আমরা আলোচনা করছিলাম সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে৷ যে ছবি নিয়ে বলতে গিয়ে সটান ১৮০ ডিগ্রি ডিগবাজি খেয়ে, নরেন্দ্র মোদি বাক স্বাধীনতার কথা বলেছেন, যে ছবিকে বিজেপি শাসিত রাজ্যে করমুক্ত করা হয়েছে, অসমে সরকারিভাবেই এক বেলার ছুটি দেওয়া হয়েছে, যে ছবি দেখার পর কপালে তিলক, মাথায় ফেট্টি বাঁধা গেরুয়া বা কমলা বাহিনী মুসলমান খেদাও স্লোগান দিচ্ছে, ওই হলে বসেই। যে ছবি দেখে অত্যন্ত নিরীহ, সাধারণ শিক্ষিত মানুষও বেরিয়ে এসে বলছে, এবার কাটুয়াদের শিক্ষা দরকার৷ এক ইউফোরিয়া তৈরি হয়েছে এই ছবিকে ঘিরে৷ এই ছবি নিয়ে আলোচনা করার সময়ে আমি বলেছিলাম যে এটাই প্রথম নয়, এটা শেষও নয়৷ এ এক বিরাট পরিকল্পনার অংশ৷ এক পরিকল্পনা যা সমাজের প্রত্যেক অংশকে, সে আপনি যেই হোন, আপনার রুচি যাই হোক, পেশা যাই হোক, আপনাকে এক হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্র আর তার দর্শনের বৃত্তের মধ্যে এনে হাজির করবে। এবং সেই ছকেই তৈরি হয়েছে দ্য কাশ্মীর ফাইলস, কিন্তু শুধুই কি কাশ্মীর ফাইলস? আজ তাই নিয়েই আলোচনা।
সেই কবে রামকৃষ্ণদেব বলে গিয়েছেন, থ্যাটারে লোকশিক্ষে হয়, ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটে স্টার থিয়েটারে, নয় নয় করে ৬ খানা নাটক দেখেছিলেন তিনি, কেবল দক্ষযজ্ঞ বা চৈতন্যলীলার মত ধর্মীয় বা পুরাণ বিষয়েরই নয়, অমৃতলালা বসুর লেখা বিবাহ বিভ্রাটও দেখেছিলেন, সেই সময় একদিন গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, এবার থিয়েটার ছেড়ে দেব। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, না না, ও থাক, ওতে লোকশিক্ষে হয়।
আসলে মানুষ লেখাপড়া করে যত শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে দেখে, অবজার্ভ করে। এক শিশুকে লিখিয়ে পড়িয়ে বোঝাতে হয় না, কোনটা তার মা। এক কৃষক ধানক্ষেত দেখেই বোঝে ফলন কেমন হবে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো পোশাক দেখেই বুঝে যান কে কোন ধর্মের, ঠিক এইখান থেকেই দেশে দেশে শাসকরা তাদের প্রচারে ব্যবহার করেছে নাটক, থিয়েটার, সিনেমাকে। আর এস এস – বিজেপি ও তার ব্যতিক্রম নয়, একধারে রামায়ন চলছে টিভিতে, অন্যধারে রথযাত্রা চলেছে বিজেপির, যে পথ দিয়ে গেছে সেই পথেই দাঙ্গা হয়েছে, মানুষ মরেছে।
সেই প্রচার গত ২০/২৫ বছর আরও তীব্র, আরও সংগঠিত। সোশ্যাল মিডিয়া, সিনেমাকে ব্যবহার করে কয়েকটা ন্যারেটিভ আর এস এস – বিজেপি ছড়িয়ে দিতে চায়, যা ক্রমশ সমাজকে, দেশকে এক চূড়ান্ত মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাবে। দেশ স্বাধীন হল, প্রথম দিকের সিনেমার কথা ভাবুন, সিনেমা হত ৪ ধরণের।
১) দেশাত্মবোধক, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে সিনেমা। ২) ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক সিনেমা। ৩) সামাজিক, মূলত সাহিত্য নির্ভর প্রেমকাহিনী। ৪) মানুষের লড়াই, শোষণ, শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই ইত্যাদি, এর পিছনে ছিল বামপন্থী বুদ্ধিজীবি শিল্পী সাহিত্যিকরা, পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে বলরাজ সাহানি তখন আই পি টি এ ঘনিষ্ঠ, বা কিছু কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য, ঘনিষ্ঠ লেখক পরিচালক।
এরপর সিনেমা ক্রমশঃ ক্রমশঃ মনোরঞ্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠল, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট। এর পেছনেও কি রাজনীতি ছিল না? ছিল বৈকি। সমাজ সচেতনতা থেকে সরিয়ে এনে সিনেমাকে কেবল মনোরঞ্জনের মধ্যে আটকিয়ে রাখা, ক্রমশ এক কনজিউমারিস্ট, এক ভোগবাদী সমাজ গড়ে তোলাই ছিল তার লক্ষ। কিছু সমাজ সচেতন সিনেমা হত, হয়, অন্য ঘরানার ছবি, কিন্তু মেইন স্ট্রিম ছবি সুপার স্টারের জন্ম দিল, তাদের চুলকাটা থেকে পোশাক আশাক হয়ে উঠল অনুকরণের বিষয়, এক ধরণের লুম্পেন কালচারও জন্ম নিল একই সঙ্গে। পালটা সিনেমাও তৈরি হতে থাকল, কিন্তু সে শক্তি ছিল দুর্বল, এবং দেশজুড়ে বামপন্থার পিছিয়ে পড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছিল, মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এইরকম এক মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল সিনেমা, যখন আর এস এস – বিজেপি তাদের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামল, কিভাবে?
