দিন ১৫ আগের ছবিটা পুরো বদলে গেল! তখন সব সমস্যা ছিল ইংল্যান্ডকে ঘিরে। চলতি টেস্ট সিরিজে ব্রিটিশ দলের একের পর এক বোলার চোটের জন্য ছিটকে যাচ্ছিল। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় গ্যালারি থেকে আওয়াজ উঠছিল। দলের অলরাউন্ডাররা কাজেই লাগছিল না। ওই দলের অধিনায়ক জীবনের সেরা ফর্মে । একাই দলকে টানছিলেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি। কিন্তু নেতা হয়ে কিছু সিধ্যান্ত নেওয়ায়, সমালোচনা হজম করতে হয়।
আর উল্টো শিবিরে থাকা ভারতের? টেস্টে টস জিতে যদি কেউ বিপদে পড়েন, তিনি বিরাট কোহলি। ইংল্যান্ডে প্রথমবার টেস্টে টস জিতলেন। যা ন’টি প্রচেষ্টায় প্রথমবার। মনে হচ্ছিল , বুঝি ভাগ্যদেবী ভারতের দিকেই রইলেন। হেডিংলে। হল ঠিক উল্টোটা। প্রাকৃতিক আবহাওয়া বদলে গিয়ে রুটের দল প্রথমদিন সেই যে কোহলিদের কোণঠাসা করে দিল, তা চললো সাড়ে তিন দিন ধরে। ভারত সিরিজে এগিয়ে থাকার সুবিধা খোয়ালো। ম্যাচ হারল, বিশ্রী ভাবে।
টস প্রথমবার জিতে কোহলি মনে হয় বেশি উৎফুল্ল ছিলেন। তার নমুনা, ৪০.৪ ওভারে প্রথম ইনিংসে ৭৮ রানে আত্মসমর্পণ! সিরিজে প্রথমবার দুই ওপেনার ব্যর্থ। মিডল অর্ডারের সেই ব্যর্থতার অ্যাকশন রিপ্লে। শুরু থেকে পর্বত প্রমাণ চাপ, লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সামাল দেওয়ার কথা না ভাবাই ভালো। লর্ডসের সেই সামি – বুমরাহর লড়াই সবসময আশা করা উচিতই নয়। শূন্য রানে তাঁরা ফেরেন। এই ইনিংসে শেষ ৬ উইকেট ২২ রানে চলে গিয়েছিল প্রথম ইনিংসে। আর ৪১ রানে চলে গিয়েছিল দ্বিতীয় ইনিংসে।
যাঁর ব্যাটিংয়ে ভরসা রেখে বিশ্বের সেরা টেস্ট উইকেটকিপার সাহা সাজঘরে বসে, সেই ঋষভ পন্থ ইনিংসের পর ইনিংস ব্যর্থ। মাচো মেজাজে ব্যাট করে আউট হয়েই চলেছেন। যে সব শট খেলে আউট হচ্ছেন, কপিলদেব আঁতকে উঠছেন হয়তো। আগের টেস্টে বাজে শট খেলে ইডেন টেস্টে কপিলকে বাদ পড়তে হয়েছিল। ভারতীয় ক্রিকেটে তা ঘটেছে বহু আগে। কপিল যদি শাস্তি পেয়ে থাকেন দেশের মাটিতে, ঋষভ কেন বার বার একই ভুল করে পার পেয়ে যাচ্ছেন! ঋষভের জন্য কারা লড়ে যাচ্ছেন? কিসের খেলা এসব? কেন সমান সুযোগ ঋদ্ধিমানরা পাবে না?
