প্রিয়াঙ্কা গান্ধী লখনউ হয়ে লখিমপুর খেরি যাবার পথে গ্রেফতার হন, অখিলেশ যাদব যেতে চেয়েছেন, তাঁকে ঘরেই আটকে রাখা হয়েছে, ভূপেশ বাঘেলকে বিমানবন্দরেই আটকে রাখা হয়, তৃণমূল সাংসদরা আর ভীম আর্মির চন্দ্রশেখর আজাদ, পুলিশের চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়েছেন লখিমপুর খেরিতে, আজ অনেক বাধা অতিক্রম করে রাহুল গান্ধী পৌঁছেছেন লখিমপুর খেরি, আরও বিরোধী দলের নেতারা যাওয়ার চেষ্টা করছেন, বা যাবেন। এদিকে শিরদাঁড়া বিকিয়ে যাওয়া গোদি মিডিয়া, আররণব গোস্বামীর দল বিরোধীদের এই ঘটনাস্থলে যাওয়া বা যাওয়ার চেষ্টাকে নাটক বলছেন, বলছেন এসব নাকি রাজনৈতিক পর্যটনের অঙ্গ, তাঁরা নাকি পলিটিক্স করছেন। ওনাদের ভারি ইচ্ছে ছিল দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা, বেনিয়াগিরি করুক, ইডি আর সিবিআই-এর ভয়ে ঘরে বসে থাকুক, তা না করে, তাঁরা কেন লখিমপুর খেরিতে যাচ্ছেন, পলিটিক্স করছেন?
এটাই তাঁদের প্রশ্ন, সাংবাদিকতার নামে কলঙ্ক এই জানোয়ারেরা, সরকারকে প্রশ্ন করে না, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে না, এখন তাদের কাজ বিরোধীদের প্রশ্ন করা। এই রাজ্যে নন্দীগ্রামে গুলি চলেছিল, কৃষক মারা গিয়েছিল, তখন বিজেপি দলের প্রতিনিধিরা আসেন নি? ওড়িশার পিপলিতে আদিবাসী খুন হয়েছিল, বিজেপি নেতারা আসেননি? এই ক’দিন আগে নির্বাচনের সময় মোটাভাই, অমিত শাহ কেরালায় যাননি, দলিত মহিলার ধর্ষণ আর খুনের প্রতিবাদ করতে? সেটা পলিটিক্যাল ট্যুরিজম ছিল না? এই রাজ্যে নির্বাচনের পরে জগত প্রকাশ নাড্ডা আসেননি? নির্বাচনের পরে হিংসা খতিয়ে দেখতে?
আরও আগে ২৬/১১, তখনও তাজের ভেতরে অপারেশন চলছে, বাইরে এসে দাঁড়াননি নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি? বলেন নি যে সিকিউরিটি ল্যাপ্সের জন্য কে দায়ী, সেটা দেখা হোক, সেগুলো পলিটিক্স ছিল না? আসলে বিক্রি হতে হতে হতে এই গোদি মিডিয়ার সব অনুভূতিই উবে গেছে, তারা আজ হিজ মাস্টার্স ভয়েজ, মোদিজীর গ্রামোফোনের কুকুর। সরকারে বিরুদ্ধে থাকা দল, নেতা মানুষের বিপদে গিয়ে দাঁড়াবেন, এটাই তো স্বাভাবিক, তাঁরা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবেন, সেটাই তো উচিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।
২০১৪, মোদিজীর পাটনা সফরের আগে বোমা ফেটেছিল, মারা গিয়েছিল বেশ কয়েকজন, মোদিজী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, নালান্দায় মৃতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেই কেবল যাননি, তাদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা সহায়তাও দিয়েছিলেন, আজ ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রীকে লখনউ বিমানবন্দরের বাইরেই যেতে দেওয়া হল না, গোদি মিডিয়ার সাংবাদিকরা যোগী সরকারকে প্রশ্ন করলেন না, উলটে বিরোধীদের এই প্রতিবাদকে রাজনৈতিক পর্যটন বললেন, আরও কিছু পাবার আশায়, আরও বড় গাড়ি, বাড়ি আর সুযোগ সুবিধের তলায়, চাপা পড়ে মারা গেছে তাঁদের বিবেক, বোধ আর বুদ্ধি।
