১৯৫৯, তখন পাকিস্তানে স্বৈরাচারী আয়ুব খানের শাসন চলছে৷ এক কবিকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লাহোর দূর্গে৷ সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সে নাকি দেশদ্রোহী, সে নাকি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে চায়, সে নাকি বিদ্রোহী। যাবার পথে প্রিজন ভ্যানের চাকা ফেটে গেল৷ পায়ে বেড়ি পরা কবিকে তোলা হল ঘোড়ার গাড়িতে৷ ভরা বাজারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন কবি, সবাই দেখছে, কবি কবিতা লিখলেন,
চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়ে চলো।
চোখের নোনতা জল আর দুঃখ ভারাক্রান্ত মন ই যথেষ্ট নয়,
গোপন প্রেমের যথেচ্ছ অভিযোগই যথেষ্ট নয়,
চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়েই চলো।
হাত আকাশের দিকে তোলো, হাত নাড়াও, আনন্দে নাচো,
পায়ে ধুলো থাক লেগে কিম্বা জামায় রক্তের ছিটে
তোমার প্রেয়সী শহর, তোমার অপেক্ষাতেই তো ছিল
চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়েই চলো।
আশ্চর্য এই বাজারে শাসকও আছে, আম জনতাও আছে,
কুৎসার বন্যাও আছে, অপমানের পাথরও আছে
মন খারাপ করা সকালও আছে, অসফল পুরো দিনও আছে
তবুও, চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়েই চলো।
এই বাজারের আম আদমিদের কাছে তুমি ছাড়া আর কে আছে?
এই প্রিয় শহরে তারা আর কার ওপর বিশ্বাস রাখবে?
সেই খুনিও তো এই শহরেই আছে,
হৃৎস্পন্দন থেমে যাক, ভাঙা এ মন নিয়েও চলো
এসো বন্ধু শহীদ হই।
তবুও, চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়েই চলো।
আজ বাজার মে পা বজোলাঁ চলো, লিখেছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের জীবনের কথা তাঁর কবিতাতে বার বার এসেছেই শুধু নয়, সেই কথা বলতে গিয়ে বার বার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে৷ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, দেশ ছাড়তে হয়েছে, নির্বাসনে থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর৷ আবার এসবের পরেও, অখন্ড ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া সেই তিনি এই উপমহাদেশের অন্যতম কবি, শায়র ছিলেন, সারা পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করা হয়েছে৷ দেশে দেশে বিভিন্ন আন্দোলনের সময় তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে স্লোগান৷ কদিন আগেই এনআরসি – সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় মুখে মুখে ঘুরছিল, তাঁর লেখা শায়রির লাইন, হাম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যায় কি হাম দেখেঙ্গে। তো সেই ফয়েজ আহমদ ফয়েজের এই আজ বাজার মে পা বজোলাঁ চলো কবিতার কটা লাইন ছিল সিবিএস সির ক্লাস টেন এর বইতে, গণতান্ত্রিক রাজনীতি – ২ পাঠ্য পুস্তকে। এবার সেই কবিতা তুলে দেওয়া হল, মুছে দেওয়া হল। ফয়েজ আমাদের পাঠ্য পুস্তকে নেই। কেন? কারণ জানানো হয়নি, বলা হয়েছে এটা একটা রুটিন পরিবর্তন, মানে মাঝে মধ্যেই কিছু বিষয় আনা হয়, কিছু বিষয় তুলে নেওয়া হয়, এই রুটিন পরিবর্তনের সময়ে কোট আনকোট পাকিস্তানি কবি ফয়েজের কবিতা তুলে নেওয়া হয়েছে। চলো, পায়ে বেড়ি পরেই বাজারের মধ্য দিয়েই চলো।
কেবল ফয়েজ তুলে নেওয়া হয়েছে? না, আরও আছে, মূলত আমাদের দেশের নেতৃত্বে, জহরলাল নেহরুরর নেতৃত্বে বিশ্বে যে নির্জোট সম্মেলন গড়ে উঠেছিল, সেই নেহরু – নাসের – টিটোর নির্জোট সম্মেলনের ইতিহাস বাদ পড়েছে৷ আফ্রিকা এশিয়ায় ইসলামিক শাসনের ইতিহাস বাদ পড়েছে৷ মোগল দরবারের বিস্তৃত বিবরণ বাদ পড়েছে৷ পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস বাদ পড়েছে৷ কৃষি ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব বাদ পড়েছে, এবং সিবিএসসির গণতান্ত্রিক রাজনীতি – ২ বই এর গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র অধ্যায় থেকে বাদ পড়েছেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। এটা রুটিন পরিবর্তন? মানতে হবে?
