শোনা গিয়েছিল, না শোনা গিয়েছিলটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে খাটে৷ আর যাই হোক মোদিজী সাধারণ মানুষ তো নন৷ তাই তাঁর জন্য ঠিকঠাক শব্দটা হল ‘কথিত আছে’। কথিত আছে মোদিজী সেই ছোট্ট বেলায় পুকুর থেকে মগরমচ্ছ, মানে মাগুর মাছ নয়, আস্ত কুমির ধরে এনেছিলেন। ত্রৈলক্যনাথের গল্পে ডমরুধর কুমির ধরেছিল, তারপরে আমাদের মোদিজী। ছোটবেলাতেই এরকম বিরাট তেজ নিয়ে জন্মেছিলেন তো গুজরাতেই, কাজেই সিংহের সঙ্গে দোস্তি নিশ্চয়ই ছিল, ছিল বৈকি। বাঘা বাঘা পন্ডিতরা বললেন মধ্যপ্রদেশের কুনোর জঙ্গলে খান কয়েক সিংহ ছাড়লে সিংহের বংশবৃদ্ধি হবে। মোদিজী বললেন গুজরাতের সিংহ যাবে মধ্যপ্রদেশে কভি নঁহি। তখন মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের রাজত্ব, সেখানে সিংহ পাঠানো? হয় নাকি। তারপর সিংহ টিংহ সামলে তিনি দিল্লিতে বিরাজমান হলেন। আসা ইস্তক তাঁর জাতীয় প্রতীকের সিংহকে খানিক ভদ্র সভ্য মনে হচ্ছিল, কেমন জানি এক গভীর বিশ্বাস আর প্রশান্তি সে সিংহের চোখে মুখে। নঁহি চলেগা, তো তিনি নতুন করে জাতীয় প্রতীক গড়িয়ে নিলেন, সেখানে সিংহ হিংস্র, সে কেবল জয় করতে চায়। সংবিধানে প্রতীক নির্দিষ্ট করা আছে? তাতে মোদিজীর কিসসু এসে যায় না। সংবিধান কিস চিড়িয়া কা নাম হ্যায়?
তো সেই মোদিজীর জন্মদিন ছিল। যদিও সেখানেও বিস্তর গোলযোগ আছে, তাঁর অন্তত দুখানা জন্মদিনের কথা আমরা জানি৷ যেমন জানি এক মালয়ালম কাগজে তিনি নিজেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন, এমনটাও বলেছিলেন, পরবর্তিতে জানা গিয়েছে তিনি এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স নিয়েই গ্রাজুয়েশন করেছেন৷ যদিও এই এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স বস্তুটা কি? তা জানা যায়নি। কে পড়াতেন তাও জানা যায়নি, তেনার কোনও সহপাঠির খোঁজ? না সেটাও পাওয়া যায়নি। তো সেসব কথা বাদ দিলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর একটা জন্মদিন থাকবে না? এ আবার কেমন কথা? ধরেই নিলাম ১৭ সেপ্টেম্বর আমাদের মোদিজীর অফিসিয়াল জন্মদিন। তো সেই জন্মদিন কেমন করে, কবে থেকে উদযাপন হয়? কাগজ ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি ২০১২তে চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য গুজরাতে দলকে নেতৃত্ব দিতে নামার ঠিক আগে ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়, তিনি যে কেবল নিজেই পালন করেছিলেন তাও নয়, তাঁর ফ্যান ফলোয়ার্সরা আমেদাবাদে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল, বিহারে ৬২ কেজির কেক কাটা হয়েছিল৷ তিনি তখন গোবলয়ে উগ্র হিন্দুত্বের আইকন। এবং সেদিন সকাল বেলায় মায়ের কাছে গিয়েছিলেন আশীর্বাদ নিতে সঙ্গে ছিল মিডিয়া, মোদিজী ক্রমশ ক্ষমতা কেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছিলেন।
