মানুষ তো নয় গিনিপিগ! মরণাপন্ন, কিন্তু মরছে না। ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে! চলো খেলা করে দেখি! পাঁচ মিনিটের খেল। প্রাণবায়ুর গতি কমিয়ে দেখা যাক, কে মরে? কে বাঁচে? নিয়তির সঙ্গে হাডুডু। যমরাজকে সাপ-লুডো খেলায় বাজি ধরা। ফল, হাসপাতাল হল বধ্যভূমি। অসহায়-মুমূর্ষু ২২ জনের শ্বাস নেওয়ার বাতাস চুরি করে তাঁদের মৃত্যুর খাদে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার নারকীয় এক খেলা। কারণ নাকি স্থানাভাব, আর প্রতি সেকেন্ডের অক্সিজেন খিদে। তাই বেশি খেলে বাড়ে মেদের নীতিতে সামান্য ওজন কমানোর সিদ্ধান্ত। তাও কোথায়! হাসপাতালে? এতো হিটলারের পক্ষেও সম্ভব হয়নি, স্তালিনও শুনলে লজ্জা পেতেন, সাদ্দাম হোসেন হয়তো বলে ফেলতেন, তোবা, তোবা!
পৃথিবীতে গণহত্যার ইতিহাস সুদীর্ঘ। পদ্ধতি বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু, এমন ধারার হত্যাকাণ্ড সকলের মুকুটের কোহিনুর উপড়ে নিয়েছে। মৃতের পরমাত্মীয়রা গত দেড় মাস ধরে বিধাতাকে অভিসম্পাত করেছেন। কপালকে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু, বিধাতারই এ পরিহাস, কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল পাপের পূতিগন্ধময় রহস্য। যথারীতি আগ্রার পরশ হাসপাতাল এখন দর্শক ও পাঠক সংখ্যায় মোদী-মমতাকেও পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
একটু পিছন ফিরে তাকালে কি ভুল হবে? চলে যাওয়া যাক গ্রিসে কিংবা রোমে। চোখ বুজে দেখুন অ্যাম্পিথিয়েটার। মাঝে রয়েছে একদল কালো, কেউ বা শ্বেতবর্ণ ক্রীতদাস অথবা রাজদ্রোহী। হঠাৎই সম্রাটের নির্দেশে খাঁচা খুলে দেওয়া হল। বেরিয়ে এল ক্ষুধার্ত সিংহ, হায়নার দল। তাদের সঙ্গে লড়াই। নরমেধ দেখে অট্টহাসি সুসভ্য নাগরিক সমাজের।
ঘিঞ্জি শহর রোম। পাশেই প্রাসাদ। ভেসে আসে নাগরিক বস্তির দুর্গন্ধ, কলকাকলি। দিনরাত বিরক্তি লাগে নিরোর। শহরটার ছিরিছাঁদও আর মনে ধরছে না সম্রাটের। স্বপ্নের নগর পত্তন করতে হবে। রাতে লাগল আগুন। সম্রাটের সে কী আনন্দ! বাজিয়ে তুললেন বীণায় সুর, কণ্ঠে এল গান। আরও কিছু নিন্দুকে গাল পেড়ে বলে, হোমরের ‘ফায়ার অব ট্রয়ের’ থেকেও উৎকৃষ্ট বর্ণনাত্মক রচনা লেখার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আগুন ‘ধরানো’ হয়েছিল। ৬ দিন টানা ও তারও পরে আরও ৩ দিনের আগুনে নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ খাক হয়ে গিয়েছিল। এসব হল— আনন্দের ক্রীড়া। সম্রাটদের মনোরঞ্জনের বিষয়, যেন সুরার সঙ্গে নর্তকীর নৃত্যকলা দর্শন। আগ্রা ও মোঘল সম্রাটদের শহর। সেখানেও যে এরকম দুএকটা শাহেনশা-সুলভ বিকৃতাচার থাকবে, সেটা অস্বাভাবিক কী? মেজাজটাই তো আসল রাজা….।
এগুলো তো খেলাচ্ছলে হত্যা! অক্সিজেন বন্ধ করার সমতুল দমবন্ধ করে গণহত্যার দস্তাবেজও কম নেই। ১৮০৩ সালে হাইতি বিপ্লবের সময় ফরাসি বাহিনীর জেনারেল যুদ্ধবন্দির সংখ্যা কমাতে তাদের জাহাজের খোলে ভরে সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাস দিয়ে মারতেন। স্থানীয় আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে সংগ্রহ করা হতো সালফার। ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘নেপোলিয়ন্স ক্রাইম’ নামের একটি বইতে এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। পাপ চাপা থাকেনি। হিটলারের কুখ্যাত গ্যাস চেম্বারের প্রায় ১৪০ বছর আগে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। জার্মানির থেকেও এ ব্যাপারে বয়োজ্যেষ্ঠ হলেন আমাদের সকলের প্রণম্য আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে সকলের রেকর্ডকে তুড়ি মেরে উড়িয়েছেন মহামতী হিটলার। ১৯৩৯ সালের অক্টোবরে পোল্যান্ডের পোসেনে এর প্রথম ব্যবহার করেন হিটলার। বৃদ্ধ, পঙ্গু ও বোধশক্তি কম, এমন মানুষের সংখ্যা কমাতে কার্বন মনোক্সাইড ব্যবহার করা হতো বদ্ধ ঘরে। ১৯৪০ সালে এরকম ৬টি গ্যাস চেম্বার ছিল। পরবর্তীকালে ওই ধরনের মানুষের সঙ্গে সহমরণে পাঠানো হতো জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও পোল্যান্ডের ইহুদিদেরও।
’৪১ সালে এগুলো বন্ধ করা হয়। চলে আসে নয়া পদ্ধতি। তার নাম গ্যাস ভ্যান। খুবই সাধারণ পদ্ধতি। গাড়ির ধোঁয়া নিষ্কাশন পাইপকে ভ্যানের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে ইঞ্জিন চালু করে রাখা। এ জাতীয় উদ্ভাবনমূলক গবেষণায় নাৎসি জার্মানির সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি ছিল হাইড্রোজেন সায়ানাইড বেসড গ্যাস চেম্বার। পোল্যান্ডের নরক আউৎসভিৎজ ও মাজডানেক ক্যাম্প হল তার মধ্যে কুখ্যাত। যে বধ্যভূমে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মানুষ খুন করা হতো।
এসব তো গেল সম্রাটদের উল্লাস-উপকরণ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন নীতি। কিন্তু, পরশ! খামোকা মহড়ার নামে এতগুলো মৃত্যুন্মুখ প্রাণ কেড়ে নিল! পথের কুকুর, গোরু, ছাদের বাঁদরকেও যে দেশের মানুষ মুখের খাবার তুলে দেয়, সে দেশেই কী করে একটু বাতাসের জন্য লড়াই করা মানুষের নাক থেকে অক্সিজেন কেড়ে নিতে পারে কেউ! ২২ জন গিনিপিগ হয়তো এই গবেষণায় প্রাণ দিল, ঘাতক-গবেষকের জন্য কি ভারতীয় দণ্ডবিধি দ্বারা প্রণীত শাস্তিই যথেষ্ট! দু’একটি ক্ষেত্রে গণআদালত কি খারাপ কিছু?