এমনিতে শেয়ালরা দল বেঁধে থাকে, রাত নামলে হুক্কা হুয়া বলে ডাকে। গ্রামের ধারে একটু জঙ্গল, আদাড়, ঝোপঝাড়, নদী কাঁদরের ধারে ঘোরা ফেরা করে শিকারের জন্য। কিন্তু একটু বয়স্ক, কিম্বা ল্যাংড়া কিছুটা অসহায় কিন্তু ধূর্ত শেয়ালেরা একলা ঘোরে, তাদের ডাক একটু আলাদা হয়ে যায়, তারা বাঘ বা বাঘরোলদের পেছনে পেছনে ঘোরে, বাঘ বা বাঘরোল যা শিকার করে, তার উচ্ছিষ্ট খেয়ে দিন কাটায়। তাদের ডাক হুক্কা হুয়ার বদলে ফেউউউ ফেউউ এর মত শোনায়, আমরা তাদের ফেউ বলি।
তাদেরকে নিয়ে বহু গল্প আছে, বাংলা প্রবাদ আছে। ব্রিটিশ আমলে দারোগা, পুলিশের আগে যে সব ধূর্ত মানুষজন ঘুরতো, গ্রামে ঢুকে বিপ্লবীদের, বিপ্লবী সংগঠনের খবর দিত, সেই বিশ্বাসঘাতকদের ফেউ বলে ডাকা হত। অমন বেশ কিছু ফেউ, বিপ্লবীদের গুলিতে মারাও গেছে। একজনের নাম তো এখনই মনে পড়ল, নেত্র সেন। যে নাকি সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিয়েছিল, কয়েকদিন পরে ভাতটাত খেয়ে শহরে যাবার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ব্রিটিশ প্রভুরা তার জন্য কিছু উচ্ছিষ্টের ব্যবস্থাও করেছিল, সেটা আনতেই শহরে যাবার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ভাত খেতে বসেছিল, আর চাট্টি ভাত আনতে তার বৌ রান্নাঘর থেকে ফিরে দ্যাখে, নেত্র সেনের মুন্ডুটা থালার ওপরে পড়ে আছে, শেষ খাওয়াটাও শেষ হলনা তার।
স্বাধীনতার পরেও ফেউয়ের সংখ্যা কমেনি, ক্রমশ বেড়েছে, সেই সময়ে ব্রিটিশদের সাহায্যকারি, আর এস এস – বিজেপির মধ্যে প্রচুর পাওয়া যাবে, বাংলাতেও কিছু আছে। এরা দুর্বল, অসহায় কিন্তু ধূর্ত। সেই গোত্রেই পড়েন একদা খবরের কাগজ বিক্রেতা, পরে ফেউ বনে যাওয়া, সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি ফেউগিরি করেন, শুভেন্দু অধিকারি যাওয়ার আগে পৌঁছে যান, চলে আসার পরে ফিরে আসেন। মধ্যে ফেউগিরি। দেখুন ছবিটা বুঝতে পারবেন, আমাদের সাংবাদিক রিয়া মাজি গিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারির বাইট নিতে, তার কাছ থেকে আসুন প্রথমে শুনে নিই, ঠিক কী হয়েছিল।
অর্থাৎ নির্বাচনের দিন কাঁপিয়ে দেব, ঘিরে রাখবো, কলকাতা অচল করে দেবো ইত্যাদি বলার পর, বিকেলে যখন শুভেন্দুবাবু ভাতঘুম দিয়ে বের হলেন, তখন আমাদের সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করতে যায়, অনেক সময়েই সাংবাদিকরা এক্সক্লুসিভ বাইট নেবার জন্য, রাজনৈতিক নেতাকে একলা পাবার চেষ্টা করে, একলা পেলে প্রশ্ন করে, অনেক সময় রাজনৈতিক নেতারা কথা বলেন, অনেক সময় বলেন না, ভাল ভাল প্রশ্ন করলে গাড়িতে তুলে কথা বলতে বলতে চলেন, না হলে দরজা বন্ধ করে দেন, এসব তো আমাদের জানা। কিন্তু পেছনে এক ফেউ, সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় লেগে থাকবে, এটা নতুন।