২০১৩ তে তাঁর জন্মদিনের কদিন আগেই, ১৩ সেপ্টেম্বর ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, তিনিই ২০১৪ নির্বাচনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী মুখ। এই সময় থেকে প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল মাপা, আর নানান ইভেন্টে ভরপুর। ২০১৩ র জন্মদিনে সাত সকালে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তারপরে ওই প্রথম এবং ওই শেষবার তাঁর জন্মদিনে ৬৪ কেজি কেক কাটলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন৷ কদিন আগে ২০১২ র গুজরাত নির্বাচনে একজন সংখ্যালঘুকেও মনোনয়ন দেননি মোদিজী। মাত্র এক বছর পরে তাঁরা কেক কাটছেন। মাথায় রাখুন ২০১৪ র নির্বাচন মোদিজী এবং বিজেপি লড়ছে কংগ্রেসের দুর্নীতি, বংশানুক্রমিক শাসন, ক্রমাগত ঘটতে থাকা মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা, দেশজুড়ে আন্না হাজারের আন্দোলনের ইস্যুগুলোর ওপরে ভর দিয়ে। যাই হোক সংখ্যালঘুরা কেক তো কাটলেন কিন্তু ওজন ৬৪ কেজি, কেন? হওয়া উচিত ছিল ৬৩, কিন্তু কাটলেন ৬৪। মানে ওই যে আবির্ভাব দিবস নিয়ে মেলা ধোঁয়াসা।
এবার ২০১৪ ১৭ সেপ্টেম্বর, তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী, সেদিনের ফটো অপশন কিন্তু আর মা নন৷ ছবি চীনের রাষ্ট্রপতি জিনপিং এর সঙ্গে, তিনি তখন জাতে উঠছেন। ২০১৫ তে ফটো অপশন ছিল শৌরাঞ্জলি, ৬৫র ইন্দো পাক যুদ্ধের সূবর্ণ জয়ন্তী দিবসে মিলিটারি একজিবিশনে। ২০১৬ তে তাঁর জন্মদিন গুজরাত সরকার সেবা দিবস হিসেবে পালন করল৷ কাজেই তিনি গুজরাতে, সাতসকালে মিডিয়াকে নিয়ে মাকে প্রণাম করলেন, সেটাই ছিল ছবি। ২০১৭ মায়ের আশীর্বাদ তো নিলেন কিন্তু মিডিয়া নিয়ে গেলেন না৷ মিডিয়া গেল সর্দার সরোবর ড্যামে, যেটা তিনি জাতির প্রতি উৎসর্গ করলেন৷ সেদিন সারাদিনই বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং এক সভায় ভাষণ দিয়েছেন, মাথায় রাখুন এর কদিন পরেই ছিল গুজরাতের ক্রুসিয়াল নির্বাচন৷ কংগ্রেস কাঁটে কা টক্কর দিয়েছিল।
২০১৮, ৬৮ তম জন্মদিন, পালন করলেন কোথায়? বেনারসে, তাঁর কন্সটিচুয়েন্সিতে, কেন? কারণ ক মাস পরেই তো ভোট। ফটো অপশন বেনারসে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে, কারণ ২০১৯ এর নির্বাচন লড়াই হবে বিকাশ নয়, হিন্দুত্বের ইস্যুতে। ২০১৯ তে ৬৯ তম জন্মদিন আবার গুজরাতে, নমামি নর্মদা উৎসবে। ওটাই ছিল ফটো অপশন। ২০২০, ১৭ সেপ্টেম্বর খুব খারাপ কেটেছে৷ দেশ কোভিডের মধ্যে, না কোনও ছবিছাবা নেই, তবে সভাপতি জে পি নাড্ডা “লর্ড অফ রেকর্ডস” নামে একটা বই বার করে মোদিজীর অতুলনীয় ২৪৩ টা কীর্তির এক সঙ্কলন বার করেছিলেন। ২০২১, তার আগের বেশ ক’দিনের টিকা দেওয়ার হিসেব হাতে রেখে ১৭ সেপ্টেম্বর সেই সব সংখ্যা জুড়ে ঘোষণা দেওয়া হল মোদিজীর জন্মদিনে টিকা দেওয়ার সংখ্যা বিশ্বের এক রেকর্ড, ২.২৬ কোটি, বচ্চে লোগ হাততালি দো। সেদিন তিনি জাতির প্রতি ভাষণে এই কথা ঘোষণা করেছিলেন।
