনেরই মনে একটাই ভাবনা— আমরা সেরা, বাকিরা পরে আসুক!
ফারাকটা হল আমেরিকার এসব বলার অর্থনৈতিক সামরিক জোর আছে, যেটা মোদিজির নেই, উনি কাপ্তেন, ইনি ফোতো কাপ্তেন। দুজনেই জাতীয়তাবাদের চাকায় দুজনেই এত জোরে হাওয়া দিয়েছেন যে, বাকি বিশ্বের মানুষ মাঝে মধ্যেই বলে, “ভাই, একটু ব্রেক কষো, আমরাও তো পৃথিবীতে আছি!” ওনারা চলেন নিজের মনে, বয়েই গেছে বিশ্বের মানুষজনের কথা শুনতে। খেয়াল করে দেখুন এনাদের দুজনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন এক্কেবারে এক। ট্রাম্প হঠাৎ সকালে উঠে একদিন ঘোষণা করে দিলেন, “মুসলিম দেশ থেকে কেউ আমেরিকায় ঢুকবে না,” মোদিও হঠাৎই এক রাতে বলে দিলেন, “আজ থেকে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট চলবে না!” দুজনেরই সিদ্ধান্তে একটা ধুমধাড়াক্কা ব্যাপার আছে— দুজনেরই মোদ্দা কথা হল, “দেখো, আমি বড় নেতা, আমি যা বলব তাই হবে!” কিন্তু এই ধুমধাড়া্ককার পর লোকে যখন লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলতে গেল, বা ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞায় বিমানবন্দরে আটকে পড়ল, তখন সাংবাদিক আর কিছু দুষ্টু লোকজন প্রশ্ন করলেন, “ভাই, মানে কী? এত তাড়ার কী ছিল? দুজনেই তখন তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে বা হাম্পটি ডাম্পটি কবিতা পড়ছেন। মনে আছে করোনার সময়ে লকডাউনের কথা? ২৪ ঘণ্টার নোটিসে লকডাউনের সত্যিই কি দরকার ছিল?” দুজনেই দক্ষিণপন্থীদের পোস্টার বয়!
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দেশের মানুষকে প্রধানমন্ত্রী ডাহা মিথ্যে বললেন
ট্রাম্প সাদা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, মোদিও হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদের পতাকা উড়িয়ে দেন। ট্রাম্প ফিলিস্তিনি ছাত্রদের পেছনে লাগেন, মোদীও সমস্ত বিরোধী কণ্ঠকে ‘দেশবিরোধী’ বলে চুপ করিয়ে দেন। দুজনেরই মনে একটা ভাবনা— যারা আমার সঙ্গে একমত নয়, তারা আমার দেশের জন্য ভালো নয়। এই ভাবনায় দুজনেই যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম। মজার ব্যাপার, দুজনেরই ফ্যান ফলোয়িং আছে বিস্তর। ট্রাম্পের সমর্থকরা যেমন তার জন্য জান দিতে রাজি, মোদির ভক্তরাও তাকে ‘দেশের ত্রাণকর্তা’ বলে পুজো করে। দুজনেই জানেন কীভাবে ভিড়কে মাতিয়ে রাখতে হয়— একজন টুপি পরিয়ে, আর একজন পাগড়ি পরিয়ে! একটা ছোট্ট তালিকা দিই এই ট্রাম্প দ্বিতীয় সরকারের ঘোষণা আর কাজকর্মের। ১) গ্রিনল্যান্ড আর পানামা ক্যানাল চাই। কেন? কোন ভিত্তিতে? কে ঠিক করবে? না সেসবের উত্তর নেই, বাবু বলেছেন চাই তো চাই। একবারও ভাববেন না যে এটা উন্মাদের কথাবার্তা, উনি বিষয়টার অবতারণা করলেন, এবারে সেই দিকে কাজ শুরু হয়ে গেছে। গ্রিনল্যান্ডে, কম হলেও এই দাবির সমর্থনে কথাবার্তা বলছেন কিছু মানুষজন। আমেরিকার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে। ট্রাম্প সাহেব জানেন, সামরিক দিক থেকে শুধু নয় হেভি মেটাল-এর বিরাট ভাণ্ডার রয়েছে সেখানে।
২) আমাদের বিশ্বের লোকজন ঠকাচ্ছে, আমাদের উপরে শুল্ক, ট্যারিফ ধার্য করছে, অথচ আমাদের ট্যারিফ ভীষণ কম, এটা চলতে পারে না, আমরা রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ চার্জ করব। করলেন, এবং ক’দিনের মধ্যেই সব স্থগিত রাখলেন। কী মনে হচ্ছে পাগল? এক্কেবারেই নয়। উনি একটা বিরাট এগিয়ে থেকে বার্গেনিং শুরু করলেন। আমাদের নিউমার্কেটের হকারদের মতো, দাম কত? ৫৮০। আপনি ভাবছেন দরদাম করে ৩০০-তে হলে কিনে নেবেন, আর বিক্রেতা ভাবছে ৩০০-তে বেচতে পারলেও তো ২০০ টাকা লাভ। হ্যাঁ, এটাই ট্রাম্প সাহেব করছেন, বিশেষ করে