অনেকেই জানেন, মুসলমান ধার্মিক মানুষজন, স্থানীয় মসজিদের ইমাম ইত্যাদিরা যতিমখানা, অনাথাশ্রম চালানোর জন্য বা মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের সাহায্যের জন্য, এক দুজন সাকরেদকে নিয়ে বের হন৷ চলে যান এপাড়া ওপাড়া৷ কখনও গ্রামের বাইরে, একটু দূরে কোনও শহরে বা গ্রামে, ঝোলা নিয়ে, যদি মানুষ কিছু সাহায্য করেন৷ ধর্ম নির্বিশেষে সাহায্য চান৷ আপনি কিছু দিলে বলে ওঠেন, খোদা আপনার মঙ্গল করুন৷
আমার গ্রাম বাংলায় এ ছবি আমরা দেখেছি, দেখি। সারা ভারতজুড়েও এমনটা হয়৷ কিন্তু সেই লোকগুলোকে কতটা হেনস্থা, কতটা অপমান করা হল। বল, জয় শ্রী রাম, বল। তাঁরা বললেন৷ একবার নয়, বারবার বললেন৷ না তাতেও ছাড় নেই৷ তারা নাকি সন্ত্রাসবাদী৷ বলছে কে? বিজেপির মুখপাত্র? বিজেপি আরএসএসের বড় নেতা? বিজেপির এমএলএ, এম পি? না। এক যুবক, বড়জোর বিজেপির ঝান্ডা নিয়ে ঘোরে, এই পর্যন্ত। কিন্তু কতটা কনফিডেন্ট, কতটা অ্যারোগান্ট, কতটা উদ্ধত দেখুন, তার বাবার কি তার চেয়েও বড় বয়সী এক মানুষকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে৷ ভয় দেখাচ্ছে৷ আধার কার্ড চাইছে ঠিক সেই রকমভাবে, যে ভাবে গেস্টাপোরা হিটলারের জামানায়, ইহুদিদের কাছ থেকে কাগজ দেখতে চাইত৷ বলা করাত, বল হেইল হিটলার, বল। তফাৎ? এখানে বলা হচ্ছে বল জয় শ্রীরাম, বল। কোথা থেকে এল এই ঘৃণা? এই বিদ্বেষের বীজ কারা পুঁতল? কী ভাবে সেই বিষবৃক্ষ বড় হল? বড় হতে হতে এক নাথুরাম গডসে, একজন নূপুর শর্মা, একজন নবীন জিন্দল, আদিত্যনাথ যোগী, শাহ, মোদি হয়ে ওঠে কী করে? আসুন সেটা নিয়েই আলোচনা করা যাক৷
এই বিষবৃক্ষের ইতিহাস অনেক আগের, প্রাচীনও বলাই যায়। স্বাধীনতার সংগ্রামকে সেই ১৯০৫/ ১৯০৭ থেকেই অহিংস আর সহিংস ভাগে ভাগ করাই যায়, তখনও গান্ধিজী নামেননি ভারতের রাজনীতিতে, কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতি ছিল আলাপ আলোচনার,পরামর্শ আর কিছুটা হলেও ভাগেদারির চেষ্টা, স্থানীয় প্রশাসনের অংশ হবার চেষ্টা। অন্যদিকে সহিংস আন্দোলন, বাল গঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ, বিপিন চন্দ্র পাল বা লালা লাজপত রায়, খেয়াল করুন, এনারা প্রত্যেকেই কিন্তু বেশ গোঁড়া হিন্দু, এনারা মুসলমান বিদ্বেষী নন, কিন্তু হিন্দু। এঁদের হাত ধরে যে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠল, সেখানেও কালী ঠাকুরের সামনে রক্ত দিয়ে শপথ নেওয়া, শিবাজী মহারাজের জয়, ভাগওয়া ঝান্ডা, এঁদের বেদ হল আনন্দমঠ, শ্লোগান বন্দেমাতরম, দ্বিতীয় স্তবক,
তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম
তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে ৷
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ৷
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী
কমলা কমল-দলবিহারিণী
বাণী বিদ্যাদায়িণী
নমামি ত্বাং
নমামি কমলাম্
অমলাং অতুলাম্
সুজলাং সুফলাং মাতরম্
যে কারণে এই বাংলার দিকে তাকিয়ে দেখুন, মহারাষ্ট্রের দিকে তাকান, বিপ্লবীরা হিন্দু, সশস্ত্র বিপ্লবীদের দলে মুসলমানদের হিসসেদারি, ভাগেদারি নেই বললেই চলে, ইংরেজরা তার ভরপুর সুবিধেও নিয়েছিল। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ভগৎ সিং প্রথম এই ধারণা কে ভাঙেন, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপানলিকান আর্মি তৈরি হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়, তখন যখন কংগ্রেসও আলাদা করে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কোনও কথা বলতো না। এবং এই বিপ্লবীদের একটা বিরাট অংশ জেল এ গিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসে, জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, সুবোধ রায় থেকে বহু বহু বিপ্লবী কমিউনিস্ট হয়, অন্যদিকে অনুশীলন সমিতির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি কে সঠিক মনে করে রেভেলিশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি, আর এস পি তৈরি করেন। স্বাভাবিকভাবেই তারাও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির শরিক হন। কিন্তু ঐ বিপ্লবীদের এক অংশ হিন্দুত্ববাদী হয়ে ওঠে সাভারকর, গোলওয়ালকর ইত্যাদিরা সেই ধারার প্রতিনিধি।
