খাতায় কলমে নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) ছাড়া আর কোনও বড় দল এনডিএতে নেই৷ শিবসেনা বা অকালি দলের মতো পুরনো সহযোগীরা কবেই ছেড়ে চলে গিয়েছে৷ ভারে নীতীশের দল এখনও খাতায় কলম আছে বটে৷ কতদিন থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷ ওডিশার বিজেডি বা জগন রেড্ডির দল খাতায় কলমে এনডিএতে নেই৷ তারা ঘোষিতভাবে বিজেপি বিরোধীও নয়৷ কিন্তু বিজেপি চাইলেই সোনামুখ করে সমর্থন করবে, এমনও নয়৷ তারা তাদের পাউন্ড অফ ফ্লেশ বুঝে নিয়েই সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেবে এবং সেই প্রতিশ্রুতিও সাময়িক৷ কাল আবার অন্য কোনও ইস্যুতে নতুন বার্গেনিং শুরু হবে৷ এবারেও তারা তাদের বার্গেনিং চালিয়ে যাচ্ছে, সিদ্ধান্তে আসেনি বলাই বাহুল্য। এনডিএর সব এমপি, এমএলএ মিলিয়েও কিছু ভোটের ঘাটতি তো আছেই৷ সেই ঘাটতি পূরণ করে নিজেদের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিতিয়ে নিয়ে আসাটা বিজেপির কাছে একটা টাস্ক, একটা চ্যালেঞ্জ৷ আবার বিজেপি বাদ দিয়ে বা এনডিএকে বাদ দিয়ে প্রত্যেকটা দলকে সঙ্গে নিয়ে, এক সম্মিলিত বিরোধী প্রার্থীকে জিতিয়ে নিয়ে আসাটাও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিরোধীদের জেতার সম্ভাবনা? প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ এনডিএ পিছিয়ে মাত্র ১.২% ভোটে। ওদিকে হাজার একটা সিবিআই, ইডির কেস নিয়ে ব্যস্ত অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সেই জগন রেড্ডির দলের কাছেই আছে ৪% ভোট৷ এতদিন ধরে কেন্দ্রের সঙ্গে কোনও ঝামেলা না করেই রাজ্য চালানোর অভিজ্ঞতা আছে নবীন পট্টনায়কের৷ সেই বিডেডির কাছে আছে ৩% ভোট। কাজেই রাষ্ট্রপতি হবে বিজেপির বা এনডিএ র প্রার্থীই।
কিন্তু বিরোধীরা এই লড়াই ছেড়ে দেবে? তা তো হয় না৷ তাদের মধ্যেও কথা হচ্ছিল৷ সোনিয়া শরদ পাওয়ারকে ফোন করলেন আপের সঞ্জয় সিং৷ তিনি পাওয়ারের বাড়িতেই চলে গেলেন৷ সোনিয়া ইয়েচুরিকে ফোন করলেন৷ এইসব তা না না না চলছিল, কে বাঁধিবে ঘন্টা, কারণ ওধারে মিসাইল রেডি৷ ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স, ভিজিল্যান্স রেডি। খেয়াল করে দেখুন গত মাস থেকে এই মিসাইলের আনাগোনা বেড়েছে, সর্বত্র। এই বাংলা থেকে কেরালা থেকে মহারাষ্ট্র, এক ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় রাহুল গান্ধীকে যতবার ইডি দফতরে জেরা করতে ডাকা হল, ততবার, তত সময় ধরে বিজয় মালিয়াও কোর্টে হাজিরা দেননি৷ পিনারাই বিজয়ন নাকি সোনা পাচার করেছেন, আর এ রাজ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির বাইরে একটা ইডি দফতর, বা অন্তত ইডি অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলে, ওনাদের সুবিধে হত। তো আলোচনা চলছিল৷ কিন্তু কংক্রিট কোনও স্টেপ কে লইবে? এ নিয়েও কথা হচ্ছিল। তো এরমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে বসার ডাক দিলেন, সব্বাইকে। কংগ্রেস, বাম দল থেকে আরজেডি, এসপি, ডিএমকে, টিআরএস, অবশ্যই এনসিপি, শিবসেনাকেও। চিঠি যাওয়া মাত্র রেগে আগুন তেলে বেগুন, কে? সীতারাম ইয়েচুরি। কেন? তিনি প্রথমে জানালেন ওই ১৫ তারিখেই, হ্যাঁ ১৫ তারিখেই কংগ্রেস এবং কিছু দল নাকি এই বিষয় নিয়ে বৈঠকে বসবে বলে ঠিক করেছিল, তাই নাকি? কই কমরেড, আমরা মানে সাংবাদিকরা এরকম কোনও খবর পাইনি কেন? ওই বৈঠক কি গোপেন দার ডাকা? মানে গোপন বৈঠক? কালো চাদর মুড়ি দিয়ে আসতেন রাজনৈতিক দলের নেতারা, দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য গোপন বৈঠক? তা সেই বৈঠকের কথা তৃণমূল কংগ্রেসকে ডাকা হয়েছিল? মানে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে না ডেকেই বিরোধী ঐক্য হয়ে যেত? হওয়া সম্ভব?