আর উল্টো শিবিরের ছবিটা কী? সমস্যা ছিল ওপেনিং জুটিতে। শেষ টেস্ট নয়া ওপেনিং জুটি একশো রান যোগ করে বোর্ডে। আর নেতা রুট সেই শিখর গেঁড়ে ব্যাটিং করেই যাচ্ছেন। উল্টো দিকে ভারত দেখলেই বোধহয় তিনি ব্যাটিংয়ে বুঁদ হয়ে যান। ডেভিড মালান দলে ঢুকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কেমন আর দলের কেন তাঁকে দরকার। নুতন বল হাতে অ্যান্ডারসন বিশ্বের এখনকার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ( এমনটাই বলা হচ্ছে) কোহলিকে যে কষ্ট দিয়ে চলেছেন, তাতে ভারতের ব্যথা বাড়ছে। ইংল্যান্ডের মেজাজে মজা ভিড় করছে। রবিনসনের ম্যাচের সেরা হয়ে ওঠা, ওভারটনের উল্টো দিক থেকে চেপে ধরা – শক্তিশালী ভারতীয় ব্যাটিংকে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছে।
আজ থেকে হিডিংলের আমেজ নিয়ে পরের টেস্ট শুরু। ঘরের মাঠে সবচেয়ে সফল বোলার , দ্বিতীয় সেরা অলরাউন্ডার ক্রিস ওকস চোট সারিয়ে দলে ফিরছেন। এসবই মাথা ব্যথার কারণ হতে চলেছে বিরাট বাহিনীর।
ওকস ফ্যাক্টর :
অ্যান্ডারসন একদিকে থাকা মানে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানের মনে চাপ। ‘একে সাবধানে সমলাও, উল্টো দিকের বোলারকে আক্রমণ করে রান তোলো’। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। নিজেদের দেশে টেস্টে দলের অন্য কোনও বোলার নন, ওকস এন্তার উইকেট নিয়েছেন বেটার রেটে, কম রান খরচ করে। আবার ব্যাট হাতে নামলে দল গড়ে ৩০ রানের কমে পায়না। দুটি ম্যাচ তো অপরাজিত ১৩৭ আর ৮৪ রান করে দলকে জিতিয়ে নায়ক হয়েছিলেন।
এই সিরিজে তিন টেস্টে সাম কুরানের অফ ফর্মে (৭৯.৩ রেটে মাত্র ৩ উইকেট) থাকাটা ইংল্যান্ডের লোয়ার মিডল অর্ডার আর পুরনো বলে বোলিংটাকে জমাট বাঁধতে দিচ্ছে না। এই ওভালে ওকস তাই আটে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন।
নজরে কোহলি কোম্পানি:
ওভালে ভারতীয় দল কী হচ্ছে? সকলের আগ্রহ এখানেই আটকে। পারফরম্যান্স বিচার্য হলে, কোহলি বিশ্রাম পেতেন। ইশান্ত আর পন্থ – দুইজনের একই হল হওয়া উচিত। এখন এই দলে রবি শাস্ত্রী হেড কোচ, গ্রেগ চ্যাপেল নন। কাজেই অধিনায়ককে কড়া কথা শুনতে হয়না। দলের সহ অধিনায়ক রাহানে একটি করে ৫০ প্লাস ইনিংস খেলেন, আর পরের এক ডজন ম্যাচ খেলা নিশ্চিত করে রাখেন। ভবিষ্যতের কথা ভেবে, সূর্যকুমার, শার্দুল, ময়াঙ্কদের এগিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু দেশের অন্যতম সেরা – সফল অধিনায়ক সৌরভ এই জেনারেশন নেক্সট নিয়েই সফল হয়েছিলেন। তিনিই এখন বোর্ডের শীর্ষ কর্তা। বিসিসিআই সভাপতি। তিনি নিশ্চয়ই জেগে ঘুমোন না , এটা আমি জানি। সারাক্ষণ দেশের ক্রিকেটের উন্নতিতে নিয়োজিত প্রাণ। এবার নিশ্চয় তিনি সঠিক বার্তা দেবেন দলকে। পন্থ নয় সাহা আসুক। তাঁকে ব্যাটসম্যান ভাবা হোক। রুটকে রুখতে আসুক অশ্বিন।
ভারতের মিডল অর্ডার সবচেয়ে মাথা ব্যাথার কারণ। বাইরের দেশে খেলতে গেলে কোমরের জোর লাগে, এটা কোহলি – রাহানেরা আরও কতোদিন পর বুঝবেন? এই সিরিজে টিমের ৩,৪,৫,৬ নম্বরে খেলা ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় মাত্র ২৩.৪! পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, ২০০৯ সালের শুরুর থেকে এটা দ্বিতীয় খারাপ পারফরমেন্স। এর আগে এমন হাল হয়েছিল, ২০২০ সালে নিউজিল্যান্ডে। দুই টেস্ট গড় ছিল – ১৯.২ !
