এটি একটি গল্প৷ কারণ কলম্বাসের জাহাজে বসে থাকা কেউই ডায়রি লেখেননি৷ কিন্তু সেই জাহাজেরই গল্প, যে জাহাজে করে কলম্বাস যাত্রা করেছিলেন ভারতের দিকে। সেই গল্প লোকমুখে ছড়িয়েছে৷ তারপর কলম্বাসের বদলে অনেক নামে সেই গল্প রটে গিয়েছে৷ কলম্বাসের বদলে এই গল্প যদি কোনওদিন রাম বা হনুমানের নামেও শোনেন, অবাক হবেন না। তো সে যাই হোক, গল্পতে আসা যাক। সাত সকাল, জাহাজের ডেকে কলম্বাস আর তাঁর ঘনিষ্ঠ জনা ছয়েক ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন৷ চারিদিকে নীল জল৷ সাহেবি ব্রেকফাস্টে ছিল ডিম সেদ্ধ৷ কলম্বাস বললেন, ভাইসব, এই সেদ্ধ খোসা ছাড়ানো ডিমের সরু দিকটা প্লেটের ওপর খাড়াই ভাবে কে রাখতে পারবে? ধৈর্যের পরীক্ষা শুরু হল, দোদ্যুল্যমান সে জাহাজে সবাই খুব সন্তর্পণে সরু দিকটাকে তলায় রেখে ডিম দাঁড় করাতে যায়, ডিম পড়ে যায়৷ খানিকক্ষণ এরকম অসফল প্রচেষ্টা চলার পর সব্বাই হাল ছেড়ে দিল৷ বলুন সাহেব, আপনিই বলুন, কী রুপে ইহা সম্ভব? কলম্বাস একটা ছুরি দিয়ে ডিমের সরু দিকটাকে একটু চেঁচে দিলেন, ব্যস, ডিম খাড়া হয়ে গেল। সব্বাই বললো, ধ্যাৎ, এতো সবাই জানে। কলম্বাস বললেন, হ্যাঁ সব্বাই জানে৷ কিন্তু সময়ে সেটা করতে পারে না৷ আমি পারি৷ তাই আমি খ্রিস্টোফার কলম্বাস।
এমন হয়, চোখের সামনে সমস্যা জ্বলজ্বল করে৷ সব্বাই জানে, সব্বাই বোঝে৷ কেউ সেই সমস্যা সমাধানে নেমে পড়ে না৷ কেউ নামলে, সব্বাই তার পিছনে দাঁড়ায়৷ কেউ কেউ অবশ্যই বলে, দুস এ আর নতুন কী৷ এ তো সব্বাই জানে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থা এক্কেবারেই এইরকম৷ ২০১৪ থেকে নির্বাচনে স্ট্রাইক রেট ১০ কি ১১%, কে জানেন না? ২০১৯ থেকে নির্বাচিত সভাপতি নেই৷ তিনি পদত্যাগ করেছেন৷ ইন্টারিম প্রেসিডেন্ট কাজ চালাচ্ছেন৷ কে জানেন না? কে জানেন না যে কেবল ব্যক্তিগত খেয়োখেয়ির ফলে হাতছাড়া হয়েছে পঞ্জাব? কে জানেন না যে দল বলছে অনেক কথা, জরুরি কথা, সত্যি কথা, কিন্তু তা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না৷ কোন কংগ্রেসী নেতা জানেন না যে কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা খারাপ৷ সংগঠনে তরুণদের হিসসেদারি নেই, কে জানেন না? ভারতবর্ষের রাজনীতি নিয়ে সামান্য জ্ঞানও যাঁর বা যাঁদের আছে, তিনি বা তাঁরা একথা জানেন। পিকে, প্রশান্ত কিশোরের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের খানিক বেরিয়ে এসেছে৷ সেখানে এ সব লেখা আছে৷ তাহলে নতুনটা কি?
