পোপ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন না, জামা মসজিদের ইমাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নির্বাচিত হন না, মঠ বা মিশনের স্বামিজী সাধুদের নির্বাচনেও কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নেই, আর এস এস সরসঙ্ঘচালক ও বেছে নেওয়া হয়, তার জন্যও কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকে না। এখন মঠ, মিশন, জামা মসজিদ বা ভ্যাটিক্যান সিটির কোনও গণতান্ত্রিক আচরণের দায় নেই, তাঁরা ধর্মের কথা বলেন, স্বর্গ বা নরকের কথা বলেন, টেন কমান্ডমেন্টস এর কথা বলেন, কী করিবে, কী করিবে না বলেন, তা মানিলে মানিবে, না মানিলে নরকে যাইবে, কিন্তু নরকে দোজখে বা হেল এ পাঠানোর কোনও ব্যবস্থাই ঐ ইমাম, সদগুরু বা পোপের নেই, কারণ তাঁরা কোনও সংবিধান মেনে উই দ্য পিপল এর কথা তো বলেন না। কাজেই তাঁদের শীর্ষগুরু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায় কিন্তু সে প্রশ্ন ধোপে টেঁকে না। কিন্তু সারাক্ষণ দেশ আর সমাজ নিয়ে খাবলা খাবলা জ্ঞান বিতরণ করা আর এস এস এর সরসঙ্ঘচালক কেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন না, সে প্রশ্ন তো তোলাই যায়।
প্রশ্ন উঠেছেও বহুবার, উত্তর আসেনি। আসলে আর এস এস এর গণতন্ত্র না পসন্দ, তাঁদের অত্যন্ত পছন্দের এক আইকন তো হিটলার। তাঁদের নেতা বি এস মুঞ্জে ইটালিতে গিয়ে মুসোলনীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, ফিরে এসে সেই আদলে সেনা বাহিনী তৈরি, সেনা প্রশিক্ষণ দেবার নীল নকশা বানিয়েছিলেন, তৈরিও হয়েছিল সেই প্রশিক্ষণ সংস্থা, ইংরেজ শাসক দেশীয় রাজারা তার জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। মোদ্দা কথা হল গণতান্ত্রিক রীতি নীতি, দায় এবং বোধ তাদের নেই। নেই বলেই তাঁদের প্রতিদিনের প্রার্থনা হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলে, नमस्ते सदा वत्सले मातृभूमे বत्वया हिन्दुभूमे सुखं वर्धितोऽहम्। সেই আর এস এস এর অন্যতম প্রচারক নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজীরও গণতান্ত্রিক রীতি নীতি বোধ নেই। আপাদমস্তক এক খামখেয়ালি রাজার মত ব্যবহার করে চলা মোদিজীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উনি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী, ছলে বলে কৌশলে, বহু অর্থব্যয় করেছেন, তবুও গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। দেশে এখনও সংবিধান আছে, তাকে পাশ কাটিয়ে চলার বহু চেষ্টা হলেও সংবিধান এখনও আছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও আছে, টাকা ছড়িয়ে, হুমকি দিয়ে চতুর্থ স্তম্ভ কিনে নেবার হাজার প্রচেষ্টার পরেও মুক্ত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম মাথা চাড়া দিচ্ছে। সেই অগণতান্ত্রিক কেবল নয় গণতান্ত্রিক রীতি নীতির চড়ান্ত বিরোধী মোদি সরকার এক ডকুমেন্টারি ফিল্ম ব্যান করলো। না কোথাও দেখানো যাবে না, মহুয়া মৈত্র, ডেরেক ও ব্রায়েন টুইট এ লিঙ্ক দিয়েছিল, মুছে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকলে তাকে সরিয়ে দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তো কী নিয়ে ছিল ঔ ডকুমেন্টারি? ২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে আলোচনা। ডকুমেন্টারিতে পরিচালকরা