খবরের কাগজের প্রথম পাতা কেড়ে নিয়েছে দেবাঞ্জন, এরপর থেকে কিছুদিন অনায়াসে খিল্লি করাই যাবে, কি ভাই দেবাঞ্জন নাকি? অনেক কথাই বলা হয়ে যাবে। বিভিন্ন খবর আসছে, কোথাও দেবাঞ্জন রাজনৈতিক নেতা আরও বলা ভাল শাসক দলের নেতাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতায় থাকা আমলা, পুলিশ অফিসার, প্রতিষ্ঠিত মানুষজনের সঙ্গে সেলিব্রিটিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শুধু ছবি তুলছে, এমনই নয়, কোথাও সে ফিতে কাটছে, কোথাও মূর্তি উন্মোচন হচ্ছে, কোথাও ব্লাড ডোনেশন, কোথাও সরকারি সেমিনার ইত্যাদি, দেবাঞ্জন, আপাত গাবলুস গুবলুস এক তরুণ, দাঁড়িয়ে আছে, হাঁসছে, কথা বলছে। সে কেন সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলেছিল? বোকা বোকা প্রশ্ন, সে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলবে কেন? সে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিপত্তি বোঝানোর জন্য, সরকারি দলের নেতা, আমলা, পুলিশ কর্তা, সেলিব্রিটিদের সঙ্গেই তো ছবি তুলবে। তার অন্য আরও কত কাহিনী আজ সামনে, তার গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে, কান চলচিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়ে সাকসেস পার্টি দিয়েছে, রীতিমত অফিস চালিয়েছে, নীলবাতি লাগিয়ে ঘুরেছে, সঙ্গে দেহরক্ষী। কেউ পুরোটা বিশ্বাস করেছে, কেউ সন্দেহ করেছে কিন্তু প্রশ্ন করেনি, কেউ বুঝে তাকে ব্যবহার করেছে, আর তাকে ঘিরেছিল তার বাবা মার অপত্য স্নেহ। ছেলে আমার আইএএস, কেমন করে? তার বাবা তো অশিক্ষিত নন, সরকারি চাকরি করতেন, কিন্তু ওই অপত্য স্নেহের কড়া পর্দায় সব ঢাকা পড়েছিল, সেই কবেই এমন ইচ্ছের কথা কি আমরা শুনিনি? এ ছেলে জজ ব্যারিস্টার না হয়ে যায় না, মনে নেই? আজ খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে এত চমকে উঠছেন কেন? ‘মাকে মা বলে, পিসিকে পিসি বলে, কিন্তু আমাকে বলে চন্ন।’ তাহলে সে তো জজ ব্যারিস্টার হবেই। এই চাহিদার মাঝখানে এক শিশু বেড়ে ওঠে, সে শিশু জেনে যায় তাকে জজ ব্যারিস্টার হতেই হবে, মনে পড়ে? চাঁদ বণিকের পালা? ন্যাড়া, চাঁদকে জাপটে ধরছে, চোর চোর বলে, তাকে বলছে, ব্যাটা তস্কর হয়েছ? চুরিটাও শিখ নাই ভাল মতে? সাঁঝবেলা ধরা পড়ে যাও? সনকা তখন বলছে, চোরটার কান দুটো কেটে চৌরাস্তার মোড়ে রেখে দিয়ে আয়। তখন ন্যাড়া বলছে, চল ব্যাটা তাই থ্যুয়ে আসি, রাত্রে যত চোর যাবে, সবে বিফল তস্কর বলে তোর মুখে থুতু দিয়ে যাবে, চল। তার উত্তরে চাঁদ বণিকের অসাধারণ উক্তি, তাই বটে, চোর হোক কিংবা সাধু হোক, সফল হতেই হবে, নাইলে যে শুধু থুৎকার কপালে তার, তাই বটে।
পৃথিবীটা এমনই আমাদের, বেশিরভাগ মানুষ সেই ছোট্ট বেলা থেকেই জেনে যায়, কিছু একটা তাকে হতেই হবে, চোর হোক বা সাধু, সফল তাঁকে হতেই হবে, নইলে কপালে আছে শুধু অপমান।
মানে কী দাঁড়ালো? আপনাকে ছোট্ট বেলা থেকে ওই কিছু একটা হবার জন্য লড়ে যেতে হবে, সোজা পথে হলে ভালো, না হলে দুটো পথ, আপনি বেকার, ফালতু, অকাজের, অকর্মণ্য, ইডিয়ট, অকর্মার ঢেঁকি হয়ে থেকে যাবেন, কিছুদিন পর থেকেই আপনাকে চায়ের দোকানওলা হঠাৎই এক কাপ চা খাওয়াবে, কেউ একটা বিড়ি দেবে, করুণা করে। মেয়ে হলে, সাত তাড়াতাড়ি পাত্র জোগাড়ে নামবে বাবা মা, আত্মীয় স্বজন। অন্য পথ হল বাঁকা, আপনি চার্লস শোভরাজ হবেন বা দেবাঞ্জন, ব্যক্তি আপনি আপনার মেধা দিয়ে লোক ঠকাবেন, কখনও আপনি ভুয়ো আইপিএস, কখনও ভুয়ো ডাক্তার, কখনও