রুট ‘মার্চ’ চলছেই:
আক্ষরিক অর্থে এটাই চলছে। ইংল্যান্ড অধিনায়কের রানের রুট মার্চ। ১৫ বছরের রেকর্ড ভাঙতে চলেছেন। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রান করার রেকর্ড। ভাবতে লজ্জা হয়, টিম ইন্ডিয়ার ৩-৬ ( পূজারা, কোহলি, রাহানে, পন্থ) ব্যাটিং অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের মোট সংগ্রহকে একাই রান করে বহু পিছনে ফেলে এগিয়ে আছেন।
নেতা কোহলি এই টেস্টের আগেও সেই এক কথাই বলেছেন। ‘যদি ম্যাচে আমরা ২০ উইকেট না নিতে পারি তাহলে দুটো রেজাল্ট হতে পারে। আর সেভাবে আমরা খেলতেই নামি না।’ আর তিনি আঁকড়ে চলেছেন সেই প্রথম টেস্টের পন্থা। পাঁচ বোলার খেলবে। তাতে থাকবে -এক স্পিনার।
রাহানে’বিশ্রাম’নিন। এই বছর তিনি ১৭ টি টেস্ট খেলে ফেলেছেন। ব্যাটিং গড়:২১.০৬। সূর্যকুমারের টেস্ট অভিষেক হয়নি,হওয়া উচিত। আছেন হানুমা বিহারী।
শাস্ত্রী হেড কোচ। ঠিক করে দিন, অশ্বিন আর জাদেজা -জোড়া স্পিনারদের নিয়ে একটা টেস্ট তো খেলুন। দুজনই ভালো ব্যাট করেন। নমুনা প্রচুর। ইশান্ত ‘বিশ্রাম’ নিন। দলের খেলে চলা চার পেসারদের মধ্যে তিনিই পিছিয়ে এখনও। সামি-সিরাজ-বুমরাহ কিছু ঘটানোর সম্ভাবনা সবসময় জিইয়ে রাখেন। বিপক্ষের ‘রুট’ তাড়াতাড়ি উপড়ে ফেলে দেখুক, ব্রিটিশ বাহিনী কী করে।
পেসাররা তিন টেস্টে ১০০ ওভার করে বল করে ফেলেছেন। ওয়ার্ক লোড প্রচুর নিয়ে ফেলেছে। চতুর্থ – পঞ্চম টেস্টের মাঝে মাত্র ৩ দিনের ব্যবধান। এঁদেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। সামনে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে। এরাই তো ভরসা। শার্দুল ঠাকুর আছে। বল – ব্যাটে মজবুত। প্রসিদ কৃষ্ণাকে আনা হয়েছে। খেলবে তো?
এই ভারতীয় দলের একটা অভ্যাস হয়েছে – দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পাল্টা জবাব দিতে পারে। কোহলি তো বলেই যাচ্ছেন, করছেন কম। ‘আমরা একটা ম্যাচে যদি কিছু করে থাকি, আরও একটা ম্যাচে আবার তা করে দেখাতেই পারি’। আমরা তো সেটাই চাই। একটা ম্যাচে জিতে পরের ম্যাচ হারবো কেন?
শেষ টেস্টে হারের পর ভারতের নেতা বলেছেন, ‘এই টেস্টের পর আমাদের উপর সকলে আস্থা হটে গেছে। আমাদের কেউ আর ফেভারিট ভাবে না। এমন পরিস্থিতি আমাদের আরও ভালো কিছু করার রসদ জোগায়’।
দল ইংল্যান্ড:
প্রথম একাদশে ওকস আসছেন। কুরান বসবেন।
উইকেটরক্ষক – মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান বাটলার খেলবেন না। দলে সাম বিল্লিংসকে আনা হয়েছে। অলি পোপ আছেন। জনি বায়ারস্টোকেই
উইকেটের পিছনে দাঁড়াতে দেখা যাবে। দলে আরেক বাম হাতের ব্যাটসম্যানও এসে যাবে। বাটলার না থাকায় স্পিনার-অলরাউন্ডার মঈন আলিকে সহ অধিনায়ক করা হয়েছে।
দল ভারত:
এই টেস্ট ওভালে। এই মাঠের উইকেট স্পিনারদের সাহায্য করে। আশা করি, অশ্বিন দলে থাকছেন। রুট কে রোখার কাজ তাঁর হবে। জাদেজা ১০০% ফিট। যা ব্যাটিং তিনি তিন টেস্টে করেছেন,কম সুযোগে যা বল করেছেন-চোস্ত ফিল্ডিং তাঁর শক্তি যখন,তখন তাঁকে বসিয়ে অশ্বিন না হওয়া ভালো। আর জোড়া স্পিনার থাকলে, এক পেসার কমবে। টস আর আজ সকালের আবহাওয়ার হাল দেখে সিধ্যান্ত নেবে টিম ইন্ডিয়া। অর্থাৎ সেই’শোলে’সিনেমার কয়েন নিয়ে বসা!
ছবি: সৌ-টুইটার