৭ বছর আগেকার একটা ভাষণ। সাত বছর আগে আমাদের দেশের চা ওলা কাম চওকিদার কাম পরধান সেভক, নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি, যিনি নাকি ফকির, কথায় কথায় ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে বলেন।
দুর্নীতিমুক্ত ভারত তৈরি করার কথা বলেছিলেন, দুর্নীতি তো করেছে কংগ্রেস, মোদিজী বলেছিলেন, দুর্নীতিমুক্ত ভারত চাই, কংগ্রেস মুক্ত ভারত চাই, বিকাশ চাই, বিকাশ। তো হবুচন্দ্র মন্ত্রীর সেই বিকাশ তো এখন গরু চরাতে গেছে, সবাই জানে। আসুন দেখা যাক দুর্নীতি মুক্ত ভারতের কি হাল, উনি খাচ্ছেন? খেতে দিচ্ছেন?
সেই দুর্নীতি মুক্ত ভারতের কথা যখন বলছেন, দেশের সর্বত্র যখন মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় বলে স্লোগান উঠছে, সেই সময়ে, ২০১৬, ৩ মে সন্ধ্যেয় তিনি দেখা করেছিলেন বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য, সুব্রমণিয়ম স্বামীর সঙ্গে। আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ঘোটালা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে, প্রায় ঘন্টা খানেকের বৈঠকে ঠিক হয়, সুব্রমণিয়ম স্বামী এই আগস্টা ওয়েস্ট ল্যান্ড স্ক্যাম, দুর্নীতির কথা রাজ্যসভায় প্রথমে তুলবেন, তুলোধোনা করবেন রাহুল সোনিয়াকে, তারপর বিজেপির হাল্লা ব্রিগেড মাঠে নামবে, সম্বিত পাত্রের দল মিডিয়াতে চিৎকার করবে, গলি গলি মে শোর হ্যায়……ইত্যাদি। তো কথামত সুব্রমণিয়ম স্বামী রাজ্যসভায় বললেন, ডিফেন্স, প্রতিরক্ষার জন্য হেলিকপ্টার কেনাতে বিরাট টাকা পয়সার লেনদেন হয়েছে, ইতালির কোম্পানি, ইতালির মেয়ে আর তার ছেলেকে টাকা দিয়েছে, রাজ্যসভার বাইরে স্বামী,সম্বিত পাত্র, বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী সোনিয়া গান্ধীর ব্যক্তি জীবন নিয়ে কুৎসার বন্যা বইয়ে দিল, নিউজ পেপারে বিরাট খবর, হেলিকপ্টার খরিদারিতে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, এবার জেলে যেতে হবে গান্ধীদের। চলতে থাকল। তারপর ভারতীয় নিয়ম মেনে সব শান্ত, সব চুপ।
এতদিন পরে আবার কিছু তথ্য সামনে এসেছে, আসুন সেগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করি। তথ্য এক, মোদিজী এবং তাঁর সরকার আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, তার প্যারেন্ট কোম্পানি, লিওনার্দো স্পা, কদিন আগে যার নাম ছিল ফিনমেকানিকার ওপর থেকে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, সরকারের কাগজ তাই বলছে।
তথ্য দুই, মোদিজী এবং তাঁর সরকার আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে ব্ল্যাক লিস্ট, কালো তালিকা থেকে মুক্ত করেছে।
তথ্য তিন, মোদিজী এবং তাঁর সরকার আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের বিনিয়োগ, যা তারা ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বোর্ডের মাধ্যমে করেছে, তার অনুমোদন দিয়েছে।
তথ্য চার, আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে মেক ইন ইন্ডিয়া প্রোগ্রামের অন্তর্গত আনা হয়েছে, একটা ব্ল্যাক লিস্টেড কোম্পানি, মোদিজীর বিরাট বাওয়াল মেক ইন ইন্ডিয়াতে সামিল কেবল তাই নয়, তারা ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য ১০০ টা হেলিকপ্টার কেনার প্রক্রিয়াতেও সামিল। না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা।
যে কোম্পানিকে ক’দিন আগে ব্ল্যাক লিস্ট করা হল, যারা নাকি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মিলে দেশের টাকা হজম করেছে, তারা এখন দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করছে।
তথ্য পাঁচ, মহামান্য মোদিজী এবং তাঁর সরকার, আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে সবকটা মামলায় হেরেছে, এবং শুধু হেরেছে বললে, বাকি সত্যটা বলা হবে না। হেরেছে তো বটেই, হারার পর আপিলের সুযোগ থাকে, মোদিজী সেই আপিলের সুযোগটুকুও নেননি, কেন নেননি? সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন করপশন কা কচ্চা চিট্টা হমারে পাস হ্যায়, তো সেই কচ্চা চিট্টা এখন কই গেল?