আসুন আজ তিনটে এইরকম তথাকথিত রাজনৈতিক পর্যটন নিয়ে কথা বলি, তার মধ্যে দুটো ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে, যখন সাভারকার, গোলওয়ালকরেরা ইরেজদের দালালি করতে ব্যস্ত, সেই সময়ের কথা। বিহার, উত্তর প্রদেশ, জুড়ে তখন তিন কাঠিয়ার চল। ইংরেজ নীলকর সাহেবরা জায়গায় জায়গায় নিলকুঠি করে বসেছে, হুকুম জারি হয়েছে, এক বিঘা মানে ২০ কাঠার ৩ কাঠাতে কেবলমাত্র নিল চাষ করতে হবে, কারোর ৩ বিঘে জমি থাকলে ৯ কাঠাতে নিল চাষ করতেই হবে, এই ছিল হিসেব। নিল চাষ করলে জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়, তাছাড়া ছোট চাষিদের সারা বছরের খোরাকি ধানের অভাব বাড়তে থাকে, কিন্তু নিলকর সাহেবের ফতোয়া, নাহলে নিলকুঠিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মার, চাবুকের মার। নিলকর সাহেব রা সেই গাছ এনে নিলকুঠিতে সেদ্ধ করে, নিল উৎপাদন হয়, ম্যঞ্চেষ্টায়ারের কাপড় কারখানার মালিকদের ৩০/৪০ গুণ দামে বিক্রি করে, কাপড় ধবধবে সাদা করার জন্য নীল দরকার, এটাই চলছিল। গান্ধিজীর কাছে খবর আসে, তিনি চম্পারণ যান, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জে বি কৃপালিনি, তখন সাংবাদিক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী ইত্যাদিরা গান্ধীজীকে নিয়ে যান, তিনি ওই চম্পারণের এক গ্রামে, বারহওয়া লখনসেন গ্রামে সন্ত রাউত নামে এক গ্রামবাসীর ঘরে গিয়ে ওঠেন, এই সেই সন্ত রাউত যিনি গান্ধিজীকে প্রথমবার বাপু বলে ডাকেন, পরবর্তীতে এই বাপুই হয়ে ওঠে গান্ধিজীর অন্য নাম, ওই তস্য গরীব কৃষকদের সঙ্গে থাকা শুরু করেন, কেবল তিনি নয়, তাঁর সঙ্গে কিছু স্থানীয় উকিল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ইত্যাদিরা, গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়, তাঁরা সম্মিলিতভাবেই নীল চাষ করতে অস্বীকার করবেন, ৬ দিনের মাথায় আন্দোলনের তীব্রতা দেখে, ইংরেজ পুলিশ ১৬ তারিখেই তাঁকে গ্রেফতার করে, বিচারালয়ে হাজির করা হয়, ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতেই পারছিলেন, কোনও আইনেই তাঁকে গ্রেফতার করে রাখা যাবে না, তাই তাঁকে ১০০ টাকার জরিমানা করা হয়, সবাইকে অবাক করে গান্ধিজী সেই জরিমানা দিতেও অস্বীকার করেন, শেষমেষ বিচারক তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, এরপর প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা হয়, তিনকাঠিয়া প্রথার বিলোপ হয়।
আজকের আররণব গোস্বামীরা থাকলে, আমি নিশ্চিত, গান্ধিজীর এই চম্পারণ সত্যাগ্রহকে রাজনৈতিক পর্যটনই বলত, কারণ এরা ক্ষমতার পা চাটা দালাল, ক্ষমতার সঙ্গেই, ব্রিটিশদের সঙ্গেই থাকত। এরপর ১৯২৫, চলুন গুজরাতে, গুজরাত তখন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মধ্যে পড়ে, ঐ গুজরাতের সুরাট অঞ্চলের এক ছোট্ট তালুক বরদৌলি, সেবার বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ৩০% ট্যাক্স লাগু করেছে ব্রিটিশ সরকার, কৃষকরা এসে হাজির হল বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে, বিহিত চাই। উনি প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, প্রচন্ড অত্যাচার নেমে আসবে, কৃষকরা তৈরি, তাদের ঘরের জিনিসপত্র, বাচ্চা আর বৃদ্ধদের পাঠিয়ে দিলেন, দূরে আত্মীয় স্বজনদের কাছে, আন্দোলন শুরু হল, খাজনা দেব না। যথারিতী গ্রেফতার, বরদৌলিতে হাজির হলেন বল্লভভাই প্যাটেল নিজে, সেখানকার কৃষক রমণীরা তাঁকে সর্দার বলে ডাকা শুরু করলেন, বল্লভভাই প্যাটেল, ওই বরদৌলি সত্যাগ্রহ থেকেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হলেন। ইংরেজরা ট্যাক্স ইন্সপেক্টর তো পাঠালেনই, তার সঙ্গে গেল পাঠান ফৌজ, তারা লুঠপাট, ভাঙচুর, মারধোর করলো, আন্দোলন ভাঙতে পারলেন না, বল্লভভাই প্যাটেলের বরদৌলি যাত্রা সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিল, সরকার মাথা নোয়ালেন, ট্যাক্স কমিয়ে ৬.০৩% করা হল, সেদিন বরদৌলিতে খুশির বান ডেকেছিল, এই এক আন্দোলন সর্দার প্যাটেলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, তাঁকে গান্ধিজীও সর্দার বলে ডাকা শুরু করেছিলেন, আজকের গোদি মিডিয়া সেদিন থাকলে, নিশ্চই এটাকেও রাজনৈতিক পর্যটনই বলত।