আসলে একটা প্যাটার্ন ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে৷ এন্টায়ার পলিটাক্যাল সায়েন্স পড়া লোকটির মনে হয়েছে উর্দু ইজ ইকুয়াল টু ইসলাম, তিনি উর্দুর বিরুদ্ধে, তাঁর ভক্তরাও উর্দু দেখলেই পাগলা ষাঁড়ের মত মাঠে নামছেন, তারওপর ফয়েজ আবার কমিউনিস্ট, তাঁর কবিতা গণ আন্দোলনের স্লোগান৷ অতএব তা মুছে ফেলতে হবে৷ এরপর তাঁর আরও বড় টার্গেট নেহরু৷ নেহরুর কাছে তাঁকে বামনের মতই দেখাচ্ছে৷ নেহরুর মেধা, শিক্ষা, দেশে বিদেশে তাঁর অ্যাকসেপট্যান্স, তাঁর অসামান্য লেখা বই এবং অবশ্যই ৪৭ এর ভারতকে শিল্পয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলা, ভারী শিল্পের, এইমস, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, বিশ্বে নির্জোট সম্মেলনের প্রথম সারির নেতা হওয়া, এই সবকিছু মুছে ফেলতে হবে, সবকিছু, ওনার নেহরুতে অ্যালার্জি৷ অনেকে এটাই বলেন, আসল সত্যি হল আর এস এস – বিজেপি – মোদির সামনে সবথেকে বড় শ্ত্রু হল গান্ধিজী৷ এক ধাক্কায় গান্ধীকে তো মোছা যাবে না, তাই প্রথম টার্গেট নেহরু৷ নেহরু শেষ হলে গান্ধীকে শেষ করা সহজ হবে৷ তাই নির্জোট আন্দোলনের ইতিহাস তুলে দাও৷ আজকের ছাত্ররা যেন সেই ইতিহাস না জানতে পারে৷ তাদের কে গণেশের মাথা প্লাস্টিক সার্জারি, কৌরবদের ১০০ সন্তান আসলে টেস্ট টিউব বেবি এইসব হাবিজাবি ইতিহাস ভূগোল পড়ানো হোক৷ তাদেরকে ভুলিয়ে দেওয়া হোক মোগল দরবারের ধর্মনিরপেক্ষতার কাহিনী, মোগল ইতিহাসের কাহিনী, ছত্রে ছত্রে থাকুক সংখ্যালঘুদের জন্য ঘৃণা আর বিদ্বেষ, এটাই প্ল্যান৷ এটাই চলছে৷ এগুলো তারই বর্হিপ্রকাশ।
তখন অটল বিহারী বাজপেয়ি বিদেশমন্ত্রী, পাকিস্তানে গিয়ে, সমস্ত ডিপ্লোম্যাটিক রীতিনীতি ভুলে ফয়েজের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, ফয়েজকে তাঁরই লেখা শায়রীর কটা লাইন শুনিয়েছিলেন, ফয়েজ তাঁর অন্যতম প্রিয় কবি ছিলেন, তিনি ফয়েজকে ভারতবর্ষে আসার অনুরোধও করেছিলেন৷ শেষমেষ ফয়েজ এসেওছিলেন, দুই কবি, রসিক মানুষে দারুণ আড্ডা হয়েছিল, সবাই জানেন সে সব কিসসা। কিন্তু এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স পড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তাতে কিছু এসে যায় না, তাঁর রাজত্বে পাঠ্য পুস্তক থেকে ফয়েজ বাদ যাচ্ছে, তিনি চুপ।
আসলে দেশের ক্ষমতা দখলে এসেছে কংগ্রেসের চরম ক্যালাসনেস, বিজেপির এই উত্থানকে রুখতে পারেনি৷ এরপর সাংবিধানিক সমস্ত প্রতিষ্ঠান দখলে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে, সি বি আই থেকে ইডি, থেকে যা যা আছে সবই, তেনাদের নির্দেশ মত চলছে, দেশে রাশি রাশি ঘৃণা আর বিষ ছড়াচ্ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ সমিতি, বজরঙ্গ দল, বিজেপি নেতারা, প্রধানমন্ত্রী চুপ করে বসে দেখছেন, সংখ্যালঘুরা কুঁকড়ে গেছেন শুধু নয়, হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোও বন্ধ করেছে বহু রাজনৈতিক দল, তেমন একটা সময়ে এবার শিক্ষা নিয়ে পড়েছে বিজেপি সরকার, নরেন্দ্র মোদীর সরকার। ওরা যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে তত কম মানে। অতএব জানার রাস্তাগুলো বন্ধ করে দাও। আকবরের দরবারের কথা পড়লে জেনে ফেলবে আকবর মুসলিম নয়, ইসলাম নয় দীন ই ইলাহী নামে এক ধর্মাচরণের কথা বলতেন, চর্চা করতেন, জানতে পারা যাবে মোগল দরবারে বহু হিন্দুরা