কথা হচ্ছিল আর এস এস- বিজেপির পরিকল্পনা নিয়ে,এমন নয় যে তারা কয়েকজন চিত্র পরিচালকদের মাঠে নামিয়ে দিল৷ তারা তাদের জন্য ছবি তৈরি করা শুরু করল, না এমনটা নয়। অবশ্যই কিছু প্রোডিউসারকে তারা রাজি করাতে পেরেছিল৷ কিছু প্রোডিউসার জেলে যাবার ভয়ে, কেউ কেউ জেল থেকে জামিন পাওয়া বা ছাড়া পাওয়ার শর্তে টাকা ঢালতে রাজি ছিল৷ কিন্তু তারও আগে আর এস এস – বিজেপি কিছু ন্যারেটিভ এনে হাজির করল তাদের কাছে, সেই সব ন্যারেটিভ মিথ্যেও ছিল না, সত্যিও ছিল না, ছিল আরও ভয়ঙ্কর, অর্ধসত্য।
এমন কিছু বিষয় যা নাকি মানুষকে ভাগ করে দেবে, সমাজকে ভাগ করে দেবে। প্রথম ন্যারেটিভ, স্বাধীনতা এসেছে কংগ্রেসের জন্য নয়, কংগ্রেস বিশ্বাসঘাতক, কংগ্রেস, গান্ধী, নেহেরু আসলে মুসলমান তোষক, তাদের চক্রান্তে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সুভাষ, তাদের চক্রান্তে দেশ ভাগ হয়েছিল, তাদের চক্রান্তে খুন হয়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সম্পদ চুরি করেছেন জহর লাল নেহেরু, এই নেহেরুর ভয়ে দেশে ফিরেও লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল সুভাষ চন্দ্র বোসকে, বাংলার দাঙ্গা হয়েছিল কংগ্রেসের মদতে, কংগ্রেসের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, নাথুরাম গডসে আসলে একজন মহান দেশপ্রেমিক ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ন্যারেটিভ হল এই লিবারাল, সেকুলাররা আসলে দেশ বিরোধী৷ বামপন্থীরা দেশ বিরোধী৷ এরা দেশের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে৷ এরা শিবাজিকে অস্বীকার করে৷ ঝাঁসির রানীকে অস্বীকার করে৷ দেশের ধর্মীয় গুরুদের অস্বীকার করে৷ আসলে এরা মুসলমান তোষণ করে।
তিন নম্বর ন্যারেটিভ হল, ১৯৪৭ থেকে দেশে কিচ্ছুটি হয়নি, দেশ রসাতলে যাচ্ছিল, আমাদের এই দেশকে কেউ চিনতো না, পাকিস্থান যখন তখন উগ্রপন্থী পাঠিয়ে মানুষ খুন করতো, এই প্রথমবার এক সরকার এসেছে যারা ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, দেশের স্বাধীনতা এখন সুরক্ষিত হাতে।
এই তিনটে ন্যারেটিভর মোদ্দা কথা হল, পাকিস্থান বিরোধিতা, মুসলমান বিরোধিতা এবং দেশ আর সমাজকে, এক চূড়ান্ত মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া। গন্ডায় গন্ডায় ছবি তৈরি হতে থাকল, পুকার, গদর এক প্রেম কথা, এল ও সি কারগিল, উরি, দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক, শেরশাহ, মা তুঝে সালাম, হিন্দুস্থান কি কসম, হিরো, লাভ স্টোরি অফ এ স্পাই, সুর্যবংশী, তাসখন্দ ফাইলস, হিন্দি বাংলাতে গুমনামি, বুদ্ধ ইন অ্যা ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে, এই প্রথম একটা কাশ্মীর ফাইলস তৈরি হল তা নয়, এ এক ধারাবাহিক, গভীর পরিকল্পনার ফসল। প্রত্যেকটা ছবি অর্ধসত্য আর অর্ধমিথ্যের, এক জোরালো ককটেল, কিছু কনস্পিরেসি থিয়োরি, কিছু মুসলমান বা পাকিস্থান বিদ্বেষী আবেগ, কিছুটা জঙ্গি জাতীয়তাবাদী ধারণা মিশিয়ে এক সিনেমা, যা দেখার পরে মানুষ উদ্বেল। প্রযোজকের ঘরে টাকা ঢুকল, সঙ্গে বিজেপির রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ঢাল, পরিচালকের নাম যশও হল, সঙ্গে জাতীয় পুরস্কার, আর কী চাই?
