কদিন আগেই মনে হচ্ছিল না? যে নরেন্দ্র মোদি অজেয়, মনে হচ্ছিল তাঁর অশ্বমেধের রথ অপ্রতিরোধ্য, মনে হচ্ছিল অনেকেরই যে, রাখলে উনিই রাখবেন, মারলে উনিই মারবেন। বিরোধীদের ছন্নছাড়া চেহারা বারবার বলে দিচ্ছিল, দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ, নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপি ইনভিন্সিবল। কারণ অনেকেই মাথায় রাখেন না, রাজনীতি, অন্তত সংসদীয় রাজনীতি হল, ওয়ান ডে ক্রিকেটের মত আনপ্রেডিক্টেবল, ৪০ বল বাকি, ১৯ রান করতে হবে, হাতে ৪ উইকেট, এ আর এমন কী ব্যাপার, আপনি নিজের দল হেরে যাচ্ছে ভেবে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন, ইডেন গার্ডেনের বাইরে আকাশবাণী ভবনের সামনে এসে শুনলেন, দুটো উইকেট পড়ে গেছে, আর কিছুক্ষণ পরে জানলেন, দু ওভার বাকি থাকতেই অল আউট।
হয়, এরকম হয়। আবার ধরুন হাতে মাত্র ৮ টা বল, ২৮ রান করতে হবে, তিনটে ছক্কা আর চারটে বাউন্ডারি মেরে জিতে গেল দল, এরকমও হয়। রাজনীতিতেও হয়। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ওখানে কারখানা হবে, হবেই, ওরা ৩৫, আমরা ২৩৫। ক’বছর আগেকার কথা? সারা রাজ্যে বামপন্থীদের এখন নোটার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, এ কি ভাবা গিয়েছিল? তবে এমনটা যে হতে চলেছে, রাজনীতিতে সেটা টের পাওয়া যায়, খানিক আগেই টের পাওয়া যায়, এ তো মোদিজীর ডিমনিটাইজেশনের ঘোষণা নয়, এরকমটা হতে চলেছে তার একটা আভাস পাওয়া যায়, আজ সেই আভাস আর ইঙ্গিত নিয়েই আলোচনা, ওপরে তো মনে হচ্ছে কঠিন বরফ, রক সলিড সরকার, আর এস এস – বিজেপি, তলায় কী হাল? সেখানে কি বুজকুড়ি উঠছে? সামথিং ইজ বয়েলিং? নাকি তলাতেও অতটাই শক্ত বরফের চাঁই, এই শীতঘুম আর কাটবে না। আজ তাই নিয়েই আলোচনা। ২০১৪ থেকে ২০১৯, এমন কী কাজ করেছেন নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদিজী? যার ফলে বিজেপি একাই ৩০৩ জন সাংসদকে জিতিয়ে নিয়ে আসল? কাজের মধ্যে ডিমনিটাইজেশন, যা নিয়ে মোদিজী তো কোনও কথা বলেনইনি, বিজেপির অন্য নেতারাও এ প্রসঙ্গে বলা বন্ধ করেছিলেন, জিডিপি নামছিল, বেকারি বাড়ছিল, তবুও কেন মানুষ ভোট দিলেন? মূলত দুটো কারণে। প্রথমটা হল বিরোধীদের ছন্নছাড়া চেহারা, আর দ্বিতীয় কারণ হল হিন্দু ভোটের মেরুকরণ, তীব্র মেরুকরণ। কিন্তু এই দুটো দিয়েও ২৪০/২৪৫ আসন এর বেশি পেতনা বিজেপি, যদি না পুলওয়ামার ঘটনা ঘটত, দেশের মানুষের মনে ঐ জঙ্গি জাতীয়তাবাদের স্লোগান দাগ কেটেছিল, পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে পারে বিজেপি, মোদিজী, এই বিশ্বাস কাজ করেছিল। সব মিলিয়ে ৩০৩, কিন্তু এবার? সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধির ভয়ঙ্কর চেহারা দেখছেন, প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম, পেট্রল ডিজেলের দাম, মাছ মাংসের দাম বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারি, চাকরি যাদের আছে, তারাও শঙ্কিত, কবে ছাঁটাই হবে, মাইনে কমে যাবে। নতুন চাকরি নেই, বেকারত্ব গত ৪০ বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ, দেশের অর্থনীতির কথা না বলাই ভাল। ওদিকে রাম মন্দিরের পর আর কোনও হিন্দু জাগরনের স্লোগান চাইলেও, তুলতে পারছেন না মোদিজী, স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায় ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, সেখানে যে কল্পতরু বৃক্ষ লাগালেন, তার দেখরেখ করনেওয়ালার লাশ পাওয়া গ্যালো, সঙ্গে বিভিন্ন কেচ্ছা।
