এতদিন জানা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটির জন্য প্রতিদিন দেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সায়, ১ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা খরচ হত। ওনাকে সুরক্ষা দেবার জন্য, ওনার ওপর কোনও আক্রমণ যেন না হতে পারে, ওনার চারিদিকে সুরক্ষা বলয় যেন ঠিক থাকে, ওনার নিরুপদ্রব যাত্রা এবং গমনাগমনের জন্য বছরে ৫৯২.৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়, হিসেবে দিনে ১.৬২ কোটি টাকা। ওনার জন্য, দেশের প্রধান সেবকের জন্য এক বিশেষ সুরক্ষা বাহিনী আছে, যাকে স্পেশ্যাল প্রটেকশন গ্রুপ আছে, সংক্ষেপে যাকে এস পি জি বলা হয়।
এতেও হচ্ছে না বলে জানা গ্যালো, এরও ওপরে দেশজুড়ে মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ করা হচ্ছে, এরফলে নাকি প্রধান সেবক সুরক্ষিত থাকবেন, দীর্ঘায়ু হবেন। এই মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ, কেবল বিজেপি নেতা সমর্থকরাই আয়োজন করেছেন এমনটাও নয়, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও এই যজ্ঞের আয়োজন করেছেন, দেশজুড়ে সংবাদ মাধ্যম সেই যজ্ঞের ছবি তুলে ধরছেন, আপাতত গোদি মিডিয়ায় কেবল মন্ত্রোচ্চারণ, যজ্ঞে ঘি ঢালার ছবি দেখা যাচ্ছে। ইনি ১০০০ বার জপ করলে, উনি ১ লক্ষ বার মন্ত্র জপের ঘোষণা করছেন। সংখ্যার বৃদ্ধির খবর নিশ্চয়ই পিএমও পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, বিগ বস ইজ ওয়াচিং দ্য শো, মানে ঐ মহা মৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞের খবর তিনিও পাচ্ছেন।
এ বাংলায় অবশ্য সেই হিড়িক নেই, এখানে এখন ভাটা চলছে, রোজই নকড়া ছকড়া নেতা বিধায়করাও পদত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন, শেষ খবর অনুযায়ী হিরো হিরণও নাকি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছেন, এটা নাকি দলবদলের যাত্রাপালার প্রথম অংক, প্রথম ধাপ। সে সব নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে,
আজকের আলোচনা মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ। মহর্ষি মার্কন্ডেয়, তাঁর পত্নী মরুদবতী পুত্রহীণ ছিলেন। তারা তপস্যা করেন মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন এবং এক পুত্র লাভ করেন , যার নাম হল মার্কন্ডেয়, কিন্তু মার্কন্ডেয়র বাল্যকালেই মৃত্যুযোগ ছিল। অভিজ্ঞ ঋষিদের কথায় বালক মার্কন্ডেয়, শিবলিঙ্গের সামনে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে লাগলেন, যথা সময়ে যমরাজ এলেন। কিন্তু মহাদেবের শরণে আসা প্রাণ কে হরণ করবে? যমরাজ পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন, মার্কন্ডেয় মহাদেবের বরে দীর্ঘায়ু লাভ করলেন। পরে তিনি মার্কন্ডেয় পুরাণ রচনা করলেন।, সেই পুরাণে সেই মন্ত্রও দেওয়া আছে, ওঁ ত্র্যম্বকম যজামহে সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনম্।উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যৌর্মুক্ষীয় মামৃতাত্।।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না
ব্যস একশো, হাজার বা লক্ষবার জপ করুন, মৃত্যু আপনার দোরগোড়া থেকে ফিরে যাবে। সমস্যা হল, দেশে যখন করোনায় লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, নদীর জলে লাশ ভাসছে, অক্সিজেন না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে ফুটপাথেই মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন বিজেপি নেতা, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা এই মন্ত্র জপ করেন নি, করেন নি তাঁদের জন্য, সেই সব অসহায় মানুষের জন্য, যাঁদের সুরক্ষার জন্য এক পয়সারও বরাদ্দ নেই, সেই হিন্দুত্বের পোস্টার বয় কনফোড় যোগী বসেন নি যজ্ঞ করতে উত্তরপ্রদেশে, যখন মানুষ মরছে, দেশের সেই ধ্যানমগ্ন প্রধান সেভকও বসেন নি এই যজ্ঞে, যাঁদের পেছনে পেছনে অক্সিজেন আর রক্ত, ডাক্তার আর প্রায় একটা গোটা অপারেশন থিয়েটার নিয়ে এস পি জি ঘুরে বেড়ায় না, না তাদের জন্য, তাদের আয়ুবৃদ্ধির জন্য মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ করা হয় নি। সেই সব ডাক্তার স্বাস্থ কর্মচারীদের জন্য করা হয়েছিল? যাঁরা মৃত্যুকে বাজি রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন? দেশের সেই সব জওয়ানদের জন্য এই যজ্ঞ করা হয়েছিল? যাঁরা মাইনাস ৪৫ কি ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস টেম্পারেচারে, কালাসনিকভ নিয়ে দেশ পাহারা দিচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন? কার্গিল যুদ্ধের সময় করা হয়েছিল? যখন দেশের জওয়ান রা মারা যাচ্ছেন? করা হল কার জন্য? যাঁর প্রতিদিনের সুরক্ষার খরচ ১.৬২ কোটি টাকা, বছরে ৫৯২.৫ কোটি টাকা, ভাবা যায়?