তো সেই ফেউ সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিকদের কী করিতে হইবে, সেটা শেখাচ্ছিলেন, কেন আমাদের সাংবাদিক রিয়া, শুভেন্দুবাবুকে বিরক্ত করিতেছে, তাই নিয়ে তেনার কি ক্রোধ। তিনি বিচ রাস্তায় সাংবাদিকতার পাঠ পড়াতে বসে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদেরও কটা কথা বলার হক তো বনতা হ্যায়, যেহেতু আমাদের ধারণায়, আমাদের মতে উনি ফেউগিরি করছেন, তাই ওনাকে এখন থেকে আমরা ফেউ সন্ময় বলেই সম্বোধন করবো, করছি।
আরও পড়ুন-চতুর্থ স্তম্ভ: জলজন্তু
সাংবাদিকদের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, তাই নিয়ে জ্ঞান দিতে নেমেছেন ফেউ সন্ময়বাবু, যিনি আগে খবরের কাগজ বিক্রি করতেন, ইদানিং ফেউগিরি করেন। উনি ক্ষিপ্ত, কেন? কারণ আমরা মানে আমাদের সাংবাদিক, রিয়া কেন শুভেন্দুবাবুর গাড়িতে ঢুকে প্রশ্ন করছেন? আরও ভাল করে বলতে হলে ওনার বাবু, বাঘ নয় বাঘরোল শুভেন্দুবাবুকে প্রশ্ন করা হচ্ছে কেন? এটাই ওনার প্রশ্ন।
আসলে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করবে, এটা ওনার বাবুর বাবু, ওনার বাবুর দলের না পসন্দ, কখনও দেখেছেন? নরেন্দ্র মোদীকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে? কিছু ফাসিস্টদের বাদ দিলে, পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধান, আমাদের দেশের প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন, তাদের ভাল মন্দ প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন, কখনও মেজাজ গরম করেন, রেগে যান, কিন্তু নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদী কখনও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না, সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, এটা ওনার রীতি। এক্ষেত্রে ওনার আইডল হলেন হিটলার, যিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেন না, নরেন্দ্র মোদী দুটো কারণে সাংবাদিকদের সামনে যান না, প্রথম কারণ হল, সীমাহীন মূর্খতা, মিথ্যে কথা বলার অভ্যাস, আর দ্বিতীয় কারণ হল সীমাহীন অহংবোধ, আত্মম্ভরিতা। ফেউ সন্ময়বাবু, যিনি আবার নিজেকে সাংবাদিকও বলেন, তিনি কোনওদিন ঐ নরেন্দ্র মোদীকে এই প্রশ্নটা করেছেন? তিনি কেন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না, এই প্রশ্ন করেছেন? করেন নি। উচ্ছিষ্ট জুটবে না, সেই কারণেই তো? দেশের মাথায় বসে আছে যে আত্মম্ভরী, মিথ্যেবাদী রাষ্ট্রপ্রধান, তাঁকে একটাও প্রশ্ন কখনও করেছেন? জিজ্ঞেস করেছেন, জি মেল চালু হবার আগে, তিনি কী করে ফোটো মেইল করেছিলেন আদবানীজিকে?
জিজ্ঞেষ করার ধক আছে, কিভাবে তিনি পুকুর থেকে মগরমচ্ছ মানে কুমীর ধরেছিলেন? কোন কায়দায়? জিজ্ঞেস করেছেন, সেই মোদিজী যে স্টেষনে চা বিক্রি করতেন বলে দাবি করেন, সেই স্টেষনটা খুঁজেই পাওয়া যায় না কেন? ফেউ সন্ময়বাবু জিজ্ঞেষ করেছেন কখনও যে “এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স” বস্তুটা কী?