চীন সীমান্তজুড়ে তার সেনা সমাবেশ করছে, ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে বলার মতো স্লোগান মোদিজীর গলায় নেই, ভাগ্যিস নেই, তিনি আলোচনা, সমঝোতা, শান্তির কথা বলছেন, সেসব দিয়ে জঙ্গি জাতীয়তাবাদের ঢেউ তোলা যায় না, পাকিস্তান এমনিতেই একঘরে, সেই সীমান্তে নতুন কিছু ঘটানো প্রায় অসম্ভব, অর্থাৎ সেই অস্ত্রও এখন অকেজো। এবং রাস্তায় কৃষকরা, কৃষি বিল তো পাশ হয়েছে, পড়ে আছে, লাগু করা তো দুরস্থান, তা নিয়ে উচ্চবাচ্যও নেই। সামনে উত্তরপ্রদেশের ভোট, যোগীজীকে না পারা যাচ্ছে গিলতে, না পারা যাচ্ছে উগরোতে, গলার কাঁটা হয়ে রয়ে গেছেন, এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে লখিমপুর খেরির কথা ভাবুন, দেশের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী হুমকি দিলেন কৃষকদের, কৃষকরা প্রতিবাদ জানাতে এল, তাদের গাড়ির চাকার তলায় থেঁতলে পিষে দিল, ঐ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে আর তার বাহিনী, সে জেলে নেই, গ্রেফতার করা হয়েছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে, বিরোধী দলের নেতাদের, রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা অখিলেশ যাদবকে ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না, সারা লখিমপুর খেরি, সীতাপুর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে, এরমধ্যে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তড়িপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে একটা কথাও শোনা গেছে? না। দেশের প্রধানমন্ত্রী ৫ জন কৃষকদের মৃত্যু নিয়ে একটা কথাও বলেছেন? না বলেননি, তিনি স্বাধীনতা নিয়ে আজ লখনউবাসীদের, দেশের মানুষকে জ্ঞান দিলেন, কোন স্বাধীনতা? যে স্বাধীনতার আন্দোলনে বিজেপির পূর্বসূরি আর এস এস, হিন্দু মহাসভা বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল, ইংরেজদের দালালি করেছিল, যে দল, যে সংগঠন জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল, সেই দলের নেতা স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তোলেন, স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন, তিনি আজ আবার লখনউতে স্বাধীনতা নিয়ে জ্ঞান দিলেন, লখিমপুর খেরিতে এলেন না, দেখবেনও না এই ভিডিওটা যেখানে স্পষ্ট কিভাবে হঠাৎই এসে গাড়ি কুচলে দিল আমাদের অন্নদাতাদের দেহ, বা দেখবেন না এই ভিডিও যেখানে স্পষ্ট, ঐ অভয় মিশ্রার গাড়ি থেকে নেমে পালাচ্ছে কাপুরুষের দল, আর তখনও একজন চাকার তলায় ছটফট করছে, লখিমপুর, সীতাপুর এখন অগম্য, সংবিধানের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে, সেখানে বিরোধী কন্ঠস্বরকে রুদ্ধ করা হয়েছে।