সাভারকর ইংরেজ হত্যা, হত্যার ষড়যন্ত্র, অস্ত্র যোগান দেওয়ার অপরাধে জেলে যান, গোলওয়ালকর অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, কিন্তু তিনি আর এস এস তৈরি করেন, সাভারকার হিন্দু মহাসভার নেতা হন। বিপ্লবীদের যে অংশ কমিউনিস্ট হল বা সোশ্যালিস্ট হল, তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধিতা চালিয়ে যেতে থাকেন, কখনও কখনও কংগ্রেসের ভেতরেও কাজ করতে থাকেন, কিন্তু যে অংশ হিন্দুত্ববাদী, তারা তীব্র কংগ্রেস বিরোধিতার জায়গা থেকেই ইংরেজদের বেশি কাছের লোক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন, আন্দামানে থাকাকালীন সাভারকার তার মুচলেকা পত্রে তো লিখেইছিলেন, আমাকে ছেড়ে দিলে আমি তো বটেই, আমি ছাড়াও যারা ইংরেজবিরোধী হয়ে উঠেছেন, সেইসব পথভ্রষ্টদের আপনাদের মহারানীর শাসনের অনুগামী করে তুলব। কাজেও তাই করেছেন। ওদিকে জিন্না পাকিস্তানের দাবি তুললেন, সাভারকার সায় দিলেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বললেন, কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এর পরে অনেক ছোট হলেও এই হিন্দু মহাসভা ছিল এক অন্যতম শক্তি।
এবার স্বাধীনতা আসবে এমন এক আবহাওয়া তৈরি হল, তার আগে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার গঠনের প্রশ্ন এল। এতদিন ইংরেজদের কোনও বিরোধিতা না করা হিন্দু মহাসভা কি তাহলে ক্ষমতার মধুভান্ড পাবে না? ১৯৩৭ এ সারা দেশে প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচন হল। সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে মাদ্রাজ, অসম, বিহার এমন কি সিন্ধ প্রদেশেও কংগ্রেসের জয়জয়কার, এ বাংলাতেও তারা সবচেয়ে বড় দল, কিন্তু কৃষক প্রজা পার্টি আর মুসলিম লিগ মিলে সরকার তৈরি হল, পরে মুসলিম লিগ সরে গেলে মিলিজুলি সরকারে এল কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা পার্টি, হিন্দু মহাসভার নেতা তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। এরপর ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আগে কংগ্রেস পদত্যাগ করলো, তখন মুসলিম লিগের সঙ্গে সরকারের সহযোগীকে? হিন্দু মহাসভা, যে জিন্নাহ নিয়ে এত কথা, সেই জিন্নাহের হাত ধরেছিল হিন্দু মহাসভা। কিন্তু সারা দেশে? সারা দেশে হিন্দু মহাসভার কোনও জায়গাই নেই, এদিকে স্বাধীনতা আসছে, ৪২ এর আন্দোলনে আর এস এস, হিন্দু মহাসভা ইংরেজদের দিকেই থাকলো খালি নয়, কিভাবে ৪২ এর আন্দোলন থামানো যায়, তার কথাও জানালো ইংরেজ সরকার বাহাদুরকে। কিন্তু তারপরেও স্বাধীনতা আসছে, খানিক ভাগ পাচ্ছে জিন্নাহ, মুসলিম লিগ, অনেকটাই পাচ্ছে কংগ্রেস, দেশ ভাগ ইত্যাদির পরেও কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা তখন দেখার মত।
ঠিক এই সময় থেকে বিষবৃক্ষ পোঁতা শুরু৷ এর আগেও ছিল না তা নয় কিন্তু ঠিক এই সময় থেকে লাগাতার প্রচার শুরু হল। প্রথম টার্গেট ছিল গান্ধী৷ যে মানুষটা শেষ দিন পর্যন্ত দেশভাগের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, সেই মানুষটাকে দেশভাগের জন্য দায়ী করা শুরু হল, খানিকটা সুবিধে তো ছিলই কারণ বহু সাধারণ মানুষ মনে করতেন, কংগ্রেস মানে গান্ধী, গান্ধী মানেই কংগ্রেস, কিন্তু সেটা তো শেষের দিকে আর ছিল না, জিন্নাহ, জিন্নাহের মত চলছেন, নেহরু – প্যাটেল হতাশ৷ ঠিক আছে তাই সই৷ দেশ ভাগ করেও স্বাধীনতা তো আসুক৷ এইরকম এক মনোভাব, গান্ধীজি একলা৷ এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হল, গান্ধী ছুটছেন পঞ্জাব, পটনা, বলছেন আমি এরপর লাহোর যাব৷ নোয়াখালিতে সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়ালেন৷ পটনায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের পাশে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের কংগ্রেসী নেতারা সরকার সামলাতে, উদ্বাস্তু সামলাতে নাজেহাল৷ ঠিক এই সময়টাতে দুটো প্রধান শত্রু হাত মেলাতে থাকল, এক হল আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা, দুই হল দেশের মধ্যে তখনও স্বাধীন হিন্দু রাজারা। গান্ধী দুজনেরই কমন এনিমি৷ গান্ধী দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে সমানে বলে যাচ্ছিলেন, বলছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। প্রচারের বন্যা বয়ে গেল, গান্ধীজি মুসলমানদের হয়ে কথা বলছেন, গান্ধীজি দিল্লিতে যে সব হিন্দু উদ্বাস্তুরা মসজিদ বা মাদ্রাসা দখল করে বসেছিল, সেগুলো খালি করার কথা বলছেন, পাকিস্তান দেশের শত্রু, কেন তাদের ৫৫ কোটি টাকা দেওয়া হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
গান্ধীজি যে কোনও ধর্মের উপাসনালয় জবর দখলের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন, কাশ্মীর আক্রমণের পরেই চুক্তিমত পাকিস্তানকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৫৫ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেস সরকার দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, গান্ধীজি বলেছিলেন এই টাকা না দেওয়া হলে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তান যা চাইছে, যা বলার চেষ্টা করছে, সেটাই প্রমাণিত হবে, কাজেই চুক্তিমত তাদের টাকা দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু তখনও, আজও গান্ধিজী প্রসঙ্গে এই অপপ্রচার থামেনি। এবং শেষ পর্যন্ত ওই প্রিন্সলি স্টেট, ওই আর এস এস হিন্দু মহাসভা আর প্রশাসনের এক অংশকে হাতে নিয়ে বিরাট নীল নকশা তৈরি হল। সুভাষচন্দ্র বসু যাঁকে রাষ্ট্রপিতা বলেছিলেন, সেই ৭৮ বছরের বৃদ্ধ মানুষের বুকে বিঁধল ব্যারেটা পিস্তলের ৩ টে গুলি। মারা গেলেন গান্ধিজী। বহু সন্ত্রাসবাদীদের ধারণা এটাই যে ব্যক্তিকে মারলেই উদ্দেশ্য সাধন হয়, যা আসলে হয় না, চে মরার আগে বলেছিলেন, মারো কাপুরুষ মারো, তোমরা বড়জোর একজন মানুষ কে হত্যা করবে, তার চেয়ে বেশি কিছুই নয়। হ্যাঁ আদর্শ বেঁচে থাকে, কেবল বেঁচে থাকেই না, আরও বড় হয়। গান্ধীজিকে মেরে ওই সাভারকর, হিন্দুমহাসভা, গডসে, আরএসএস আওনন্দিত হয়েছিল, মিষ্টি খাইয়েছিল, বিলি করেছিল, কিন্তু কদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল, মৃত গান্ধী আরও ভয়ঙ্কর। কাজেই গান্ধী মারা যাবার পরেও তাদের কোনও অগ্রগতিই হয় নি, বরং হিন্দু মহাসভার কলঙ্ক ঝেড়ে ফেলতে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে জনসংঘ তইরি করতে হল।
তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি, যেই মূহুর্তে কংগ্রেস দেশের মানুষের কাছে তার পরিচিত আদর্শের থেকে সরে উদার অর্থনীতি, কর্পোরেট পুঁজির দখলদারি এবং সংগের বাইপ্রডাক্ট, দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখন আরেকটা সুযোগ পেল ওই সাভারকর, গোলওয়ালকরের বংশধরেরা৷ প্রথমে শরিক দল নিয়ে পরে নিজের ক্ষমতায় রাষ্ট্রদখল করেই বিষাক্ত করে তুলেছে পরিবেশ, যেখানে এক ১৮/১৯/২০ বছরের কিশোর যুবক তার বাবার বয়সী মানুষকে রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করাতে পারে। এই বিষ ছড়াচ্ছে দ্রুত, সর্বত্র। কিন্তু আশার আলো কোনটা? আশার আলোও আছে, আবার ভিডিও টা দেখুন, দুটো জিনিষ লক্ষ্য করুন, এই ছেলেটির সঙ্গে আর কেউ কিন্তু নেই, যা করছে ও একলা করছে, আর আবার দেখুন, একজন কিন্তু, অন্তত একজন কিন্তু থামাতে এসেছে, ওইখানেই আশার আলো, ওই স্বর, ওই সংবেদনশীল মনের কাছে আমাদের পৌঁছতেই হবে, গান্ধী হত্যাকারী, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকদের প্রচারের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটা মানুষকে বলতে হবে ইশ্বর আল্লা তেরো নাম, সবকো সন্মতি দে ভগবান।