উচুঁ পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তো সর্বেসর্বা, যেমন টোডরমল, আকবর, জাহাঙ্গিরের সময়ে রাজস্ব বিভাগের সবটাই দেখতেন, এসব জানলে বিষ ছড়ানো যাবে না, অতএব মুঘল দরবারের বিস্তৃত বিবরণ তুলে দাও, নির্জোট সম্মেলনের কথা তুলে দাও, তাহলে আজকের ছাত্ররা সেই উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা ভুলে যাবে যখন বিশ্বে রাজনীতিতে নেহেরু – নাসের –টিটো সমেত এক নির্জোট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, যারা বিশ্ব শান্তির কথা বলতো, রাশিয়া বা অ্যামেরিকা কোনও দিকেই না গিয়েও নিজেদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখতো, সেই নেহেরুর নাম ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মানে ক্যাচ দেম ইয়ং, ছোট বেলাথেকেই মগজ ধোলাই এর ব্যবস্থা চলছে। এনসিআরটি ই, ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং এবং সিবিএসসি মিলে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিচ্ছে ফয়েজ, বাদ দিচ্ছে নির্জোট সম্মেলন, বাদ দিচ্ছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ইতিহাসের কথা। কতটা ডেসপারেট, কতটা উগ্র চিন্তা ভাবনা নিয়ে এই কাজ চলছে, তার আরেক নমুনা হল, পাঠয়পুস্তকে নাথুরাম গডসের পরিচিতি থেকে ব্রাহ্মণ কথাটাও তুলে দেওয়া হল, এই কথা চেপে যাওয়ার চেষ্টা চলছে যে গান্ধী হত্যায় জড়িত নাথুরাম গডসে মহারাষ্ট্রের চিতপাবন ব্রাহ্মণসন্তান ছিল, তা চেপে যাওয়া হচ্ছে, স্ত্যিটা হল, কেবল নাথুরাম গডসেই নয়, গান্ধী হত্যায় অভিযুক্ত পাঁচ মাথা, সাভারকার, নাথুরাম গডসে, গোপাল গডসে, নারায়ন আপ্তে, বিষ্ণু কারকারে ছিল ব্রাহ্মণ, সেই উচ্চ বর্ণের ষড়যন্ত্রের ইতিহাসও ভোলানোর চেষ্টা চলছে। এমনটা নতুন কিছু নয়, যে কোনও স্বৈরাচারী শাসক এটাই চায়, এটাই করে, হিটলার, ফ্রাঙ্কো থেকে পরবর্তি জমানার স্বৈরাচারীরা এইভাবেই ইতিহাস ভোলানোর চেষ্টা করেছে, কবি কে জেলে পোরা হয়েছে, কিন্তু সেই ইতিহাসই বলে, সেসব ছিল সাময়িক প্রচেষ্টা, শেষমেষ স্বৈরাচারীদের স্থান হয় আস্তাকুঁড়েতেই, মানুষ রুখে দাঁড়ায়, সেই মানুষ আবার রুখে দাঁড়াবে নিশ্চই, তাদের মুখে মুখে থাকবে ফয়েজেরই কবিতা।
আমরা দেখবো, মনে রেখো, আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
অনিবার্য সেই আগামী ভবিষ্যৎ, যা আমাদের,
সেই দিন ও আমরা দেখবো
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
যখন তোমাদের সব অত্যাচার সব ফতোয়া তুলোর মত উড়ে যাবে
আম আদমির পায়ের চাপে এই পৃথিবী থর থর করে কাঁপবে
আকাশের থেকে বাজ পড়বে তোমাদের মাথায় ওহে শাসকের দল
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
যখন মহাকালের সেই দুনিয়া থেকে
নিজেদের ভগবান মনে করা মানুষগুলো উবে যাবে কপ্পুরের মত
যখন মানুষ দখল নেবে তার হৃত সাম্রাজ্য কল কারখানা জল জমিন
সব মুকুট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে
সব সিংহাসন ভেঙে দেওয়া হবে
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
নাম থাকবে কেবল তাঁর, যিনি আছেন অথবা নেই
যিনি দ্রষ্টা এবং দৃষ্টি,
আমিই সত্য এই আওয়াজ উঠবে দিকে দিগন্তরে
যে সত্য তুমি, যে সত্য আমি
ক্ষমতা দখল করবেই অমৃতের পুত্ররা
সেই আমি সেই তুমি, আমরা।
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো।
হাম দেখেঙ্গে।