সিপিএমের ব্রিগেড জমায়েত, অবশ্য মলাটে অন্য নাম, খেতমজুর সংগঠন, বস্তি উন্নয়ন সমিতি বা সিআইটিইউ, কৃষক সভা, এনারাই নাকি ব্রিগেডের জমায়েত ডেকেছেন। গত বছরে ডেকেছিল যুব সংগঠন, মঞ্চে ছিলেন মীনাক্ষী মুখার্জি। এবারে খেতমজুর সংগঠনের বন্যা টুডু বক্তৃতা দিয়েছেন, সেটাই ছিল ব্রিগেডের টকিং পয়েন্ট, মীনাক্ষী তলায় দাঁড়িয়ে শুনলেন, হাততালি দিলেন। কিন্তু সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা হল, কে ভালো? কার বক্তৃতা ভালো? কিন্তু মোদ্দা কথা সাফ, ২০২৬, মমতার বিরুদ্ধে বামেরা একজন জুৎসই মহিলা মুখের সন্ধানে আছেন। সন্ধান মিলেছে? বা ধরুন মঞ্চে উঠে বন্যা টুডু বললেন, “সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজির লড়াই আর ভোটবাক্স আলাদা।” অনেকের মনের কথাই বললেন, খুব জরুরি কথা, পরে সেই আলোচনায় আসছি। তার আগে আসি অধীরবাবুর কথায়, আরএসপি থেকে বহরমপুরের মাস্তান হিসেবে খ্যাত, যাঁকে অনেকে আবার রবিনহুডও বলত, সেই অধীরবাবু কংগ্রেসের অতীব দুঃসময়েও বাংলায় কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি হয়েছেন আর লোকসভায় নিয়মমাফিক বিরোধী দলনেতা হওয়ার জন্য যতজন সাংসদ দরকার ততজন না থাকায় দুধুভাতু বিরোধী দলনেতাও হয়েছেন। সেবারে, মানে ২০১৯-এ কংগ্রেসের সেই সংখ্যা থাকলে রাহুল গান্ধীই বিরোধী দলনেতা হতেন।
কিন্তু সে যাই হোক, দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে যায়, অধীরবাবু সেই গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির এই রাজ্যের সভাপতি হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন ওই কংগ্রেস–সিপিএম ঐক্যের এ রাজ্যের কাণ্ডারি। সে জোট হওয়ার পরে কী হয়েছে? সোজা বাংলায় বললে ঘটি হারিয়েছে, বাম শূন্য, কংগ্রেসও শূন্য। দলের নেতাদের ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকলে ১৫-১৬ জন এমন আছেন যাঁরা জানেন সংসদীয় গণতন্ত্রে দল এবং নিজেদের ব্যক্তিগত অস্তিত্বও টেকাতে হলে এমপি হতে হবে, এমএলএ হতে হবে, নিদেনপক্ষে কাউন্সিলর, জেলা সমিতি সদস্য ইত্যাদি। আর সেসব হতে গেলে খুব সোজা সমাধান হল তৃণমূলের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা, এবং এই মূহূর্তে তৃণমূলেরও তাঁদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখার জন্য সেই দায় আছে বইকী। কাজেই দিল্লিতে সঙ্গোপনে তাঁরা সেই কথাই জানিয়েছেন, দিল্লিও এসব জানে না তাও নয়, কাজেই আপাতত এ রাজ্যের কংগ্রেস রাস্তায় নামার চেয়ে, আটভাট বকার চেয়ে জল মাপায় ব্যস্ত। তো সেই হেন অবস্থায়, সেই কংগ্রেসের নেতা যিনি নির্বাচনে হেরে গিয়ে বাদাম বেচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি এই ব্রিগেড মিটিংয়ের সময়ে বাদাম না বেচে বিবৃতি দিয়ে সিপিএমের ব্রিগেড মিটিংকে সমর্থন জানালেন। উরিব্বাস, কত্ত বড় সিদ্ধান্ত বলুন তো? দিল্লি গেছে, রাজ্যের পদ? তাও গেছে। আপাতত হাতে কিছুই করার নেই, সেই অধীর চৌধুরী ব্রিগেডে সিপিএম জমায়েতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ও অধীরবাবু, ২০২৬-এ কেবল এই বাংলাতেই নির্বাচন নয়, ওই বছরেই একই সঙ্গে কেরালাতেও ভোট আছে, সেখানেও সিপিএম জমায়েত তো করবে, একটু অভিনন্দন জানিয়ে আসবেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কী মুসলমান, কী খ্রিস্টান, দেশের সংখ্যালঘুরা বিপন্ন