নতুন হল কংগ্রেসের এই সংকট মূহুর্তে সেই কথাগুলো পরিষ্কার করে বলা৷ সেই সমস্যা থেকে এই মূহুর্তে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা৷ সমস্যাগুলোকে আলোচনার প্রথম পাতায় এনে হাজির করা৷ যেটা পি কে করতে চলেছেন। কী কী করতে চলেছেন, তা বোঝার জন্য ওনার ৫৮৫ বা ৬০০ পাতার পিপিটি না দেখেও বলাই যায়, কারণ উনি কোনও ভিন গ্রহ থেকে ফর্মুলা এনে কংগ্রেসের পুনরুত্থান করাচ্ছেন না৷ যা করছেন, তা সাধারণ জ্ঞান থেকেই করছেন। তো আমরা এই উনি কী কী করছেন, বা করতে চলেছেন, তা নিয়ে আগাম কিছু কথাবার্তা আলোচনা করব পরপর কয়েকটা এপিসোডে। আজ কথা কংগ্রেস সভাপতি নিয়ে৷
কী বলছে ইতিহাস? আজকের বাস্তব আর পিকে সম্ভবত কী করতে চলেছেন? প্রথম প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে৷ গান্ধী পরিবারের কেউই কি নেতৃত্বে থাকবেন, বিজেপির তোলা পরিবারতন্ত্রের অভিযোগের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই হবে? আসুন একটু ইতিহাসে দিকে চোখ রাখা যাক৷ সেই ১৮৮৫ থেকে এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের ৯৭ টা জাতীয় অধিবেশন হয়েছে৷ অধিবেশন থেকে ৯৭ জন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন৷ কখনও কখনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, কখনও কখনও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে৷ সভাপতি হয়েছেন ইংরেজ, খ্রিস্টান, পার্সি, ব্রাহ্ম, হিন্দু ব্রাহ্মণ, তথাকথিত হরিজন, মুসলমান এমন কী কাশ্মিরী পন্ডিত বিষণ নারায়ন দার ১৯১১ তে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ থেকে হয়েছেন, সৌরাষ্ট্র, সেদিনের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাডু থেকে হয়েছেন, বাংলা থেকে বহুবার, এবং ১৯১৯ এ প্রথমবার নেহরু গান্ধী ফ্যামিলির প্রথমজন মোতিলাল নেহরু নির্বাচিত হয়েছেন৷ নেলী সেনগুপ্ত, সরোজিনী নাইডু, অ্যানি বেসান্তের মত মহিলারা নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সমেত ৯ বার মুসলমান, দাদাভাই নৌরজি সমেত ৫ বার পার্সি মানুষজন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন৷ কিন্তু স্বাধীনতার পরে? না সেকুলার কংগ্রেসে একজনও মুসলমান সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হননি৷ সোনিয়া গান্ধীকে বাদ দিলে, প্রত্যেকে হিন্দু।
পরপর ৫ বার দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড দুজনের আছে৷ সৌরাষ্ট্রের হিন্দু নিম্ন বর্ণের নেতা ইউ এন ধেবর এর আর সোনিয়া গান্ধীর৷ এ রেকর্ড আর কারোর নেই। আর একবার, সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে সেটাও একটা রেকর্ড হবে। অন্যদিকে গান্ধিজী, কংগ্রেসের আত্মা, কংগ্রেস কা সোচ, তিনি জীবনে একবারই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, ১৯২৪ সালে। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কেউই দলে ঢুকেছেন আর সভাপতি হয়েছেন, এমন ইতিহাস কিন্তু নেই, সেই তালিকায় গান্ধিজীও নেই৷ গান্ধিজী দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা কালো বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়লেন৷ সেই লড়াইয়ের খবর ছিল ভারতের কংগ্রেস নেতাদের কাছে৷ গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, সি এফ এন্ড্রিউজ, গান্ধিজীকে দেশে ফিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বললেন৷ গান্ধিজিও সেরকমটাই ভাবছিলেন৷ তিনি দেশে ফিরলেন ১৯১৫ তে৷ তারপর ১৯১৭ তে চম্পারণ সত্যাগ্রহ, ১৯১৮ তে খেড়া সত্যাগ্রহ, ১৯১৯ এ খিলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস উজ্জীবিত৷ কিন্তু গান্ধী তখনও সভাপতি নন, সভাপতি হলেন একবারই, ১৯২৪ এ।
কিন্তু তারপর থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত কংগ্রেস মানে ছিল গান্ধী৷ গান্ধী মানেই ছিল কংগ্রেস৷ তিনি চাননি বলেই জিতে গিয়েও কংগ্রেসের সভাপতি পদ ছাড়তে হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে৷ সেই ২৪ এর পর থেকে অনেকেই হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি, কিন্তু রাশ ছিল গান্ধিজীর হাতেই৷ তিনিই আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন৷ জেলে যাবার নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ লবণ আইন ভঙ্গ করো থেকে ইংরেজ ভারত ছাড় তাঁরই নেতৃত্বে৷ কংগ্রেস সভাপতিত্ব হয়ে উঠেছিল এক নিছক আনুষ্ঠানিকতা। জহরলাল নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন৷ সেটাও উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়৷ অনেক লড়াই, অনেক জেল হাজত, রাস্তায় নেমে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার পরেই তাঁরা নেতা হয়েছিলেন৷ অন্যদের ক্ষেত্রে, আবুল কালাম আজাদ হোক বা সরোজিনী নাইডু হোক বা সুভাষ চন্দ্র বসু, তাদের দীর্ঘ লড়াই, মানুষের সমর্থন নিয়েই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ ১৯৪৭, দেশ স্বাধীন হল, প্রথম কংগ্রেস সভাপতি পট্টভি সীতারামাইয়া৷ সেই সীতারামাইয়া, যাঁকে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে হারিয়েছিলেন৷ যিনি ছিলেন গান্ধিজীর তরফের প্রার্থী৷ এরপর নেহরু দলের সভাপতি হয়েছেন৷ তারপর পাঁচবার ওই ইউ এন ধেবার, স্বাধীনতার পরে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হলেন প্রথমবার৷ ইউ এন ধেবরের পরে ১৯৫৯ এ দিল্লির বিশেষ অধিবেশনে, লন্ডনে ছাত্র রাজনীতি করেছেন, দেশের স্বাধীনতার পরে বাবার সঙ্গে থেকেছেন, কিন্তু ১৯৫৯ এ এ ছিল এক ল্যাটারাল এন্ট্রি, তখনও ইন্দিরা এক গুঙ্গি গুড়িয়া, বাকি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর কোনও তুলনা করাই যাবে না, তিনি মানুষের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমনটাও নয়। এর আগে টানা ৫ বার সভাপতি হয়েছে ইউ এন ধেবর, স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, সৌরাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত৷ কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সভাপতি হলেন নেহরু কন্যা হিসেবেই৷ দলের কিছু প্রবীণ নেতা ইন্দিরাকে সভাপতি করে, ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখবেন ভেবেছিলেন৷ ভুল করেছিলেন৷
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেশের রাজনীতি, কংগ্রেসের রাজনীতির রাশ নিজের হাতে নিয়েছেন৷ এরপর ল্যাটারারল এন্ট্রি রাজীব গান্ধীর, ১৯৮৫ থেকে টানা ১৯৯১ পর্যন্ত, প্রথমে ভাই সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্য, পরে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা, তাঁকে টেনে এনেছিল রাজনীতিতে৷ রাজনীতিতে অনিচ্ছুক রাজীব গান্ধী, ৮৫ তে, মুম্বই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি হলেন৷ কিন্তু রাজীব গান্ধী হত্যার পরে সভাপতি হলেন নরসিনহা রাও৷ তাঁর পরে দু বছরের জন্য সীতারাম কেশরী, এবং আবার ল্যাটারাল এন্ট্রি, রাজনীতির বাইরে থাকা, অনিচ্ছুক এক মহিলা, যিনি রাজীবের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে কংগ্রেসের ব্যাক সিট ড্রাইভার ছিলেন৷ না কোনও আন্দোলন নয়, মানুষের সখ্যতা নয়, গান্ধী ফ্যামিলির একজন হিসেবেই তাঁর ল্যাটারাল এন্ট্রি৷ সোনিয়া গান্ধী, সভাপতি হলেন৷ ২০১৮ সালে দিল্লি অধিবেশনে৷ তারপর থেকে টানা ৫ বার তিনিই সভাপতি, কেন? একমাত্র কারণ তিনি গান্ধী ফ্যামিলির একজন, রাজীব গান্ধীর স্ত্রী, আর কিচ্ছুটি নয়।
এরপর আবার ল্যাটারাল এন্ট্রি রাহুল গান্ধীর৷ জেল নয়, আন্দোলন নয়, মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা নয়৷ কেবল গান্ধী ফ্যামিলির একজন৷ রাজীব পুত্র, সোনিয়া তনয়, ব্যস৷ আর কোনও ক্রিডেনশিয়াল নেই। তার মানে? মানে দলে গান্ধী ফ্যামিলির জি হুজুরেরা আছে, তারা তাঁদের স্বার্থকে মাথায় রেখেই জোহুজুরি করেছেন, তা না হলে, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী বা রাহুল গান্ধীর রাজনীতিতে আসা সম্ভব ছিল না৷ অন্তত একধাপেই দলের সভাপতি হওয়া অসম্ভব ছিল৷ কিন্তু এই ইতিহাস কতদিনের? ১৩৭ বছরের প্রাচীন কংগ্রেসের, এই উড়ে এসে জুড়ে বসা সভাপতির ইতিহাস মাত্র ৩৭ বছরের, তার আগে ১০০ বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন ভাষার মানুষ, বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন৷ কংগ্রেসের ইতিহাস কেবল পরিবারতন্ত্রের নয়, এটাও সত্যি। তারসঙ্গে এটাও সত্যি যে, আপাতত এই গান্ধী পরিবার নির্ভরতা এক সমস্যা৷ এর থেকে কংগ্রেসকে বের হতেই হবে৷ এটা বুঝতে কোনও প্রশান্ত কিশোরের দরকার নেই, দরকার যেটা ছিল তা হল এই প্রশ্নকে সামনে আনা, প্রশান্ত কিশোর সেটা করেছেন। এবার সেই সমস্যার সমাধান কী করে হবে? কতদিনে হবে? কোন ফর্মুলায় হবে? সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই, অপেক্ষা করা যাক। কিন্তু এটাই কী কংগ্রেসের পুনরুত্থানের চাবিকাঠি? না, এক্কেবারেই নয়, এটা একটা জরুরি সমস্যা, যার সমাধান কংগ্রেসকে করতেই হবে, কিন্তু এটা হলেই, কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াবে, এমনটাও নয়। তাহলে আর কী কী করতে হবে? সেটা নিয়ে আলোচনা কাল। আজ এইপর্যন্তই,সঙ্গে থাকুন।