এবার ২০২২ এর জন্মদিন, আগের সব রেকর্ড, ম্লান মুহুর্তকে ছাপিয়ে মোদিজী চিতা ছেড়ে দিলেন জঙ্গলে। ভক্তদের কী উল্লাস, ফেসবুক, টুইটারে তাঁরা লিখছেন, ৭০ বছর পরে মধ্যপ্রদেশে কুনোর জঙ্গলে চিতার গর্জন। ভক্তদেরকে বোঝাবে যে চিতা গর্জন করে না, এক্কেবারে বিড়ালের মতই ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকে। ন্যারেটিভ টা কী? মিত্রোঁ, গত ৭০ বছর ধরে এই কংগ্রেসি সরকার, এই গান্ধী ফ্যামিলির সরকার আপনাদের চিতা থেকে বঞ্চিত করেছিল, মাঝেমধ্যে এধারে ওধারে যা দেখেছেন, সেগুলো ছিল চিতাবাঘ, লোপার্ড। এই দেকুন আমি কাউবয় টুপি পরা প্রায় আমেরিকান শেরিফ, আপনাদের জন্য আট আটটা চিতা এনে দিলাম। খাবার দিতে পারিনি, বাসস্থান দিতে পারিনি, চাকরি কথা আর তুলবেন না প্লিজ। চলে আসুন চিতা দেখুন, পৃথিবীর দ্রুততম জন্তু। হ্যাঁ এরকমটাই বলার চেষ্টা হচ্ছে। সত্যিটা কী? ৭০ বছর আগে এক সার্ভেতে বলা হয়েছে দেশে চিতা নেই। এখন চিতা নেই, সেটা তো দেশের সবথেকে বড় সমস্যা নয়, তার থেকে হাজারগুণ বড় সমস্যা আছে, কিন্তু কিছু বৈজ্ঞানিক, গবেষক এই চিতা নিয়ে কাজ করছিলেন বৈকি, কারণ চিতা আনলেই তো হবে না, কেন চিতা উবে গেল, কোন অরণ্যে চিতা রাখা যাবে এসবও তো জানতে হবে।
২০০৯ এ ঠিক করা হয়, চিতা আনা হবে, দক্ষিণ আফ্রিকা বা কেনিয়া থেকে আনা হবে, এবং সেই সময়েই স্থান নির্বাচনের সময় মধ্যপ্রদেশের কুনো অরণ্যের নাম আসে। প্রকল্প চলতে থাকে, সরকার বদল হবার পরেও। এবং ঠিক হয় আপাতত কেনিয়া থেকে ৮ টা চিতা আনা হবে, এর পরের লট আসবে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। সেই প্রকল্পকে জুড়ে দেওয়া হল মোদিজীর জন্মদিনের সঙ্গে, দারুণ এক ফটো অপশন, মাথায় কাউবয় হ্যাট, হাতে নিকন ক্যামেরা, জন্মদিনে চিতা ছেড়ে দিলেন, ছবি তুললেন। এবং দেশবাসীকে জানানো হল মোদিজীর জন্যই ৭০ বছর পরে ভারতবর্ষে চিতা এল। এই হিংস্র জন্তু প্রেম বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের ছিল, সবথেকে বেশি ছিল হিটলারের নাজি জামানায়। হিটলার নিজেকে উলফ বলে ডাকাটা পছন্দ করতেন, ওনার ঘনিষ্ট বন্ধুরা উলফ বলেই ডাকত। ওনার গোপন বাসার সাংকেতিক নাম ছিল উলফস ক্যানিয়ন। হিটলারের প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবলস সেই কবেই ১৯২৮ সালে জার্মান ডেমোক্রাটসদের বলেছিল, মাথায় রাখবেন আমরা হিংস্র নেকড়ের মত ছিঁড়ে ফেলবো আপনাদের। হিটলার আমলে দু নম্বর ক্ষমতাশালী নেতা হেরম্যান গোয়েরিং এর ছিল ৭ টা সিংহ, তাদের সঙ্গে খেলা করতেন তিনি। স্বৈরাচারের এরকম হিংসা প্রেম দেখা গেছে বার বার। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মোদিজী জন্মদিনে চিতা নিয়ে খেলা করলেন, দেশের গরিষ্ঠাংশ মানুষের খাবার নেই, বস্ত্র নেই, নেই মাথার ওপর ছাদ। জল আলো এখনও স্বপ্ন। লক্ষ লক্ষ বেকার ছেলের সবল হাতে কোনও কাজ নেই। মোদিজী আমেরিকান কাউবয় সেজে চিতা নিয়ে খেলা করছেন।