কেননা আমরা ফিরে পেতে চাই
আমাদের যত হৃত যৌবন
যে স্বপ্ন নিয়ে চোলাই যন্ত্রে
মদ্যের বিলাসিতা
কেননা দেশের যত ঘর বাড়ি
কলকারখানা ধানের খামার
মাঠ ঘাট পথ ফিরে পেতে চায়
তাদের জন্মদাতা।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা, নতুন বছরের শপথ। গত কয়েক বছরে অনেক কিছু হারিয়েছি আমরা, অনেক অনেক কিছু। আসুন সেই হারানোর হিসেব করি, আর যা যা হারিয়েছে, তা ফেরত নেবার শপথ নিই।
কী কী হারালাম আমরা গত কয়েক বছরে? আমরা হারিয়েছি আমাদের শাশ্বত সমাজ, যে সমাজে আজানের স্বরে ঘুম ভাঙত কৃষকের, গোয়ালঘরে গরুদের খাবার দিয়ে তারা বের হত মাঠের দিকে, অথবা সেই সমাজ যেখানে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে অনায়াসে মিশে যেত মাগরিবের আজান, গির্জার ঘন্টা। মন্দির বলত ওম শান্তি, সকলের শান্তি কামনা, মসজিদ বলত নামাজের জন্য এসো, অর্থ, সাফল্যের জন্য এসো, গীর্জা বলতো প্রভু করুণাময়, বি অ্যা গুড সামারিটান, আমরা তো সেই সমাজেই বড় হয়েছি।
সেই সমাজে ওস্তাদ কালে খাঁ গভীর রাতে হরির চরণে দিও প্রাণ, গাইতেন, বিলম্বিত লয়ে মালকোষের সেই মূর্ছনা তো আমরা শুনেছি, বিসমিল্লা খাঁ সাহেব বেনারসের ঘাটে আরতির সময়ে সানাই বাজাতেন, ভীমসেন যোশি গাইতেন আল্লাহ তেরো নাম, ইশ্বর তেরো নাম। গির্জা থেকে ভেসে আসত ফিল উইকহ্যামের গান, দিস ইজ আমাজিং গ্রেস, দিস ইজ আনফেলিং লভ, দ্যাট ইউ উড টেক মাই প্লেস, দ্যাট ইউ উড বিয়ার মায় ক্রস, এটাই তো ছিল আমাদের ছেলেবেলা।
লাল হলুদের সামাদ, আপ্পারাও, ধনরাজ, সালে বেঙ্কটেশ আর সবুজ মেরুনের হাবিব, মান্না, চুনি, নইম, সুব্রত ভট্টাচার্যদের ঘিরে আমাদের উন্মাদনা কি কম ছিল? আমরা দক্ষিণের তিরুপতিতে গেছি, পশ্চিমের আজমের শরিফেও গেছি, আমরা অশোক আর আকবরকে একই মর্যাদা দিয়েছি, দুজনেই প্রজা হিতৈষী রাজা, সম্রাট। এটাই তো ছিল আমাদের সমাজ, সে সমাজে ইশ্বর আল্লাহ তেরো নাম, সবকো সন্মতি দে ভগবান শেখানো হয়েছিল, আমরা তাই তো শিখেছিলাম।
গত দু দশকে সে সমাজকে ভাঙা হয়েছে, বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার শিরায় শিরায়, পড়ানো হয়েছে বিভেদের ধর্ম, শেখানো হয়েছে দাঙ্গার কায়দা কানুন, ধর্মসভার নাম করে বিষ উগরে দেওয়া হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেক স্তরে। যে সহজিয়া দর্শন আমাদের জীবনকে প্রসারিত করে, যে সুফি দর্শন আমাদের ভালবাসতে শেখায়, যে বৈষ্ণব দর্শন আমাদের বিনয়ী হতে বলে, সেই নানক, কবীর, চৈতন্যের দেশে এরা কারা? কারা বলে দেশের ১৮% মানুষ দেশদ্রোহী, বিধর্মী, তাদের বেনারসের গঙ্গার ঘাটেও আসা নিষেধ, যে গঙ্গার ঘাটে তুলসিদাস যখন রামচরিতমানস লিখছেন, তখন কবীর তাঁর দোহা রচনা করছেন, এরা কারা যারা ধর্মের কথা বলে মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে? এরা কারা যারা প্রকাশ্যেই বলে এ দেশে কেবল হিন্দুরাই থাকবে?