আর অন্যদিকে তাকিয়ে দেখুন, আমাদের দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া মেন স্ট্রিম মিডিয়ার দিকে, গতকাল সারাদিন তারা প্রচার করেছে বিরোধীরা নাকি লখিমপুর বেড়াতে যাচ্ছে, একজন সাংবাদিকও মারা গেছেন, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই, কারণ তাদের মালিক হয় বিক্রি হয়ে গেছে, নাহলে নিজেকে বিক্রি করেছে, না হলে ইডি আর ইনকাম ট্যাক্স, সি বি আই এর ভয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমকে গোদি মিডিয়া বানিয়ে বসে আছে, প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন না, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলছেন না, বিরোধীদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু এরই মধ্যে অন্য চেহারাও বেরিয়ে এল, দেশ দেখেছিল নাকি, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এই চেহারা, পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলছেন, একবার ছুঁয়ে দেখুন, পুলিশ সরে দাঁড়াচ্ছে, কতদিন পরে আমরা দেখলাম মাথায় লাল টুপি পরে অখিলেশ যাদব, তাঁর সমর্থকদের নিয়ে রাস্তায়, অজিত সিংহের ছেলে জয়ন্ত চৌধুরি রাস্তায়, ভীম আর্মির চন্দ্রশেখর পুলিশের চোখ এড়িয়ে লখিমপুরে, পঞ্জাব হরিয়ানার বিভিন্ন রাস্তায় বসে পড়েছেন কৃষকরা, দেশের প্রত্যেক বিরোধী দল মাঠে নেমেছে, মানুষ, গণতান্ত্রিক মানুষ, সংগঠন রাস্তায় এবং সরকার ব্যাকফুটে।
যোগিজী টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু এখনও অভয় মিশ্রা গ্রেপ্তার হননি। এবার ব্যাটল গ্রাউন্ড উত্তরপ্রদেশ, সেখানে যদি যোগী হেরে যায়, বা কোমও রকমে টায়ে টুয়ে শরিকদের নিয়ে সরকারও বানায়, তাহলেই ঐ রক সলিড আর এস এস – বিজেপি, মোদি সরকারের চেয়ার নড়বড় করতে শুরু করবে, কোনও গোদি মিডিয়া, কোনও সিবিআই, ইডি তাকে বাঁচাতে পারবে না, কেবল দেখার এই লড়াই বিরোধীরা কতদুর নিয়ে যেতে পারে, আর কতটা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, ইতিমধ্যেই শরিকদলের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, বরুণ গান্ধী নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে বিজেপি শব্দটাই উড়িয়ে দিয়েছেন, ওধারে জাতিভিত্তিক জনগণনা হচ্ছেনা, জানিয়ে দেওয়ার পর সেটাও বিহার থেকে গোবলয়ের প্রতিটা রাজ্যে অন্য অসন্তোষ তৈরি করছে, স্লগ ওভার চালু, মোদিজীর রথ থমকাচ্ছে, ইনভিন্সিবল মোদিজীকে নড়বড়ে দেখাচ্ছে, ছবি পাল্টাচ্ছে। হিন্দু ভোট মেরুকরণের রাজনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দেশে দাঙ্গা লাগবে, হিন্দু মানুষজনও মুল্যবৃদ্ধি, বেকারি আর বেহাল অর্থনীতির শিকার, তারাও ক্রমশ তাদের মূল চাহিদা নিয়ে চিন্তিত, হিন্দু রাষ্ট্রের স্লোগান আর দাগ কাটছে না, আমি একথা বলছি না যে খেলা ঘুরে গেছে, কিন্তু হাতে ৪০ বল থাকলেও, ঝপাঝপ উইকেট পড়া শুরু হয়েছে, ম্যাচ এখন ফিফটি, ফিফটি, যে কোনও সময়ে ম্যাচ ঘুরে যেতে পারে, জেতা ম্যাচ হাতছাড়া হতে পারে, অন্তত এই সময় তাই বলছে। দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ, এমনটা ভেবে যে শাসক নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, তাদের শাসন চুরমার হতে দেখেছি বহুবার, এখন তারই প্রতীক্ষা, কোথাও ঢাক বাজছে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ? ঠাকুর যাবেই বিসর্জন, ঠাকুরই যখন চিরটা কাল থাকতে পারেন না, ঠাকুরকেই যখন বিসর্জনের মুখোমুখি হতে হয়, তখন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজী চিরটা কাল টিকে যাবেন, একথা ভাবার কোনও কারণ নেই।