ভুয়ো ফিল্মমেকার, কখনও বা সত্যিকারের নেতা, করে কম্মে খাবেন, দিব্যি থাকবেন, কারণ জানা আছে সব্বার, চুরি ধর্ম, বড় ধর্ম, যদি না পড়ো ধরা, দেবাঞ্জন ধরা পড়ে গেছে। সে ততবড় ধড়িবাজ হয়ে উঠতে পারেনি, সে ততবড় জোচ্চর হয়ে ওঠার পরীক্ষায় অকৃতকার্য। আর যারা ধরা পড়েনি, তাঁরা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে, যারা বেকার ছেলেমেয়েকে চাকরি দেবার নাম করে ঠকিয়েছে, যাঁরা ৪৭ সাল থেকে মানুষকে রোটি কপড়া আউর মকান দেবার কথা বলেছিল, তাঁদেরই এক সরকার বলছে ৮০ কোটি মানুষকে ফ্রিতে রেশন দেবে, মানে? দেশে ১৩৫ কোটি মানুষের মধ্যে, ৮০ কোটি মানুষের অবস্থা এমনই যাদের দু’বেলা রোজগার জুটছে না, খাবার জুটছে না, এবং তা বুক ফুলিয়ে বলছে, রেডিও, টিভিতে মন কি বাত, তাঁদের কী হবে? যে ফেরেব্বাজ জোচ্চর বলেছিল নির্বাচনের পরে, ইউঁ হি পন্দ্র পন্দ্র লাখ হরেক কা খাতে মে আ জায়েগা, তার কী হবে? ২০১৪ তে যে লক্ষ কোটি মানুষকে বলেছিল বিদেশ সে কালা ধন লে আয়েগা, তার কী হবে? বলেছিল মহঁগাই, পেট্রোল ডিজেল কা দাম ঘটেগা, সে সব ফেরেব্বাজির কী হবে? নাকি কেবল নম্বরের খেলা? বড় চোর বড় ডাকাত, বড় ফেরেব্বাজ ঘুরে বেড়াবে, কেবল ছিঁচকেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবো আমরা? আসছি সে কথায়, প্রথমে বলি এসব কথা এই দেবাঞ্জন নামক জোচ্চরটাকে আড়াল করার জন্য নয়, তাই তার বিষয়টা আগে আলোচনা করা যাক। এটা প্রমাণিত যে সে ঠগবাজ, এটা প্রমাণিত যে তার এই প্রবণতা নতুন নয়, ছোট থেকেই আছে, আপাতত কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র, এটাও জানা গেছে যে তার বাবা মা, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের অনেকেই এই রহস্যের অনেকটাই জানতো, বলেনি, প্রকাশ করেনি কারণ তার আপাত সফলতা, নীলবাতি, আইএএসের আইডেন্টিটি কার্ড, সমাজ সেবার মোড়ক, এবং কিছুটা হলেও অর্থের, প্রতিপত্তির সামনে সবাই চুপ করেছিলেন, হ্যাঁ বাবা মা’ও চুপ করেই ছিলেন, চলেছে তো সব ভালই, এই ভেবে। এবার বেলুন ফুটো হতেই বহু মানুষ বলছেন, বলে চলেছেন, আমি জানতাম, আমরা জানতাম। একটা পকেটমার ধরা পড়ার পড়, তাঁকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না মারা পর্যন্ত যাদের শান্তি হয় না, তাঁরা জানতেন, অথচ কিছুই বলেনি। মিডিয়ার কাছে দেবাঞ্জন হাই টিআরপি’র খেলা, রোজ সনসনিখেজ খুলাসা, রিভিলিয়েশন। আজ জানা গেলো দেবাঞ্জনের দেহরক্ষী বিএসএফে ছিল, তাহলে কি কোনও বিএসএফ কর্তা? ব্যস, সিরিয়াল চালু, টিআরপি উঠছে, কাল দেবাঞ্জনের ঘরে আছে গোপন কুঠুরি, ব্রেকিং নিউজ, টিআরপি চড়ছে, দেবাঞ্জনের গার্লফ্রেন্ড ছিল? কহাঁনি মে নতুন ট্যুইস্ট। সরকারে আছেন যাঁরা, সেই রাজনৈতিক দলের নেতা ও সমর্থকরা, আমরা এতে জড়িত নই, আমাদের কেউ জড়িত নয়, আমাদের কারোর কারোর সঙ্গে দূর থেকে ছবি তোলা হয়েছিল, অজান্তে ছবি তোলা হয়েছিল গোছের বিবৃতি দিয়েই যাচ্ছেন, বিরোধীদের পোয়া বারো, রাস্তায়, দেবাঞ্জন কেন লোক ঠকালো, রাজ্য সরকার জবাব দাও, বিক্ষোভ, এমনকি ঘন্টা খানেকের লালবাজার হাজত এবং সেলফি। যে মানুষটার রোজগার বন্ধ, যে কৃষক এখনও ধানের দাম পায়নি, যে শ্রমিকের মাইনে কাটা গেছে, যে হকারের বাড়িতে চুলো ধরছে না, যে ক্যানিংয়ের মাসি লোকাল ট্রেন নেই বলে শহরে আসতে পারছে না, মাইনে পাচ্ছে না, তাদের জীবনের সঙ্গে এই গল্পের যোগাযোগ ঠিক কোনখানে? আসলে আমাদের এই ব্যবস্থায় কেবল নয়, যে কোনও সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জোচ্চর হবার অবকাশ আছে, থাকবে। দল, মত, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে একজন মানুষ জোচ্চর হতে পারে, সে ব্যক্তিকে ঠকাতে পারে, প্রতিষ্ঠানকে ঠকাতে পারে, সরকারকে ঠকাতে পারে, রাষ্ট্রকে ঠকাতে পারে। কেবল পারে নয়, পেরেছে। একবার নয় বহুবার, একজন মানুষ খুঁজে বার করতে পারবেন? যে কোনওদিনও ঠকেনি? একজনকেও পাওয়া যাবে না। তাহলে উপায়? উপায় দুটো, এক ব্যক্তি মানুষের মধ্যে এই সীমা অতিরিক্ত লোভ, চাহিদা কমানো, কিভাবে কমবে? ওসব আত্মা, পরমাত্মা, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু গোছের আবছায়া কথা নয়, ব্যক্তি মানুষের লোভ চাহিদা কমানোর উপায় হল এক সুন্দর জীবন, লিভিং স্টান্ড্যার্ডের যোগান। মানুষ যদি শ্রমের বিনিময়ে, সোজাপথে এক সুখী, সুন্দর জীবন পায়, অন্তত পাবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার মধ্যে এই উদগ্র লোভ আর চাহিদা জন্মায় না, কিন্তু যদি সে রোজ বাজারে যায় আর দেখে মোষ বাঁধার দড়ির মত সোনার চেন গলায় দিয়ে এক ক অক্ষর গোমাংস, সবচেয়ে দামি মাছ, ফল, সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে, যদি দেখে তাঁর বাবা, তাদের তিন ভাই বোনকে বছরে একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারে না, যদি দেখে রোজ হুদো হুদো বিজ্ঞাপন, কমোডিটির বিজ্ঞাপন যা না হলে সুন্দরী মেয়েরা তাকায় না, যা না থাকলে খিদে মেটে না, তাহলে তার মধ্যে সেই লোভ আর চাহিদা জন্ম নেবে, নেবেই। ধরুন একজনের সেই লোভ আর চাহিদা জন্মালো, কিন্তু সে তার লোভ আর চাহিদা অনুযায়ী কিছুই করে উঠতে পারলো না, তাহলে তখন সেই ইচ্ছে পূরণের জন্য সে বেছে নেবে তাঁর সন্তানকে, তার মধ্যে সে ওই লোভ আর চাহিদাকে চারিয়ে দেবে, স্কুল যদি সব একই মানের হত? তাহলে না খেয়ে, নিজের যাবতীয় চাহিদাকে খুন করে কোনও বাবা মা ছেলেকে ৫০০০ টাকা, পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে স্কুলে পড়তে পাঠাতো? তার মানে এই অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে লোভ আর চাহিদার জন্মের ইতিকথা, দেবাঞ্জনের ইতিকথা। আর অন্য আরেকটা উপায় হল, সমাজ আর রাষ্ট্র কাঠামোকেই সেইরকম তৈরি করতে হবে, যেখানে এই জোচ্চুরি সম্ভব নয়, কিন্তু আবার সেই একই সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াবে, মানুষে মানুষে এত বৈষম্য যে রাষ্ট্র কাঠামোতে থাকে, সেই কাঠামো জোচ্চরদের জন্ম দেয়, ছোট জোচ্চর ধরা পড়ে, বড় জোচ্চররা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ধরা পড়েছিল হর্ষদ মেহেতা, কিন্তু সে টাকা? সেই কোটি কোটি টাকার কী হল? তা জানা যায়নি, বিজয় মালিয়া থেকে বাবা রামদেব, নীরব মোদি থেকে মেহুল চোস্কিরা, ওইরকম ফেরেব্বাজরা এই কাঠামোতেই জন্ম নেয়, তাই দেবাঞ্জন গেলে কোনও আরেক নীলাঞ্জন এসে হাজির হবে, অন্য কোনও নামে, অন্য কোনও চেহারায়, অন্য কোনও ফেরেব্বাজিকে হাতিয়ার করে। তাই আপাতত চাহিদা, দেবাঞ্জন যে ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এই ঠগবাজিতে নেমেছিল, সেগুলোকে মেরামত করা, এবং খুঁজে বার করা সেই লোকগুলোকে, যে বা যারা এই দেবাঞ্জনকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু আবার আরেক দেবাঞ্জন হাজির হবে, যা আবার সরকারের অস্বস্তি, বিরোধী দলের আনন্দ আর মিডিয়ার টিআরপি হয়ে উঠবে, এ খেলা চলবে ততদিন, যতদিন না এর শেকড় ধরে টান দেওয়া হচ্ছে।