আমি এই মন্ত্র তন্ত্রে বিশ্বাস করি না, অনেকেই করেন না, আবার বহু বহু মানুষ করেন, এটাও সত্যি। কিন্তু যারাই করুক, ঐ বিজেপি নেতা, মুখ্যমন্ত্রী, মোটাভাই বা দেশের প্রধান সেভক কিন্তু বিলকুল বিশ্বাস করেন না, করলে ৫৯২ কোটি টাকা খরচ করতেন না, কেবল মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দিয়েই মৃত্যু ঠেকানো যায়, এই বিশ্বাস থাকলে ২৪ কোটি টাকার দুটো বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি কেনা হত না, তাঁকে ঘিরে বহুস্তরীয় সুরক্ষা বলয় তৈরি হত না, তাঁরা এসবে বিশ্বাস করেন না, এটা দিনের আলোর মত পরিস্কার।
তাহলে? তাহলে এই মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞের আয়োজন কেন? বিশ্বাস করেন না, অথচ এই ভড়ং এর দরকার হচ্ছে কেন? কারণ তাঁদের দেশ জুড়ে এক হিন্দু উন্মাদনার দরকার, এক প্রবল হিন্দুত্বের যজ্ঞশালা যা তাঁদের ভোট ব্যাঙ্ককে অটুট রাখবে, হিন্দু ভোটের মেরুকরণ ঘটাবে, তাই এই যজ্ঞ, প্রধান সেভকের জান বাঁচাতে নয়, গদি বাঁচাতেই এই বিশাল আয়োজন।
এবার পরিপ্রেক্ষিতটা একটু দেখে নেওয়া যাক, ছোটা মোটাভাই মাঝে মধ্যেই ক্রোনলজির কথা বলেন, আসুন সেই ক্রোনলজিটাই একটু দেখা যাক। প্রধানমন্ত্রী পঞ্জাবে আসছেন, এ তো সব্বার জানাই ছিল, বিজেপি হেরে যাওয়া নির্বাচনকেও সিরিয়াসলি নেয়, তিনি আসবেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপটেন অমরিন্দর সিংকে পাশে নিয়ে বসবেন, যদি তিন চারটে থেকে পাঁচ ছ টা আসন পাওয়া যায়, পঞ্জাবে তার বেশি যে আসবে না, তা বিজেপির ছোট বড়, মেজ সেজ নেতারা বিলক্ষণ জানেন। তো প্রথম খবর দিলেন পরধান সেভক নিজেই, উনি সেই গোত্রের নেতা যিনি প্রচারের আলোর সবটুকু শুষে নিতে চান, তো সেই তিনি টুইট করে জানালেন, আসিতেছি, আমি আসিতেছি। ৩রা জানুয়ারি পি আই বি, প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর টুইট থেকে জানা গ্যালো তিনি পঞ্জাবে আসছেন, জানা গ্যালো কোথায় কোথায় যাবেন, সেখানে আমাদের পরধান সেভক যে হুসেইনিওয়ালা যাবেন, ফিরোজপুরের হুসেইনিওলা, কেন? ঐখানেই ভগৎসিং, শুকদেব আর রাজগুরুর দেহ পোড়ানো হয়েছিল, সেখানেই এক স্মারকে মালা দিতে যাবেন, তারপর জনসভাও আছে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : বিজেপির নির্বাচন স্ট্রাটেজি
ভগৎ সিং, যিনি লিখেছিলেন, কেন আমি নাস্তিক, ছোট্ট পুস্তিকা, সে সব আমাদের এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স পড়া মিথ্যেবাদী প্রধানমন্ত্রীর পড়া নেই, তো তিনি হুসেইনিওলা যাবেন, সে খবর কিন্তু সেইদিনের ঘোষিত কর্মসূচিতে নেই, ৫ জানুয়ারি স্বয়ং পরধান সেভক টুইট করে জানালেন, পঞ্জাব আসছি, সেখানেও হুসেইনিওয়ালার কোনও উল্লেখ নেই, অথচ পঞ্জাবে নেমেই হুসেইনিওয়ালাতে যাবার পরিকল্পনা হল, কবে হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত? কে নিল এই সিদ্ধান্ত? প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষার দায়িত্ব এস পি জি র, তিনি যেখানেই যাবেন, সেখানে হপ্তা খানেক আগেই অ্যাডভান্স টিম পৌঁছে যায়, তারা সমস্ত রাস্তা, প্রত্যেক সভাস্থল স্যানিটাইজ করেন, করার কথা। তাদের কি জানা ছিল প্রধানমন্ত্রী হুসেইনিওলা তে যাবেন?