উল্টোদিকে যদি মোদিজির মতো এমনিতেই বেণীর সঙ্গে মাথা বিক্রি করে দেওয়ার মত রাষ্ট্রনায়কেরা থাকে, তাহলে এই চালাকিটা কাজে দেবে। ৩) উনি এসেই সবকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ট নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন, আমাদের টাকা নেবে, আমাদের পয়সাতে খাবে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে বিশ্ব শান্তির কথা বলবে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলবে তা তো হয় না, এটা হল যুক্তি, শোনা শোনা চেনা চেনা লাগছে? হ্যাঁ অর্ণব গোস্বামী ইত্যাদি গোত্রের অ্যাঙ্কর, অ্যাঙ্করনিদের যোগ্য গুরুদেব। যে বেশি পড়ে, সে বেশি জানে, যে বেশি জানে, সে তত কম মানে। উনি জানেন। কাজেই মুক্ত চিন্তা, মুক্ত বিশ্বাসের সামনে এক প্রকাণ্ড তালা ঝোলানোর ব্যবস্থা করছেন। ৪) ইতিহাস জ্ঞানটা মোদিজির এক্কেবারে সমকক্ষ, এই সেদিনেও আবার বললেন, ভারত পাকিস্তান গত ১০০০ বছর ধরে লড়ছে, আমি দুজনকে এক জায়গাতে বসে বুঝিয়েছি, লড়াই না করে ব্যবসা করো। বোঝো, ১০০০ বছর আগে ভারত, পাকিস্তান ছিল, এটা ওনার জ্ঞানের বহর। ৫) দুনিয়ার আর কোনও জোটকে তিনি থাকতেই দেবেন না, এর আগে এরকম কোনও কথা কখনও কোনওদিন কোনও রাষ্ট্রনায়ক বলেছে বলেও আমার জানা নেই।
উনি কেবল বলেননি, হুমকি দিয়েছেন যে ওই ব্রিক্স-এর দেশগুলোকে তিনি দেখে ছাড়বেন, ওরা ডলারের পরিবর্তে ওদের টাকা চালু করার কথা বলছেন, ব্রিক্স-এ থাকলে আমি জানিয়ে দিচ্ছি, আমেরিকার সঙ্গে কোনও ব্যবসা করা যাবে না। উনি সংবাদমাধ্যমের সামনেই বলে দিলেন, ইলন মাস্ক বলছে ও নাকি ভারতে টেসলার কারখানা করবে, আমি বলেছি ওসব কোরো না, ওদের সঙ্গে ব্যবসা করাটা খুব কঠিন। একই কথা তিনি গতকাল কাতারে বললেন, অ্যাপল কর্তা টিম কুককে তিনি বলে দিয়েছেন, ভারতে অ্যাপল যেন কারখানা না খোলে। ৬) বলছেন ভারতের সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক, বলছেন যে দক্ষিণ এশিয়াতে উত্তেজনা কমাতে চাই, সেই তিনিই টার্কিকে ২৬০০ কোটি টাকার যুদ্ধের অস্ত্র পাঠিয়ে দিলেন। ৭) তিনিই বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না, ওটা নাকি মোদিজি দেখবেন, আসলে বাংলাদেশ ভারত উত্তেজনা জিইয়ে থাক, এতেও ওনার সুবিধে। ৯) ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করলে আমেরিকা রুখে দেবে, না করলে বাণিজ্য করবে। ১০) গাজা স্ট্রিপ আমাদের দিয়ে দিন আমরা বাড়ি ঘর বানাবো। গাজা স্ট্রিপ নয় যেন ওয়াশিংটন ডিসির ধারে কাছে এক বিঘে জমি চাইছেন। প্রতিটা ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর যা মনে আসছে তাই বলে চলেছেন, একটা স্বাধীন দেশ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানকে পাশে বসিয়ে অপমান করছেন, কথা না শুনলে রাশিয়াকে দিয়ে পিটিয়ে দেব গোছের কথা বলেই চলেছেন। এবং সংবাদমাধ্যমের সামনেই বলছেন, আমরাই প্যালেস্তাইনে একটা স্থায়ী শান্তির জন্য ডিল করছি, আমিই ইউক্রেন–রাশিয়া সংঘাত থামিয়ে দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতা করেছি এবং শেষমেশ আমিই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামিয়েছি। দুজনকেই বাণিজের লোভ দেখিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া চালু করতে বাধ্য করেছি। দেয়ার ইজ আ স্ট্রং প্যাটার্ন ইন হিজ ম্যাডনেস, ওনার পাগলামির মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ছক আছে, উনি আদতে একজন সেয়ানা পাগল। প্রতিটা কথা, তার আগের এবং পরের কথা এক্কেবারে মেপেই বলছেন, যা পাগলামি শোনাচ্ছে, তা কিছুদিন পরেই বোঝা যাচ্ছে যে বহু চিন্তাভাবনা করার পরেই তিনি ওই সিদ্ধান্তে এসেছেন।