চিন্তন বৈঠক বা চিন্তন শিবির, হরেদরে একই কথা, ব্রেন স্টর্মিং সেশন৷ একজায়গায় বসে ক’দিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে মাথা খাটানো৷ সমস্যাগুলোকে খুঁজে বের করা৷ সমস্যার স্বরুপকে চেনার, বোঝার চেষ্টা করা৷ এই সমস্যাকে পাশে ফেলে কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে, কিভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে আলোচনার পরে কিছু সিদ্ধান্তে আসা৷ সেই সিদ্ধান্তগুলোকে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, তার রুপরেখা তৈরি করা। বলতেই পারেন যে, তার জন্য চিন্তন শিবির বা চিন্তন বৈঠক কেন? যে কোনও সংগঠনের, বিশেষ করে তা যদি রাজনৈতিক হয়, তাহলে বাৎসরিক সম্মেলন, বা দুবছর পরে পরে সম্মেলন ইত্যাদিতে বসেই তো আলোচনা করাই যেত৷
ধরুন কমিউনিস্ট পার্টিতে তো এরকম কোনও চিন্তন বৈঠকের ব্যবস্থা নেই৷ তা ওনারা কি চিন্তা করেন না? করেন তো, এখনও কেবল চিন্তাই করেন, তাহলে তাদের তো চিন্তন শিবির নেই, চিন্তন বৈঠকও নেই, কেন নেই? তৃণমূলেও নেই, বিজেডি, ডিএমকে, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, এনসিপি বা শিবসেনাতেও নেই। আসলে জাতীয় প্রেক্ষাপটে এই দলগুলো রাজনীতি করলেও, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের বড় ভূমিকা থাকলেও, সংগঠনগত ভাবে তারা ছোট ভৌগলিক সীমার মধ্যেই আবদ্ধ৷ রাজ্যের রাজধানীতেই নেতাদের ডেকে আলোচনা সেরে ফেলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো আছে, দিল্লিতে বসেই আলোচনা সেরে নেন ওনারা৷ কিন্তু বিজেপি সেই গড়ে ওঠার দিন থেকেই, দেশ জোড়া সংগঠন, কংগ্রেসের আরও বড়, কাজেই তাদের ওই ৩/৪ বছর পরপর সম্মেলন, অধিবেশন ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করতে হয়, প্রয়োজন হয় চিন্তন বৈঠক বা চিন্তন শিবিরে৷
সাধারণ ভাবে জাতীয় কংগ্রেস যখন চিন্তা করতে বসে, তখন তার নাম চিন্তন শিবির৷ বিজেপির সেটাই চিন্তন বৈঠক৷ বিজেপি দলে শুরু থেকেই এরকম চিন্তন বৈঠক হতো৷ কংগ্রেসের আগে এসব ছিল না৷ দেশকে নিজেদের জমিদারিই ভাবতেন৷ সেই ভাবনায় হোঁচট লাগার পরে ওনারা ১৯৯৮ থেকে চিন্তন শিবির শুরু করেছে৷ তারপর ২০০৩ এ হয়েছিল, এবং শেষবার ২০১৩ তে, জানুয়ারি মাসে ২০ তারিখে রাজস্থানেই, জয়পুরে হয়েছিল কংগ্রেসের চিন্তন শিবির৷ ২০১৩ মানে? তখন মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী, রাহুল গান্ধী দলের সহ সভাপতি৷ দল ক্ষমতায়, ২০০৯ তে আগের চেয়েও বেশি আসনে জিতেছে কংগ্রেস৷ তাও কেন চিন্তন শিবির? কারণ দেশ জুড়ে আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন, রাজধানীতে নারী ধর্ষণ এবং মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু বিজেপিও কী খুব ভাল অবস্থায়? জানুয়ারিতে জয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তন শিবির, অগস্টে সিমলাতে বিজেপির চিন্তন বৈঠক, আগে মুম্বইতে হওয়ার কথা ছিল, হল না কেন? কারণ মহারাষ্ট্রে নির্বাচন, দলের মধ্যে নানান গোষ্ঠীর বিরাট লড়াই, মহারাষ্ট্রের