বহ তথ্য আর সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সেদিন ঐ দাঙ্গার সময় গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী কেবল চুপ করে বসে ছিলেন না, দাঙ্গায় ইন্ধন দিয়েছিলেন। এ ডকুমেন্টারি বিবিসি র মত সংস্থা তৈরি করেছে, নেট থেকে তুলে নেবার পরে শোনা যাচ্ছে তা এখন পেন ড্রাইভে পেন ড্রাইভে ছড়িয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের ভয়, কদিন পরে টুকরো টুকরো অংশ হোয়াটস অ্যাপে না ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা তাদের উদ্বেগের কথা ইতিমধ্যেই হোয়াটস অ্যাপ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। মোদিজী কিছুদিন আগেই এক মঞ্চ থেকে হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে জানিয়েছিলেন, প্রতিদিন আমার বিরোধীদের কুৎসা আর গালি খেয়ে খেয়ে আমি আরও শক্তিমান হয়ে পড়ছি, তাদের এই গালিগালাজ আমাকে এক্সট্রা এনার্জি যোগাচ্ছে। তাহলে এই সামান্য এক ডকুমেন্টারিকে ব্যান করার দরকার কেন পড়ল? কোন সত্যিকে লুকোনর জন্য এই ব্যান, এই নিষেধাজ্ঞা? সর্বজনবিদিত এক দাঙ্গা, যার চেহারাই বলে দেয় যে তা ছিল স্টেট স্পনসরড এক দাঙ্গা, ভোটার লিস্ট দেখে দেখে মানুষ খুন করা হয়েছিল, পুলশ চুপ করে দাঁরিয়ে দেখেছে এমনও নয়, পুলিশ তাতে অংশ গ্রহণও করেছিল, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘরে বৈঠক করে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই কথাগুলো বলা আছে এই ডকুমেন্টারি তে। আচ্ছা ঠিক এই কথাগুলোই কি তিস্তা শীতলবাড় বা এখন জেলেই আছেন, সেই সঞ্জিব ভাট বলেন নি? আর কী নতুন তথ্য ছিল যা মানুষের সামনে এলে মোদিজীর এনার্জি বাড়ার বদলে কমে যেত? জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটিতে এই ছবির প্রদর্শন কে বাতিল করা হয়েছে। প্রবল বালির ঝড় উঠলে, উটপাখি তার মাথাটা বালির ঢিপির মধ্যে গুঁজে দেয়, তারপর চুপ করে বসে থাকে, সে ঝড় দেখতে পাচ্ছে না, তাই ভাবে ঝড় তো নেই।
মোদিজী এবং তাঁর সরকার বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে সত্যিটাকে এড়িয়ে যাআর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আরে বাবা ৩৫ টাকায় পাওয়া যায় ৪ জিবির পেন ড্রাইভ, কাকে আটকাবেন? কতদিনই বা আটকাবেন? কতগুলো লিঙ্ক মুছবেন? সারা পৃথিবী জুড়ে যে অন্তর্জাল বিছিয়ে পড়েছে, সেখানে লুকোতে গেলে নিজের মাথাটাই লুকোতে হবে, বাকি সব থাকবে আলোর সামনে। নেতাজীকে এক ন্যালাখ্যাপা বানিয়ে সিনেমা হবে, এক ভাঁড়ের সিনেমা, এক মেরুদন্ডহীনের সিনেমা, তা চলবে, তাকে আটকানো হবে না। গোটা কাশ্মীরের মুসলমানদের ভিলেন বানিয়ে ছবি চলবে এক ভালগার প্রপাগান্ডা চলবে, বাংলার গোখরো থেকে বিবেক অগ্নিহোত্রী, অনুপম খেরের দল সারা দেশে সেই নোংরা মিথ্যে প্রচার নিয়ে ঘুরবেন, এসব হবে, কেবল বিবিসির ডকুমেন্টারি ফিল্ম টা দেখানো যাবে না।
মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো মোদিজী, গণতন্ত্র চেখে দেখতে চান? তাহলে একবার আপনার পেয়ারের গোপূজক ঋষি সুনক কে বলে দেখুন না কেন, তিনি তো ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, বলুন ঐ ডকুমেন্টারি টা ব্যান করতে। তিনি কেন, ইংল্যান্ডের কোনও রাজনীতিবিদ ঐ বিবিসি কে বলতে পারবেন না যে, ঐ ডকুমেন্টারি টা ব্যান করুন, ওটা দেখাতে দেওয়া যাবে না। বলতে পারবেন না, আর বললেও কেউ শুনবেন না। এটাই গণতন্ত্র, এটাই গণতান্ত্রিক রীতি নীতি, এটাই সভ্যতা। অসভ্য বর্বর বলতেন জ্যোতি বাবু, সাধে বলতেন? ইন্দিরা গান্ধী সেন্সর করেছিলেন খবরের কাগজ, সংবাদ মাধ্যম কে, জরুরি অবস্থা জারি করেই করেছিলেন। আর আমাদের বর্তমান পরধান সেভক কোনও ঘোষণা ছাড়াই জরুরি অবস্থা চালাচ্ছেন, বিভিন্ন এজেন্সি দিয়ে বিরোধী রাজনীতিবিদ দের ভয় দেখানো, বিরোধিতার স্বর কে জেলে পোরা, সংবাদ মাধ্যম কে নিয়ন্ত্রণ করা আর এখন সমস্ত চক্ষুলজ্জা ভুলে এক স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের তৈরি ডকুমেন্টারি কে দেশে ব্যান করা।
মোদিজীই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি একটাও সংবাদসম্মেলন করেন নি, কখন কোন বেয়াড়া শক্ত মেরুদন্ডের সাংবাদিক কোন প্রশ্ন করে বসে, সেইজন্যই তিনিই দেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি সংবাদ সম্মেলন করেন নি, সাংবাদিকদের ভয় পান, সাংবাদিকদের জায়গায় কানাডার নাগরিক অক্ষয় কুমারের আম চাটা কাটা প্রশ্নতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। মাঝা মধ্যে রবিঠাকুরের দু একটা কবিতার লাইন বিকৃত উচ্চারণে আওড়ান বটে, রবি ঠাকুর তিনি পড়েন নি, হলফ করেই বলতে পারি, আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতেই, তুমি কি তেমন শক্তিমান, তুমি কি তেমন শক্তিমান? পড়েন নি। ধরেই নিয়েছেন তিনি হুকুম জারি করবেন, আর দেশ শুদ্ধু মানুষ সেই হুকুম পালন করবেন। আমরা দেশের মানুষ, আমরা ভারতবাসী, আমাদের ধ্রুবতারা আমাদের সংবিধান, আজ ২৬ শে জানুয়ারি, সকাল থেকে মোদিজী এই গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে যথেচ্চ মিথ্যাচার চালিয়েছেন, এবার সত্যিটা শুনুন, আমাদের সংবিধান আমাদের মুক্ত চিন্তা, মুক্ত আলোচনার অধিকার দিয়েছে, রাইট টু স্পিচ, রাইট টু একসপ্রেস। সেটা আমাদের মৌলিক অধিকার, সে অধিকারের এক কণাও আমরা ছাড়বো না। যদি সত্যি এক বিদেশী সংগঠনের তৈরি ডকুমেন্টারি ফিল্ম আমাদের দেশের কুৎসা ছড়ায়, তাহলেও তা আমরা দেখবো এবং তার জবাব দেবো, কিন্তু তা দেখানোর অধকার কেড়ে নেবো না। আর যদি সত্যি হয় তাহলে দেখবো এবং তা ছড়িয়ে দেবো মানুষের মাঝে, নেটে নাহলে পেন ড্রাইভে, পুরোটা নাহলে টুকরো টুকরো করে, সত্যি বেরিয়ে আসবে।
গণতন্ত্র দিবস কেন? গণতন্ত্র দিবস কাদের? যে সরকার যে মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাদেরকেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলে, সে সরকারের চেয়ে অগণতান্ত্রিক আর কে হতে পারে? সমস্ত বিরোধিতা কে শেষ করে, সমস্ত বিরোধীদের জেলে পুরে মুক্ত স্বাধীন চিন্তাকে স্তব্ধ করতে চায়, তাদের চেয়ে অগণতান্ত্রিক আর কে হতে পারে? যে সরকার গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ কে নিজেদের চাকর স্তাবক বানিয়ে রাখতে চায় তার থেকে অগণতান্ত্রিক আর কে হতে পারে? সেই অগণতান্ত্রিক সরকার যখন গণতন্ত্র দিবস উদযাপন করে তখন হাসি পায় বৈকি। মোদিজী জানেনই না, কদিন পরেই এক কিশোর, এক যুবতী হাতের পেন ড্রাইভ টা তুলে গণতন্ত্র বলে খিল্লি করবে, বলবে জেনে গেছি সেই পাপের কথা, যে পাপের সিঁড়ি বেয়ে আজ আপনি মসনদে বসে আছেন, সেদিন? সেদিন কিভাবে আটকাবেন সত্যিকে? জানতে বড় মন চায় মি প্রাইম মিনিস্টার।