জানিয়ে রাখি ২৬ এপ্রিল ২০২৪, সাংবাদিক সম্মেলন করে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল জানিয়েছিলেন, বিজেপির সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সিপিএম সরকারে থাকতে চায়। অধীরবাবু এখন কংগ্রেসের কী তা বেশিরভাগ লোকই জানেন না কিন্তু সেই তিনি বলেছেন, “বামেদের এই ব্রিগেড সফল হোক। এটাই আমি চাই। বামেরা কিন্তু কখনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেনি। যেটা আমরা এখন দেখছি। তাই আমি চাই ওদের ব্রিগেড সব দিক থেকে সফল হোক।” দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সিপিএম বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করছে, বাদাম বেচার সিদ্ধান্ত জানানোর পরেও অধীরবাবু সিপিএমকে বিজেপি বিরোধীই মনে করেন। অবশ্য এটাও সঠিক, আপাতত আমাদের মতো মিডিয়া বা সাংবাদিক ছাড়া অধীরবাবুর কোনও কথার গুরুত্ব কেই বা দেয়? মানুষ তো দেয় না। অতএব আদত বিষয়ে ফেরা যাক। হ্যাঁ, ব্রিগেডের মিটিংয়ে মীনাক্ষী ছিলেন মঞ্চের তলায়, বক্তৃতা দিয়েছেন বন্যা টুডু। তিনি বলেছেন ১) সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজি আর ভোটবাক্স আলাদা। ২) লক্ষ্মীদের সম্মান থাকে না, তাদের আর ভাণ্ডার কী? মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, টাকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৩) ওঁরা বলছেন, খেলা হবে। খেলা আমরাও করব। ২৬-এ আমরাও দেখিয়ে দেব। আমরা উইকেট ফেলব। শোনার পরে দেখা গেল সভামঞ্চের তলায় থাকা মীনাক্ষীও তালি দিচ্ছেন। আর এমনিতে বাকিদের মধ্যে দেখলাম খানিকটা নিরাপদ সর্দার নিয়ে খানিক উৎসাহ ছিল, এমনকী মহম্মদ সেলিম যখন শেষ বক্তা হিসেবে এলেন তখন মাঠের লোকজন উৎসাহ হারিয়েছেন, মঞ্চের তলায় কচি নেতাদেরই দেখা গেল গপ্পোসপ্পো করতে।
এমন কোনও নতুন কথা বক্তারা বলেননি, এমন কোনও নতুন মেসেজ এই ব্রিগেডে আসা মানুষজন পাননি যা নিয়ে দুটো কথাও লেখা যায়। কিন্তু বন্যা টুডুর এই বক্তব্য কিন্তু অনেকেরই মনের কথা। অনেকেই বহুবার এই প্রশ্ন করেন, ব্রিগেড তো ভরে যায়, ভোটবাক্স খাঁ খাঁ করে কেন? আবার দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মীরা এটাও বলে থাকেন যে সবাই বলে যে মানুষের রুটিরুজি আর ভোটবাক্স আলাদা। আসুন এটা নিয়ে ক’টা কথা বলা যাক। মানুষের রুটিরুজি আর ভোটবাক্স কি আলাদা? মানুষের চাকরি নেই, মানুষের মাথার উপরে ছাদ নেই, মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হয় নাগালের বাইরে, না হলে তা জরাজীর্ণ, অপ্রতুল, নড়বড়ে। শিক্ষা, জ্ঞান আর চাকরি মিলেমিশে এক ভজঘট অবস্থা। কিন্তু এগুলো কি ভোটের ইস্যু নয়? এই একটা জায়গাতে এক ধরনের হতাশা জন্মাচ্ছে বাম নেতা কর্মীদের মধ্যে। তাহলে কি অন্য কোনও স্টিমুলাস চাই? অন্য কোনও বিষয় যা মানুষকে আরও বেশি আকর্ষণ করতে পারে? চট করে আকর্ষণ করতে পারে? আপনার যথেষ্ট রোজগার নেই, আপনার নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে, আপনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আপনার ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। চারিদিকে র্যামপার্ট দুর্নীতি। এসব সরিয়ে একটা অন্য দিন আনার জন্য একটা নতুন সরকার চাই, একটা সরকার যারা এই বৈষম্য দূর করবে, মানুষের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির গ্যারান্টি এনে দেবে, এসব কথা মানুষ শুনবে না? কে বলেছে শুনবে না? ১০০ বার শুনবে। কিন্তু কার মুখে শুনবে? কে বললে শুনবে? কেন এই জরুরি কথার উপরে ভোট হচ্ছে না? হচ্ছে না কারণ মানুষ বুঝে গেছে এগুলো নির্ভেজাল বাওয়াল।
কীভাবে বুঝল? বুঝল কারণ তারা হরেক কিসিমের সরকার দেখে ফেলেছে। তারা দেখেছে বাম আর ডানে কোনও ফারাক নেই। তারা দেখে ফেলেছে সবকো রোটি সবকো কাম-এর স্লোগান দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে। তারা শুনেছে রোটি কপড়া আউর মকান, মাঙ্গ রহা হ্যায় হিন্দুস্তান স্লোগান, আজ নয় সেই কবে থেকে? তারা শুনেছিল গরিবি হটাও। কাজেই এসব বাওয়ালে মানুষের আর কোনও বিশ্বাস নেই। রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার কথা বললেন বন্যা টুডু। তো এটা কি বললেন যে কেরালা সরকার পার ডে ওয়েজ বাড়িয়ে ৬০০ করে দিয়েছে? বলতে তো পারেননি। কেন? কারণ সেখানে সরকারের স্বীকৃত মজুরি ৩৪৬ টাকা দেয়। মঞ্চেই দাঁড়িয়েই অমল হালদার, বললেন সারের দাম বাড়ছে, বলতে কি পারলেন যে কেরালার সরকার সারের উপরে ৫০ শতাংশ ভরতুকি দিচ্ছে। বলতে পারেননি, কারণ ৩৪ বছর সরকারে থাকার সময়ে এমন কোনও বড় সিদ্ধান্ত বাম সরকার নেয়নি যা পাশাপাশি রাজ্যগুলোতে, জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
তাহলে? তাহলে দুটো জায়গা তৈরি হচ্ছে। একটা হল হিন্দুত্ব, মুসলমানেরা দখল করে নেবে আপনাদের ঘরদোর, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, কাজেই সে দাম যতই বাড়ুক, চাকরি না থাক, স্বাস্থ্য চুলোর দোরে যাক, মূল্যবৃদ্ধি হোক, হিন্দুত্বের খাতিরে সেসব বিসর্জন দিতে রাজি আছেন এক বিরাট সংখ্যাক মানুষ। তাঁরা চোখের সামনে দেখেছেন বিজেপির সরকার থাকাকালীনই কেমনভাবে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, কাজেই হিন্দুত্বের প্রশ্নে তাঁরা বিজেপির সঙ্গে আছেন। অন্য দিকটা হল, হাতে কে কত দিচ্ছেন, ওসব গরিবি হটাও, দাম কমাও, চাকরি দাও এসব বাওয়াল না করে হাতে কত দিচ্ছ ভাই? কত মাল? ডাইরেক্ট বেনিফিট চাই, প্রতিশ্রুতি নয়। বা ধরুন শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লবের বাওয়াল, কারণ সেই সময়ের মধ্যেই তো ভোলেবাবার মাথায় জল চড়ানো বা সন্তোষী মায়ের পুজো বা পাড়ার মোড়ে শনিমন্দির বেড়েছে, চোখের সামনেই বেড়েছে। কাজেই মানুষ চায় ট্যানজিবল বেনিফিট, চোখে দেখা যায়, পকেটে ফিল করা যায় এমন বেনিফিট। যে সরকার সেটা দিচ্ছে, দিতে পারছে, মানুষ সেই দলকে ভোট দিচ্ছে। তবে এই একটাই কারণ নয় তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি আর তার পাল্টা রাজনীতির প্রশ্নগুলোও। কিন্তু মানুষের রুটিরুজির লড়াই সত্যি করেই ভোটবাক্স থেকে বহু দূরে সরে গেছে, যার দায় কিন্তু বামপন্থীদের, সিপিএমের কম নয়।