সাংবাদিকদের কাজ ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, তো ফেউ সন্ময়বাবু, যিনি অন্য সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার পাঠ পড়াতে আসছেন, তিনি নিজে এই প্রশ্নগুলো কখনও করেছেন? করেন নি, কারণ উচ্ছিষ্টভোগী, পড়ে থাকা রক্ত, হাড় আর চামড়ায় জীবন চলে তাই, তাই সেখানে প্রশ্ন না করে, এক সাংবাদিককেই প্রশ্ন করছেন।
আরও পড়ুন-চতুর্থ স্তম্ভ : বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ
দ্য ইকনমিস্ট ইন্টলিজেন্স ইউনিট ২০২০ র রিপোর্ট, আমাদের গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ, ২০১৪ তে মোদিজী যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন ছিল ২৭ নম্বরে, ২০২০তে? ৫৩ নম্বরে। ফেউ সন্ময়বাবু কোনও প্রশ্ন করেছেন? ফ্রিডম হাউস, ফ্রিডম অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০২১, মোদিজী ক্ষমতায় যখন এলেন, সেই ২০১৪ তে ৪৯, মানে স্বাধীন, ২০২১ এ আংশিক স্বাধীনতা, ফেউ সন্ময়বাবু জানেন? প্রশ্ন করেছেন? দেশে বিদেশে প্রত্যেক সমীক্ষায় ভারতবর্ষ পিছিয়ে পড়ছে, ক্ষুধা বাড়ছে, গণতন্ত্র কমছে। একদা খবরের কাগজ বেচা ইদানিং সাংবাদিক ফেউ সন্ময়বাবু কলকাতা টিভিকে প্রশ্ন করছেন, সাংবাদিকতা শেখাচ্ছেন, দেশের মধ্যে যে রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রিয় সরকারের হিসেবেই ২০২১ এ বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় প্রথম, বিহার সবথেকে শেষে আর উত্তরপ্রদেশ তলার সারিতে, ধক আছে সে প্রশ্ন করার আপনার প্রভুদের? নাকি উচ্ছিষ্ট যা আসে, তা বন্ধ হবার ভয়ে চুপ করে আছেন, তা থাকুন, সাংবাদিকতা শেখাতে আসবেন না। আপনাদের সাংবাদিকতার পাঠ আমাদের জানা আছে, আপনারা কেমন সংবাদ মাধ্যম চান, তাও আমাদের জানা আছে।
এই ফেউ সন্ময়বাবুদের, ভাল সংবাদ মাধ্যমের দুটো নামকরা হাউসের হিসেব দেখুন, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ চলছে, দেশে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরছে, নদীতে লাশ ভাসছে, সেই ২০২১ এর মে জুন জুলাই মাসে টাইমস নাউ এর প্রাইম টাইমে যে বিতর্ক সভা হয়েছে, তার হিসেব বলছে, বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার অনুষ্ঠান ৩৩ টা, সরকারের কাজের সমালোচনা একটা অনুষ্ঠানেও হয় নি, অর্থনৈতিক অধোগতি নিয়ে একটা অনুষ্ঠানও হয় নি, পেট্রল ডিজেল মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটাও অনুষ্ঠান হয় নি, সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে ৪ টে অনুষ্ঠান হয়েছে। আগস্টের হিসেব দেখুন, সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে ৩৫ টা অনুষ্ঠান, অর্থনৈতিক পতন, বেকারত্ব, লাদাখে চীনা সেনা ঢুকছে, পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটা অনুষ্ঠানও হয় নি,কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ২ টো অনুষ্ঠান হয়েছে, মুসলিম ল, ঘর ওয়াপসি, লাভ জেহাদ নিয়ে ২ টো অনুষ্ঠান হয়েছে। ফেউ সন্ময়বাবুদের পছন্দের মিডিয়া, গোদি মিডিয়া।
আরেকজনের হিসেব না দিলেই নয়, রিপাবলিক টিভি, আরররণব গোস্বামী। মে জুন জুলাইতে তেনার কলতলার ঝগড়াতে বিরোধী দলের সমালোচনা, ৪৭ টা অনুষ্ঠানে, সরকারের সমালোচনা, অর্থনীতির পতন, পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটাও নয়, একটা অনুষ্ঠান হয়েছে সুশান্ত রাজপুতের আত্মহত্যা নিয়ে। এবার আসুন আগস্ট মাসে, ৩৮ টা অনুষ্ঠান হয়েছে আর কংগ্রেসকে নিয়ে একটা, ব্যস।
এবার আসুন ফেউ সন্ময় বাবু, আমাদের হিসেব দেখুন, কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের দিনে আমাদের চ্যানেলে বিরোধীদের অবস্থান, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, নির্বাচনী হাঙ্গামা গেছে ৭৩% সময় জুড়ে, বাকি ২৭ % এ রাজ্যের শাসক দলের বিবৃতি, মুখ্যমন্ত্রীর ভোট দিতে যাওয়া ইত্যাদি। ভায় পাবেন না, ফেউ সন্ময় বাবু, কলকাতা টিভি দপ্তরে চলে আসুন, খবরের হিসেব বুঝিয়ে ভালো এক কাপ চা খাইয়ে বাড়ি পাঠাবো, না আমাদের দপ্তর থেকে কোনও উচ্ছিষ্ট চাইলেও পাবেন না, এবার নিজের চরকায় তেল দিন ফেউ গিরি করুন, উচ্ছিষ্টের ভাগ বাটোয়ারা করুন, সাংবাদিকতার পাঠ দিতে আসবেন না, খবরের কাগজ বিক্রি এক জিনিস, খবরটা না আলাদা, ফেউউউউ ফেউউউ বলে ডাকা লোকজন সেটা বোঝে না, জানেও না।