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ভারত আমার ভারতবর্ষ
আমাদের সেই শাশ্বত সমাজ হারিয়ে গেছে? আসুন সামনের দিনে সেই সমাজকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিই, দেশের সেই সবাকার সমাজকে ফিরিয়ে আনার শপথ, যেখানে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান, আমাদের ঠাকুর তো এই কথাই বলে গেছেন। এবং দেশপ্রেম, দেশকে ভালবাসা, দেশের জন্য যাঁরা প্রান দিয়েছেন, মুক্তির মন্দির শোপানতলে যত প্রাণ হয়েছে বলিদান, যাঁদের কথা লেখা আছে অশ্রুজলে, তাঁদের কথা মনে করেই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠা, আজ পুজো হচ্ছে জাতির পিতার হত্যাকারীর, নাথুরাম গডসের, পুজো হচ্ছে ইংরেজের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কাপুরুষ সাভারকরের, দেশপ্রেমের নামে এক জঙ্গী জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়িয়ে জেলে পোরা হচ্ছে কবি, লেখক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী শিক্ষকদের। গত দু দশক ধরে এই কাজ সন্তর্পণে করা হচ্ছিল, এখন তা প্রকাশ্যে।
বিরতির আগে যে কথা বলছিলাম তার সূত্র ধরেই বলি, দেশের মাথায় বসে থাকা এক অশিক্ষিত নেতা চুপ করে বসে তা দেখছেন, তা শুনছেন, তাঁর সায় আছে এই সব কাজে, এই জঙ্গী জাতীয়তাবাদের, জিঙ্গোইজমের আড়ালে গদি বাঁচানোর, গদি দখলে রাখার চেষ্টামাত্র,আর কিছুই নয়। আমার স্বদেশের ভূমি চীন জমি দখল করছে, তিনি পাকিস্তানে ঢুকে সার্জিকাল স্ট্রাইকের নাটক নাটক খেলছেন, দেশের সমস্ত পড়শি দেশের সঙ্গে সদ্ভাব গেছে চুলোর দোরে, তিনি বিশ্বগুরু হবার বাওয়াল চালিয়েই যাচ্ছেন, ঘোষণা করা হচ্ছে তিনিই নাকি পাকিস্তান কে মুঁহতোড় জবাব দেবেন, ভুলেই গেছেন এর আগে আমরা দু দুবার পাকিস্তানকে সম্মুখ সমরেই হারিয়েছি, তিনি তখন হাফপ্যান্ট পরতেন, আমাদের সেই ইতিহাসকে মুছে দিয়ে এক জঙ্গি নায়ক হবার ভান করছেন, আসুন আমরা সেই ইতিহাস তাঁকে মনে করিয়ে দিই, যিনি বিশ্বাসঘাতক সাভারকার, গোলওয়ালকরদের উত্তরসূরি।
সময় এসেছে, সেই এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্সের ভুয়ো ছাত্রকে দেশপ্রেমের পাঠ পড়ানোর, যে দেশপ্রেম আমরা শিখেছি ভগত সিং, আসফাকুল্লা, চন্দ্রশেখর আজাদের কাছ থেকে, যে দেশপ্রেম আমরা শিখেছি নেতাজীর কাছ থেকে, যে দেশপ্রেমের পাঠ নিয়েছি গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেলের কাছ থেকে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা থেকে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল থেকে নৌ বিদ্রোহ আমাদের ইতিহাস, দেশপ্রেমের ইতিহাস, আসুন সেই প্রকৃত দেশপ্রেমকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিই, প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি।