এই গল্পের শুরুতে যাই, ক্রোনোলজিক্যালি বুঝে নিই কী হয়েছিল। ২০১০, ২০ ফেব্রুয়ারি, ভারত সরকার, আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে ১২ টা হেলিকপ্টারের বরাত দেয়। ৩৫৪৮ কোটি টাকায় এই হেলিকপ্টারগুলো কেনার, চুক্তিপত্র সই করেন ইউপিএ সরকারের প্রতিনিধিরা, তখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
ফেব্রুয়ারি, ২০১৩তেই আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ঘোটালার কথা মিডিয়াতে আসতে থাকে, বিরোধীরা অভিযোগ তুলতে থাকেন। সুষমা স্বরাজ বলেন, ইতালির মহিলা কেবল টাকা খাচ্ছেন তাই নয়, দেশের প্রতিরক্ষার সঙ্গেও ছেলেখেলা হচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ কংগ্রেস সরকার এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে, একটা এফ আই আর করা হয়, এবং এই মামলা সিবি আই এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস সরকার জেপিসি, জয়েন্ট পার্লিয়ামেন্টরি কমিটি তৈরি করার কথা বলেন, বিরোধীরাও এই দাবি তুলেছিলেন। বিজেপি পরে এই জেপিসিতে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তাদের দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদত্যাগ।
১ জানুয়ারি কংগ্রেস সরকার আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের চুক্তি বাতিল করে, ইতিমধ্যে তাদের কাছ থেকে তিনটে হেলিকপ্টার এসেছিল, তাদেরকে মোট ১৬২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, এই চুক্তি মত ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলোর কাছে, ২৪০ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দিয়েছিল, তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইউপিএ সরকার আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড মামলা ইন্টারন্যাশন্যাল কোর্টে নিয়ে যায়, মোদিজী মসনদে বসার ঠিক আগেই ২৩ মে ২০১৪তে সেই মামলায় জিতে, ইন্টারন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি হিসেবে রাখা ২২৮ মিলিয়ন ইউরো, বাজেয়াপ্ত করা হয়। টাকার হিসেবে, আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের কাছ থেকে ভারতের সরকার আদায় করে, ২০৬৮ কোটি টাকা। এছাড়াও তাদের পাঠানো তিনটে হেলিকপ্টার তো ভারতের কাছেই ছিল, সেটাও রেখে দেওয়া হয়, যার একেকটার দাম ছিল ২৯৫.৫ কোটি টাকা, তিনটের দাম, ৮৮৬.৫ কোটি টাকা, যার জন্য ওদেরকে দেওয়া হয়েছিল ১৬২০ কোটি টাকা, ২০১৩ তেই আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়েছিল।
এরপর মহান চওকিদার মসনদে এলেন, ২২ জুলাই ২০১৪, মোদিজী আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে ব্ল্যাক লিস্ট, কালো তালিকা থেকে মুক্ত করলেন, কদিন আগে যে কোম্পানি সোনিয়া, রাহুল গান্ধীকে ঘুষ দিয়েছে, সেই কোম্পানিকে মোদিজী কালো তালিকা থেকে বের করে আনলেন, কেন? কাকে খাওয়াতে? কী খাওয়াতে? এইবার নতুন খবর হাজির। ক’দিন আগে ইতালিতে পোপের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করতে দেখেছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে, যাঁর মন্ত্রীসভায় গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন আর তাঁর দু সন্তানকে, পুড়িয়ে মারার কারিগরও সামিল, তিনি এই নৌটঙ্কি করলেন স্রেফ গোয়া বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে।