বিপ্লবী পার্টির মুখপত্র গণশক্তিতে লেখা হল, এ এক ষড়যন্ত্র নয় তো? বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে, বিজেপিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে তৃণমূল৷ অতএব আমরা যাচ্ছি না। ইতিমধ্যে সোনিয়া গান্ধী হাসপাতালে, রাহুল দু’বেলা ইডি দফতরে৷ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল, তারা বৈঠকে যাবে৷ এসপি, ডিএমকে, আরজেডি, এনসিপি, ন্যাশন্যাল কনফারেন্স আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তাঁরা যাবেন৷ তাঁদের প্রতিনিধিরা যাবেন৷ অতএব প্রথমে সিপিআই, তারা অনেক বেশি প্রাক্টিক্যাল, তারা জানিয়ে দিলেন, তাঁরা যাচ্ছেন৷ এবার একলা জগাই সিপিএম, এতক্ষণে বুঝেছে, না গেলে আরও বিচ্ছিন্নতা বাড়বে৷ তাঁরা জানালেন, পদ্ধতিগত সমস্যা থাকলেও, মাথায় রাখুন নীতিগত সমস্যা নেই৷ পদ্ধতিগত সমস্যা আছে, কেন আরও আগে মিটিং ডাকা হল না, কেন সবার সঙ্গে আলোচনা করে মিটিং ডাকা হল না, কেন সব্বার সঙ্গে আলোচনা করে মিটিং এর ডেট এবং ভেনু, বৈঠকের জায়গা স্থির করা হল না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু সিপিএম এই নীতিগত প্রশ্ন একবারও তোলেনি যে, আসলে বিজেপিরই এক দোসর, আদতে বিজেপিরই সহযোগী তৃণমূল দলের ডাকে বিরোধী বৈঠকে যাব কেন? না, ওসব কথা বাংলার মানুষ আর বাংলার বিপ্লবী ক্যাডারদের জন্য রাখা থাক, সবাই যাচ্ছে, আমরাও যাবো। কিন্তু ওই যে, যে হাতে পুজি আমি দেব শূলপাণি..সেই হাতে নাহি পুজি চেঙ মুড়িকাণি। তাই সীতারাম ইয়েচুরি বা ডিরাজা নয়, এলেন সিপিএম এবং সিপিআই দলের এমপি, এলারামন করিম, বিনয় বিশ্বম। আরেক বিপ্লবী দল আরএসপি জানিয়েছিল, তারা আসবে না৷ সি পি আই, সিপিএম এর বিবৃতি আসার পর তারাও জানিয়েছেন তাঁরা আসবেন, এসেছিলেন। আসেননি কারা? হঠাৎ করেই মাঝপথে উধাও হল আপ, যারা গতকাল পর্যন্ত জানিয়েছিলেন আসবেন৷ তাঁরা আসেননি। টিআরএস দলের কেউ আসেননি৷ জানিয়েছেন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও মঞ্চে তারা থাকবেন না। বিজু জনতা দলের তরফে কেউ আসেননি৷ কেউ কোনও কথাও বলেননি৷ এঁরা সব ক্ষেত্রেই জল মাপেন৷ এখনও জল মাপছেন৷ বহুজন সমাজ পার্টি মানে মায়াবতীর পার্টি কী করবে, করতে পারে, তা নিয়ে তাবড় সাংবাদিকরা কথা বলা বন্ধ করেছেন অনেক আগেই৷ তবে আপাতত তাদের তরফে কোনও কথা বলা হয়নি৷ অকালি দলেরও কেউ আসেননি। সব মিলিয়ে না আসার তালিকাও কম ছোট নয়৷
বৈঠকের আগের দিন রাতেই শরদ পাওয়ার জানিয়েছেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে রাজি নন৷ এই কথাকে এই ভাবে দেখুন, উনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ভোটে দাঁড়িয়ে হারতে রাজি নন৷ সাফ কথা, জেতার সম্ভাবনা থাকলে? উনিই দাঁড়াতেন। কেন জেতার সম্ভাবনা নেই? অঙ্ক বলছে, একটু হলেও পিছিয়ে এনডিএ৷ কিন্তু এনডিএতে নেই বা এনডিএ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আকচা আকচি, তাদের রাজনৈতিক অঙ্কের যোগ বিয়োগ, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে দিচ্ছে না, ভবিষ্যতেও দেবে বলে মনে হয় না। সমস্যাটা কোথায়? সিপিএম, সিপিআই মমতা বা মমতা কংগ্রেস ইত্যাদি সমস্যা নয়৷ কেন নয়? কারণ জমিতে সিপিএম বা বাম দলের সঙ্গে, কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার লড়াই কোথায়? মমতা লড়ছেন বিজেপির সঙ্গে। তাহলে এই বিরোধিতা কিসের?