এবং সাংবাদিকতা, গত দু দশক ধরে যা নির্লজ্জ চাটুকারিতায় পর্যবসিত হয়ে উঠেছে, শাসকের পোঁ ধরা নির্লজ্জ চাটুকারিতা, শাসকের গলার স্বরে স্বর মিলিয়ে কথা বলার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা, সেই নির্লজ্জদের চিহ্নিত করি। যাদের কথা ছিল প্রশ্ন করার, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার, তাঁরা রোজ বিরোধীদেরই প্রশ্ন করে চলেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোনও প্রশ্ন নয়, বিরোধী নেতাদের দিকে আঙুল তোলাই যাদের নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে তাঁদের এবার প্রশ্ন করা যাক? কত টাকার বিনিময়ে, কোন চাঁদির জুতোর বিনিময়ে তাঁরা বিক্রি করেছেন সাংবাদিকতার পেশাকে, আসুন সেই প্রশ্ন তোলা যাক, প্রতিদিন সন্ধ্যেয় যারা কলতলা ঝগড়া দিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, যারা খবরের বদলে শাসকের প্রচারমুখ হয়ে উঠেছে, তাদের আসুন প্রশ্ন করি।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ফেউ
ফিরে আসুক আমাদের সম্প্রীতির সমাজ, ফিরে আসুক প্রকৃত দেশপ্রেম আর শিরদাঁড়া সোজা রাখা সাংবাদিকতা। তার মানে কি এই যে, এসব ফিরে এলেই আমরা এক দেশ ফিরে পাবো, যার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন? না, তা পাবো না। তবে তা পাবার ক্ষেত্রটা তৈরি হবে। সেখান থেকেই শুরু হবে পরের ধাপের লড়াই, অন্ন, জল, কাপড়, বাসস্থানের লড়াই, গণতন্ত্রের লড়াই, কাজের অধিকারের জন্য লড়াই, কৃষকদের ফসলের দামের জন্য লড়াই, শ্রমিকদের সঠিক মজুরির জন্য লড়াই, যে লড়াইয়ের শেষে এক সাম্য সমাজ আমরা পেতে চাই, যেখানে শ্রমের বিনিময়ে, ঘামের বিনিময়ে প্রত্যেকের জুটবে ততটুকু, যা তার দরকার।
পুঁজি আর মুনাফার এই গোলকধাঁধার বাইরে এক সাম্য সমাজ, কিন্তু সে তো অনেক দিনের কাজ। সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ; এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল; প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ, আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে, গড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে। তার আগে আপদ বিদেয় চাই, আপাতত যারা আমাদের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে, সেই ফাসিস্ট দস্যুরা, যারা আমাদের সমাজকে ভেঙে চুরে মধ্যযুগীয় বর্বতা ফিয়ে আনতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক ভালো মানুষকে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একজোট হয়ে দাঁড়াতেই হবে।
কালপুরুষের হাত থেকে তাই
জিজ্ঞাসা ছিঁড়ে এনে
প্রত্যেক মুখে জবাব লিখেছি
ঘোষণার অক্ষরে
এ দেশ আমার
আমাদের মাটি
এ দেশে যেখানে
যতকিছু খাঁটি
আমাদের কলকারখানা আর
আমাদের নদী খনি ও পাহাড়
আমাদেরই ভরা সোনার খামার
আমাদের ভাই আমাদের বোন
আমরাই যারা খাঁটি
আমাদের বুকে গড়েছি এবার
শেষ যুদ্ধের ঘাঁটি |
এ দেশের প্রতি মায়ের চক্ষে
আমারই বেদনা ঝরে
এ দেশের প্রতি শিশুর বক্ষে
আমারই স্বপ্ন মরে
আমারই রক্ত ঝরে কাকদ্বীপে
ডোঙাজোড়া মালদহে
ভরদ্বাজের হৃদয় পিণ্ডে
আমারই ধমনি বহে
তাই দেশে দেশে যত প্রতিরোধ
তারি মাঝে তুলি রক্তের শোধ
নানকিং আর প্যারির যুদ্ধে
আমরাই সাথে আছি
কাকদ্বীপে মরে আমরা আবার
তেলেঙ্গানায় বাঁচি।
আসুন নতুন বছরে সেই বাঁচার শপথ নিই।