সে যাই হোক, সেই রোমে কেবল পোপের সঙ্গে দেখা করেছেন এমনতো নয়, তিনি আমাদের দেশের বিদেশমন্ত্রী, এস জয়শঙ্কর, এন এস এ প্রধান দোভাল সাহেবকে নিয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করলেন, সেখানে আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, তাদের প্যারেন্ট কোম্পানি লিওনার্দো স্পা, যার আগে নাম ছিল ফিনমেকানিকা, সে নিয়েও কথা হল। মোদিজী দেশে ফিরলেন, এবং জানানো হল আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড আবার হেলিকপ্টার সরবরাহ করতে পারবে, এবার তো প্রশ্ন করতেই হচ্ছে, সব্বাই তো অক্ষয় কুমার নয়, আম চুষে খান না গিলে খান না কামড়ে খান গোছের প্রশ্ন করবেন, আমরাও আছি। আমরা প্রশ্ন করছি, গোপনে কী আলোচনা হল, মোদিজী? কিভাবে দুর্নীতির কাদা মাখা আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, রাতারাতি সফেদ হয়ে গেল? কোন ডিটারজেন্টে? তারাও কি বিজেপি জয়েন করলো? আমরা প্রশ্ন করছি, গোপনে কী আলোচনা হল, মোদিজী? গোপন আলোচনার রফাসূত্রটা জানান।
প্রশ্ন দুই, যে কোম্পানি ঘুষ দিয়েছে, আপনাদেরই অভিযোগ, যে কোম্পানি দুর্নীতিতে লিপ্ত, আপনারই অভিযোগ তাকে ছাড় দিলেন কেন? না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা, তাহলে কি জুমলা ছিল? ওটাও জুমলা?
প্রশ্ন তিন, আপনি আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ডকে ছাড় দিলেন, ওদিকে তদন্ত তো এখনও চলছে, সেটার কী হবে? সেই ধ্যাস্টামিগুলোও বন্ধ করুন, ওসব নৌটঙ্কি দিয়ে হবেটা কি?
প্রশ্ন চার, এবার যে টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, ওই ফিনমেকানিকার কাছ থেকে, তা কি ফেরত দেওয়া হবে? আমাদের ট্যাক্সের পয়সা থেকেই ফেরত দেওয়া হবে? এখানেই শেষ নয়, ফরাসি ডিজিটাল মিডিয়া মিডিয়াপার্ট নতুন তথ্য হাজির করেছে, রাফাল জেট কেলেঙ্কারিতে ভুয়ো বিল দেখিয়ে টাকা নয় ছয় করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ, ৬৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এক দালালকে, তার নাম সুষেণ গুপ্তা, সদগুরুর ভক্ত, তাঁর সঙ্গে ছবি আছে, বিজেপির ওপরতলার লোকজনদের সঙ্গে দহরম মহরম আছে, তিনি মরিসাসে এই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, মরিসাস সরকার এই টাকা পাচারের খবর পেয়ে, আমাদের দেশের সরকারকে তথ্য ও প্রমাণ দিয়েছিল, দেশের সরকার তা চেপে গেছে, কারণ সরকারের প্রধান, দেশের চওকিদার খাবেন না, খেতে দেবেনও না, মুখে বলেন বটে কিন্তু কাজে? কাজে তো বোঝাই যাচ্ছে। এবং আগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেনার ক্ষেত্রেও, এই সুষেণ গুপ্তার নাম আছে, তিনিও নাকি কিক ব্যাক পেয়েছিলেন। কে এই সুষেণ গুপ্তা? কেবল কিছু বিজেপি নেতা আর জগগি বাসুদেব সদগুরুর চ্যালা হলেই তো এতবড় কাজে হাত দেওয়া যায় না, তাহলে ইনি কে? কিছুদিন পরে সে তথ্যও বের হবে।
আপাতত যে খবর ভাসছে, ইনি এক ফড়ে মিডলম্যান, পেছনে আমাদের চওকিদারের পরিচিত এক গুজরাটি ব্যবসায়ী আছেন, ৬৫ কোটি নয়, আন্তর্জাতিক আর্মস ডিল থেকে, তিনি অনেক টাকা কামিয়ে আবার নিজের ব্যবসাকে সোজা করে দাঁড় করাচ্ছেন, তাঁর ভেসে ওঠা নাকি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, কার্টসি আমাদের দেশের চওকিদার। সে খবর এলেই আপনাদের জানাবো, আপাতত জানিয়ে রাখি চুরি হয়ে যাচ্ছে রাজকোষে, যেখানকার এক একটা টাকাতে লেগে আছে দেশের শ্রমিক, কৃষক, মজুরের ঘাম আর রক্ত।
চিৎকার করে বলুন, রাজা তুই নাম, তুই চোর, তুই উলঙ্গ।