১৯৭৭, ইন্দিরা গান্ধী হেরেছেন, হিন্দি গোবলয়ে ধুয়ে মুছে সাফ, এমনকি রায়বেরিলিতে নিজেও হেরেছেন, সবুজ পাগড়ি রাজনারায়ণের কাছে। এর কিছুদিন পর বেলচি, বিহারের নালান্দা পাটনা জেলার একপ্রান্তে প্রত্যন্ত গ্রাম, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এল, ২৭ মে ১৯৭৭ সেখানে ১১ জন হরিজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল, তাদেরকে পিছমোড়া করে মাঠে আনা হল, সেখানে তাদের চিতা তৈরি ছিল, গুলি করে মারার পর চিতার আগুনে ফেলে দেওয়া হল, ২৭ মে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুবার্ষিকি।
একই ব্যাপার, কাউকে যেতে দেওয়া হবে না, কিছুদিন পরেই ইন্দিরা গান্ধী বললেন আমি পাটনা যাব, পাটনা গেলেন হঠাৎ, তারপর বললেন আমি বেলচি যাব, ৩১ জুলাই, ভয়ঙ্কর বর্ষা, বেলচি প্রায় অগম্য, প্রশাসন চুপ করে বসে মজা দেখছিল, ইন্দিরা রওনা দিলেন, প্রথমে গাড়ি কাদায় পড়ল, জিপ আনা হল, কিছুটা দূরে গিয়ে জিপের চাকা কাদায় বসে গেল, ট্রাক্টর আনা হল, ট্রাক্টর গাড়ি টানতে থাকল, খানিকটা দূরে গিয়ে ট্রাক্টরও আটকে গেল, সবাই তখন বলছেন, ফিরে চলুন, বেলচি তখনও অনেক দূরে, ইন্দিরা বললেন, যারা ফেরার ফিরে যাও, আমি হেঁটেই যাব, সবাই হাঁটতে শুরু করল, কিছুটা দূরে এক মন্দিরে একটা হাতি পাওয়া গেল, সবাই বলতে মাহুত রাজি হল বটে কিন্তু হাওদা নেই, তাতে কি? বিনা হাওদাতেই ইন্দিরা হাতির পিঠে চড়লেন, যারা হাতির পিঠে চড়েছেন, তাঁরা জানেন, হাওদা ছাড়া হাতিতে চড়া কী ভিষণ শক্ত। পেছনে কংগ্রেস নেত্রী প্রতিভা সিনহা, তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন বেলচি গ্রামে, ১ লা অগস্ট। কেবল বেলচি নয়, সেদিন দূর দুরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ এসেছিল, ইন্দিরাকে দেখতে, ওই বেলচি থেকেই ইন্দিরা আবার ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, ওই বিহার থেকেই, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন, আজকের লালু প্রসাদ, নিতীশ কুমাররা যে আন্দোলনের ফসল। মজার কথা হল, ফেরার পথে পাটনাতে ইন্দিরা গিয়েছিলেন, পাটনা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, সেখানে তখন ডায়ালিসিস নিচ্ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি ছিলেন জহরলালের খুব প্রিয়পাত্র, যাঁকে ইন্দিরা গান্ধী জেলে পাঠিয়েছিলেন, তিনি জয়প্রকাশকে প্রণাম করলেন, জয়প্রকাশ ইন্দিরাকে আশীর্বাদ করলেন, ইন্দিরা কাগজের প্রথম পাতায়, ইন্দিরার কাম ব্যাক। এটা কী ছিল? রাজনৈতিক পর্যটন? এটা ছিল পলিটিক্স, একজন রাজনীতিবিদ তো সেটাই করবেন, তিনি সেদিন সেটা সফলভাবে করেছিলেন। আজ, সেই সমস্ত আন্দোলনের ইতিহাস না জানা মুর্খ শিরদাঁড়াহীন গোদি মিডিয়া, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যটনে বের হন, তখন তাকে ডিপ্লোম্যাসি বলে চালান, বিরোধীরা আন্দোলন করলে, তাকে রাজনৈতিক পর্যটন বলে ঠাট্টা করেন, এগুলো মানুষ ভুলবে না, আমরা ভুলতে দেবো না।