এটা খানিক পুরনো দাদ হাজা চুলকানি বলা যায়, এতদিনের অভ্যেস, ক্যাডারদের বলবে কী? সেই অসূয়াকে তত্ত্ব ইত্যাদি দিয়ে ব্যাখ্যা করার যতই চেষ্টা হোক না কেন, ওটা বিশুদ্ধ অসূয়া, নিজেদের বৃহত্তম রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ওসব অসূয়া কেটে যায়৷ যেমনটা গতকাল দেখলাম। অন্যদের তা নয়, তেলেঙ্গানায় তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি লড়ছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, জমিনি লড়াই, বিজেপিও উঠে আসছে৷ এর মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে গা ঘেঁসাঘেসি অন্য মেসেজ দেবে৷ আম আদমি পার্টি গুজরাতে কংগ্রেসকে সরিয়ে জিততে না পারলেও দ্বিতীয় স্থান চায়৷ পঞ্জাবে লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে৷ বিজু জনতা দলের মোটো হল জিও আউর জিনে দো৷ তোমরা লোকসভায় থাকো, আমাদের ওদিকে কোনও ইন্টারেস্ট নেই৷ আমরা রাজ্য চালাব৷ কেন্দ্রে আম আদমি পার্টি বা ডিএমকে ক্ষমতায় এলেও একই বক্তব্য থাকবে৷ মায়াবতীর বিএসপি আপাতত উত্তরপ্রদেশের কনিষ্ঠ পার্টি৷ হাজার একটা সিবিআই, ইডি কেস ঝুলছে, তিনি চুপ। অকালি দল হল বরাবরের কংগ্রেস বিরোধী পার্টি৷ তারাও আসেনি, আসার কথাও নয়। আর এই সব ইস্যুতে বিভক্ত বিরোধী দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, এটা প্রায় অসম্ভব। তাহলে মমতা কেন করলেন, কেন ডাকলেন বিরোধী নেতাদের, তাদের এতজন এলেনই বা কেন? এবং এই বৈঠক কি তবে এক্কেবারে ফালতু? না, বরং উল্টোটা৷ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটা একটা সাময়িক ইস্যু৷ এই বৈঠকে বিরোধী শিবিরের একটা বড় অংশ এক জায়গায় এলেন৷ এবার যদি অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে, মোদী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি জ্বলন্ত ইস্যুতে রাস্তায় নামেন, মিছিল করেন, জেল ভরো আন্দোলন হয়, সত্যাগ্রহ হয় সারা দেশ জুড়ে, তাহলে ওই ইডি, ইনকাম ট্যাক্স আর সিবিআই-এর ভেঁপু বাজানো বন্ধ হবে৷ দেশের মানুষ লড়াই এর ময়দান থেকে উঠে আসা এক বিকল্পকে দেখতে পাবেন৷ সম্ভবত সেটাই এই বৈঠকের বড় প্রাপ্তি হতে পারে৷ কিন্তু কেবল এই গোল টেবিল বৈঠক, কেবল আলোচনা, কেবল হাত ধরে ঐক্য বাক্য মাণিক্যতে মানুষের বিশ্বাস? সে কবেই চলে গিয়েছে। পথে নামুন বিরোধীরা, পথেই নেতা তৈরি হবে, নেতা উঠে আসবে, পথেই আছে নতুন পথের নিশানা। বিরোধী ঐক্য সোনার হরিণ নয়, অধরাও নয়, বিরোধী ঐক্য রাস্তাতেই সম্ভব।