এই এস পি জি তৈরি হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, সংসদে বকায়দা বিল এনে, এই স্পেশ্যাল প্রটেকশন গ্রুপ তৈরি করা হয়, তখন এই সুরক্ষা কেবল প্রধানমন্ত্রীর জন্য ছিল না, ২৫ নভেম্বার ২০১৯ এ সংসদে এক বিল এনে এস পি জিকে কেবলমাত্র, কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর জন্য রাখা হয়, তাঁদের দায়িত্ব তাঁর সুরক্ষার ব্যবস্থা করা, তিনি যে রুট দিয়ে যাবেন, সেখানকার খবর নেওয়া, এমনকি আবহাওয়ার খবরও রাখা, সেদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী যখন ভাটিন্ডায় আসছেন, তখন কি পঞ্জাবের আবহাওয়ার খবর এস পি জি র কাছে ছিল না? যদি থাকে তাহলে ব্যাক আপ প্ল্যান কী ছিল? কারণ তার আগের দিন থেকেই, পঞ্জাব জুড়ে বৃষ্টি চলছে।
মোদিজি ভাটিন্ডায় নামলেন, নামার পরে জানা গ্যালো তিনি হুসেইনিওলায় যাবেন। হেলিকপ্টারে যাওয়া সম্ভব নয়, খারাপ আবহাওয়ার জন্য তিনি গাড়িতে চেপেই ঐ ১২০ কিলোমিটার যাবেন, ঐ ১২০ কিলোমিটার রাস্তার সুরক্ষার ব্যবস্থা কি ছিল? এস পি জি কী বলছে? জানা নেই।
তাদের ব্লু বুক আমাদের সামনে নেই, পাওয়াও যাবে না কারণ এস পি জি রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট এর বাইরে, এরপর তিনি গাড়িতে করে রওনা দিলেন, মাঝপথে জানা গ্যালো রাস্তায় প্রতিবাদী কৃষকরা ধরণা দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি ২০ মিনিট এক ফ্লাই ওভারে দাঁড়িয়ে রইল? কেন রইল?
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: বিচারপতি তোমার বিচার করবে কারা?
পৃথিবীর কোন সিকিউরিটি ফোর্স প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির গাড়ি বাঁ কিবা ডানধার ঘেঁসে দাঁড় করায়? চিরকাল তা মধ্যে থাকে, এখানে ব্রিজের ধার ঘেঁষে দাঁড় করানো হল। কেন তাঁর গাড়ির কাছে বিজেপি কর্মী নেতারা ভিড় করলেন? কেন তাঁদের সামনে আসতে দেওয়া হল? কোনও উত্তর নেই।
২০ মিনিট পর প্রধানমন্ত্রী ফিরে এলেন ভাটিন্ডা এয়ারপোর্টে, কেন? অন্য কোনও রুট কি ছিল না? জানা নেই। এবার জানা গ্যালো, তিনি নিজেই রাজ্য সরকারের অধিকারীকে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাবেন, আমি বেঁচে ফিরে এসেছি। কাকে বললেন? এটা কি অভিযোগ না জুমলা? কাকে বা কাদের বললেন? তাঁর প্রাণের ওপর কেমন আক্রমণ হয়েছিল? জানা নেই।
কিন্তু ঘন্টা খানেক পর থেকে এটাই গোদি মিডিয়ার হেড লাইন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছি, এস পি জির কজন আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে? কি ধরণের তদন্ত শুরু হয়েছে বোঝার আগেই শুরু হয়ে গ্যালো আরেক নাটক, মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ।
আমরা খোলা চোখে যা দেখলাম, তা হল প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি ফ্লাই ওভারে ২০ মিনিটের মত দাঁড়িয়ে রইল, হুসেইনিওলায় বিজেপির বিশাল জনসভাতে ১০০০ জনও নেই, বসে আছেন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং। দেখলাম কৃষকরা শ্লোগান দিচ্ছেন, শুনলাম প্রধানমন্ত্রী প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন। দেখলাম, নগরে নগরে, রাজ্যে রাজ্যে মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ চলছে।
আমাদের কাছে এটা ভারি পরিস্কার, এই মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ আসলে বিজেপির গদি বাঁচানোর জন্যই আয়োজিত হয়েছে, কারোর প্রাণ বাঁচানোর জন্য নয়, মিডিয়ার প্রশ্ন করার কথা এস পি জি চিফকে, সেদিন এস পি জির দায়িত্বে থাকা, অফিসারদের সাসপেন্ড করার কথা, সে সব কিছুই না করে মিডিয়া চলে গ্যালো মন্দিরে, সারা দেশকে মন্দিরে পাঠানো হচ্ছে, যখন দেশের দরকার ক্ষেত, কারখানা, চাকরি, খাবার, বাসস্থান, এটাই আপাতত বিজেপির স্ট্রাটেজি, এটাই তাদের পরিকল্পনা।
বুঝুন, আর জনে জনে বোঝান।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ভারত আমার ভারতবর্ষ