বিজেপির মনোবাসনা পূর্ণ হচ্ছে৷ সিনেমা হলেই জয় শ্রী রাম স্লোগান, দেশ কে গদ্দারদের চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎই চায়ের দোকান থেকে পাড়ার মোড়ে সিনেমা দেখে ইতিহাসের জ্ঞান অর্জন করা মানুষজনের ভিড়, তারা বলছে দেশ ডুবেছে গান্ধী নেহেরুর জন্যে, সুভাষ চন্দ্রকে যুদ্ধ অপরাধী বলে ঘোষণা করেছিল নেহরু, কাশ্মীরে নেহেরু গান্ধী কংগ্রেস সরকারের মদতে, হিন্দু কাশ্মীরি পন্ডিতদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে মুসলমানরা৷ পাকিস্তানের জমিতে এই প্রথম সার্জিকাল স্ট্রাইক করল সরকার৷ এমনকি পরমাণু বোমা ফাটানোর সাহস তো দেখিয়েছে বিজেপি সরকার।
এসব তথ্য যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করুন, কোথা থেকে পেলেন এই তথ্য৷ তাঁরা কোনও না কোনও সিনেমার নাম বলবেন, ইতিহাস গেছে চুলোর দোরে৷ এই অর্ধসত্যের ককটেলে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে দেশ, দেশের মানুষ। উল্টোদিকে অসহায় ইতিহাসবিদেরা, সেকুলার, উদার গণতান্ত্রিক মানুষেরা, আরও অসহায় বামপন্থীরা৷ তাঁরা বুঝে ওঠার আগেই রোজ তৈরি হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য এমন ন্যারেটিভ৷ যার জন্য তাঁরা প্রস্তুত নন, প্রস্তুত ছিলেন না।
আপাতত আর এস এস – বিজেপির একটা চোখ এই বাংলার দিকে, লিখে রাখুন এরপর ছবি হবে ৪৬ এর দাঙ্গা নিয়ে, গোপাল পাঁঠা হবে তার নায়ক, দেশ বিভাজন নিয়ে, ৭১ এর বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে৷ আবার অর্ধসত্য দিয়ে তৈরি হবে নতুন ন্যারেটিভ, নতুন মিথ্যের আস্তরণ, যা আমাদের সমাজকে, বাংলার সমাজকে আরও ভাগ করবে, মেরুকরণ ঘটাবে৷ মানুষ ভুলে যাবে মূল্যবৃদ্ধির কথা, বেকারত্বের কথা, ভুলে যাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের লড়াই। তাহলে? এটাই কি ভবিতব্য?
হ্যাঁ আপাতত এই দিকেই চলেছি আমরা, আমাদের ভাবতে হবে, প্রত্যেককে, বিজেপি বিরোধী প্রত্যেককে ভাবতে হবে গভীরভাবে৷ এই ন্যারেটিভের পালটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে৷ সিনেমায়, গল্পে, প্রবন্ধে, কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে মানুষকে বলতে হবে মানব ধর্মের কথা, দেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে, আর এস এস – হিন্দু মহাসভার বিশ্বাসঘাতকতার কথা, বলতে হবে সম্প্রীতির বিরাট ঐতিহ্যের কথা। কেবল ভোটের সময় রাজনৈতিক প্রচার দিয়ে, সরকারের কিছু কাজ দিয়ে বিজেপিকে বেশিদিন রোখা যাবে না, এটা বোঝাটা জরুরি।