নেতারা চাইছিলেন না চিন্তন বৈঠক মুম্বইতে হোক৷ তাই সিমলাতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল৷ দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব? বিরাট ফাটল, আদবানিজি নিজেকে আবার প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে দেখতে চান৷ ২০০৯ এর মতই প্রাইম মিনিস্ট্রিয়াল ক্যান্ডিডেট, তিনি শরিক দলগুলোর সঙ্গে, জেডি ইউ র সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চান, শরিক দলের এমপিদের আলাদা করে ডিনারে ডেকেছেন৷ তার আগে নাটক৷ অনুপম খেরের নাটক৷ কুছ ভি হো সকতা হ্যায়, নাটকেই যা নিশ্চিত নয়, কিন্তু জিততেও পারি, মানে জেতার ইঙ্গিত ছিল৷
তারও আগে ২০০৯ তে বিজেপি হেরেছে লোকসভায়, কংগ্রেস গরিষ্ঠতা পায়নি৷ কিন্তু ২০৬ আসন নিয়ে বিজেপির ১১৬ র থেকে অনেক অনেক এগিয়ে৷ দলের বিক্ষুব্ধ নেতারা সভাপতি রাজনাথ সিংহের কাছে গুচ্ছ চিঠি লিখেছেন৷ ২০০৯ এও বিজেপির চিন্তন বৈঠক বসেছিল, হারের পর। শুরুর দিনেই বহিষ্কার করা হয়েছিল যশবন্ত সিংহকে, তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে জিন্নাহ দেশভাগের জন্য দায়ী নয়, এমনটা লিখেছিলেন৷ দলের হার নিয়ে এক গোপন রিপোর্ট, বাল আপ্তে রিপোর্ট বাইরে বেরিয়ে যায়, সেও এক কেচ্ছা। মানে আমি বলতে চাইছি, আজ যে অবস্থায় কংগ্রেসের চিন্তন শিবির হচ্ছে, ২০০৯ বা ২০১৩ তে বিজেপির চিন্তন বৈঠক, তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু ছিল না৷ ২০১৪ তে বিজেপির প্রাইম মিনিস্টিরিয়াল ক্যান্ডিডেট কে হবে, তাই নিয়ে তো দল ভাঙতে বসেছিল, ১৩ সেপ্টেম্বার ২০১৩ তে যেদিন বিজেপির পার্লিয়ামেন্টরি বোর্ডের মিটিং এ, নরেন্দ্র মোদির নাম আগামী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীত্বের পদের জন্য ঘোষণা করা হল৷ সেদিন আদবানীজি ওই বৈঠকে হাজিরই থাকলেন না৷ সেদিন কেউ ভেবেছিল নাকি, ২০১৪ তে বিজেপি ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসবে? বিজেপি ও ভাবেনি। তাহলে, কোথায় খেলাটা বদলে গেলো?
ওই শেষ চিন্তন বৈঠকেই, ২০১৩ র চিন্তন বৈঠকের মধ্যেই লুকিয়েছিল এই বদলে যাবার হিসেব৷ সেদিনই দল তৈরি হচ্ছিল এক নতুন নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার জন্য৷ পুরনো দ্বিধা দ্বন্দ্বকে ভুলে হিন্দুত্ব এবং হিন্দুত্বের তাসই খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজেপি৷ তাদের কাছে আদবানি তখন অনেক নরম হিন্দু মুখ৷ গোধরা পার করে, গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি তখনই কথায় কথায়, মিয়াঁ মুসাররফের কথা বলতেন৷ বলতেন কংগ্রেস নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতার কথা৷ ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, সেই তখনকার স্লোগান৷ সঙ্গে যোগ হয়েছিল আন্না হাজারের লড়াই, দেশ জুড়ে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন৷ আইন শৃংখলা নিয়ে প্রশ্ন, আর তার সঙ্গে এক রাগী হিন্দুত্বের মুখ নরেন্দ্র মোদি৷ দল একবারও ভাবেনি আদবানির বদলে মোদিজি কেন?
সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফলও পেয়েছে, চিন্তন বৈঠকের চিন্তা নয়৷ চিন্তার পরে সিদ্ধান্তকে প্রয়োগ করাই ছিল আসল ব্যাপার। সেদিন আদবানিকেই সামনে রেখে নির্বাচন হলে, এই ফলাফল হতো না। আজ রেলে চেপে দিল্লি থেকে উদয়পুর পৌঁছলেন রাহুল গান্ধী৷ ৪২২ জন প্রতিনিধি বসবেন চিন্তন শিবিরে৷ যদি এখানে রাহুল গান্ধী জিন্দাবাদ, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জিন্দাবাদ আর সোনিয়া গান্ধী জিন্দাবাদের মধ্যেই চিন্তা আটকে থাকে, তাহলে জাদুঘরের, মিউজিয়ামের একটা বড় ঘর বরাদ্দ থাকবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্য৷ আর অন্যরকম? হতেই পারে, বিজেপির চিন্তন বৈঠকের কথা মাথায় রাখুন৷ একটা শতচ্ছিন্ন দল ২০১৩ তে, আজ মনে হচ্ছে এ বোধহয় চিরস্থায়ী৷ এরকম মনে হয়, আমরা এই বাংলায় সিপিএমকে দেখেছি৷ মমতা, একমাত্র মমতা জিতেছেন, বাকিরা হেরেছে, দেখেছি। বুদ্ধদেবকে ২০০৬ এ ২৩৫ নিয়ে চিৎকার করতে দেখেছি, শুনেছি, ২০১১ ও দেখেছি। অবশ্যই, অবস্থাটা আজ আরও কঠিন৷ কঠিন কারণ মোদিজি বা বিজেপি তো আর পাঁচটা সংসদীয় দল নয়৷ সাংবিধানিক সবকটা প্রতিষ্ঠানকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, বিরাট বিরাট অর্থবল আর তাই দিয়ে তৈরি এক ওয়ার্লড ক্লাস কর্পোরেট ইলেকশন মেসিন নিয়ে, বিজেপিকে অপ্রতিহত বলেই মনে হচ্ছে৷
আবার উলটোদিকে দেশজুড়ে কংগ্রেসের বিরোধী তো কেবল বিজেপি নয়, সে জায়গাতে আপ আসছে, তৃণমূল আসছে, বিরোধী দলে ঐক্য নেই৷ কাজেই বিজেপিকে হারানো অসম্ভব, এটা মনে হচ্ছে, কিন্তু ওই মনে হওয়ার বাইরেও তো অনেক কিছুই আছে৷ সেখানেই চিন্তার অবকাশ আছে বৈকি৷ কংগ্রেস যদি মনে করে, এই মূহুর্তে বিজেপিই তার সবথেকে বড় বিপক্ষ, যদি তাদেরকেই নির্বাচনে হারানোটা প্রথম লক্ষ্য হিসেবে নেয়, তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব। প্রস্তুতি পর্ব, মহাভারতের দীর্ঘতম পর্ব, পান্ডবরা তাদের সঙ্গী খুঁজেছিল, অস্ত্র যোগাড় করেছিল, বলরামের মত কাউকে কাউকে নিরপেক্ষ থাকতে দিয়েছিল, কৃষ্ণের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, এবং এই প্রস্তুতিপর্বেই লেখা হয়ে গিয়েছিল কৌরবদের হার৷ বাকি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ? সে তো মাত্র ১৮ দিনের। এক ধাপ এগিয়েছে কংগ্রেস, অন্তত একটা চিন্তন শিবির যে দরকার, সেটা তো মেনে নিয়েছে৷ এবার ৪২২ জন মিলে কী চিন্তা করবে? চিন্তাটা একটা নির্বাচনে জেতা নয়, দেশের সংবিধানকে বাঁচানোর, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে বাঁচানোর৷ কংগ্রেস জিতলো না হারলো, সত্যি বলতে কি তা নিয়ে আমাদের চিন্তার কী থাকতে পারে? কিন্তু এটা সত্যি যে, কংগ্রেসের দূর্বলতার ফলেই তো বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত৷ আর এক সাম্প্রদায়িক, চরম হিন্দুত্ববাদী, মধ্যযুগীয় শাসনের প্রতীক এই বিজেপি শাসনের অবসান আমরা চাই৷ চাই বলেই মনে হচ্ছে এই চিন্তন শিবিরে খোলা মনে আলোচনা হোক৷ দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে, আগামিদিনে এক নতুন ভারতের রুপরেখা তৈরি হোক। কংগ্রেসকে, কংগ্রেস নেতৃত্বকে সেই দায়িত্ব নিতেই হবে, কংগ্রেস ছাড়া বিকল্প সম্ভব নয়, এই কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবতে হবে আঞ্চলিক দলগুলোর সাহায্য ছাড়াও বিকল্প তৈরি হবে না৷ চিন্তন বৈঠক দেশের জন্য সুখবর নিয়ে আসুক, চিন্তার জড়তা কাটিয়ে কংগ্রেস ফিরে আসুক তার নিজের রাজনীতিতে, ধর্মনিরপেক্ষতা, কল্যাণকামী রাষ্ট্র আর গণতন্ত্রের পথে রওনা দিক আমার স্বদেশ, আমার ভারতবর্ষ।