খালিপদ ডাক্তার। আজ্ঞে না, ইনি একজন নয়, অসংখ্য, অনেক। এদের কেউ কেউ শহরে কোনও ডাক্তার বাবুর কাছে, কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করেছেন, কেউ শহরের কোনও হাসপাতালে ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেছেন, এঁরাই গ্রামের খালিপদ ডাক্তার। রাতবিরেতে ইনজেকশন দেওয়া, স্যালাইন দেওয়া, হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ড্রেসিং করে দেওয়া, সাধারণ অসুখ, জ্বরজারি, পেটব্যাথা, আমাশা, মাথাব্যাথার ওষুধ দেওয়ার কাজ করেন, গ্রামের কবিরাজ মশাইদের জায়গা নিয়েছেন এঁরাই, এদিকে এনারাই লিভার টনিক বা কাফ সিরাপের মত অনাবশ্যক ওষুধ দেন, এনারাই মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, এনারাই কাছাকাছি নার্সিংহোমের আড়কাঠি, রোগী পাঠালেই কমিশন, আপনার কঠিন অসুখ, আপনার মনে হচ্ছে ক্যান্সার বলে নার্সিংহোমে পাঠানোর পর সার্কাস শুরু, গ্রামে প্রায়শঃই মানুষ পাবেন, যাদের কিডনি স্টোন অপারেশন, গল ব্লাডার অপারেশনে ৮০ হাজার ৯০ হাজার খরচ হয়ে গেছে, এখন স্বাস্থ্য সাথী এসেছে, কিন্তু তাই নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি করার জন্য ওনারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, ডায়গোনেস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে মূলত গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, এনারা একদিকে ভালো অন্যদিকে জঘন্য ভূমিকায় আছেন, কিন্তু আছেন এবং আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবেই আছেন, এই খালিপদ ডাক্তারেরা।
আসলে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বললেই ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়গনিসিস, ইত্যাদি বুঝি, সবটাই ইনডিভিজুয়াল পার্সপেকটিভ থেকে, ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, মানে আমি একজন মানুষ, আমার অসুখ হলে ডাক্তার দরকার, ডাক্তার ওষুধ দিলে সেটা খেতে হবে, তিনি যেমন বলবেন তেমন পথ্য খেতে হবে, এবং এরফলে আমি সুস্থ হয়ে উঠবো, এটাই আমার কাছে, সাধারণভাবে আমাদের কাছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আসলে কিন্তু এর বাইরেও এক বিরাট পরিসর পড়ে থাকে, যেটা বাদ দিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, কারণ আমরা যাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলি, তার বাইরের বিরাট অংশকে আমরা এতদিন অবহেলা করে এসেছি, এবং তা জানা গেলো এই করোনা আসার পর, আসুন সেই জায়গাটা নিয়ে দু চারটে কথা বলা যাক। সেটা হল গণ স্বাস্থ্য, কমিউনিটি হেলথ। মানুষ ক্রমশঃ একে অন্যের ওপর বেশী বেশী করে নির্ভরশীল হচ্ছে, আর তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেটা কী? এখন কেবল আপনিই সুস্থ থাকলে চলবে না, কেবল নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য হাজার রকমের ওষুধ, ডাক্তার আর হাসপাতাল থাকলে হবে না, আপনি যে বাজারে যান, সেখানকার মাছওলা থেকে সব্জিওলা, আপনার ঘরের কাজের মাসি থেকে আপনার গাড়ির ড্রাইভার, আপনার অফিসের পিওন থেকে আপনার কল সারানোর লোকটা, এই প্রত্যেককে সুস্থ থাকতে হবে, তাঁদের সুস্থ থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করছে আপনার বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া, প্রমাণ আপনার সামনেই রয়েছে, করোনা ভাইরাস এসে সেই প্রমাণকে আরও স্পষ্ট করে দিল, আপনি একলা একলা বাঁচতে পারবেন না, হাজার রকমের স্বাস্থ্যকর খাবার, টনিক, ওষুধ খাবার পরে, আপনার ঘরে প্রতিটা জার্ম মেরে ফেলার যন্ত্র বসানোর পরে, আপনার ঘরে স্বচ্ছ দূষণ মুক্ত হাওয়ার ব্যবস্থা করার পরেও আপনার জ্বর হবে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে, হাসপাতালে বেড পেলেও, দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মেডিক্যাল সাপোর্ট পাবার পরেও আপনি ওঁ গঙ্গা হয়ে যেতে পারেন, দেওয়ালে লটকানো গাঁদা ফুলের মালা চড়ানো ফটোফ্রেম হয়ে যেতেই পারেন, যদি আপনার ড্রাইভার ভাইরাসটা বহন করে আনে, যদি আপনার খাস বেয়ারা সেই ভাইরাস গায়ে মেখে হাজির থাকে, অতএব শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, বিত্তবানরা সাবধান, আপনি যাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলছেন, সেটা ঠুনকো কাঁচের ঘরের মতন, এক ঘায়ে যে কোনও সময় চুরমার হয়ে যেতেই পারে, যাবে। কেবল ওহে পাঁচু তুমি হাত ধোওয়া প্র্যাকটিস কর, এই নাও স্যানিটাইজার, এটাকে মাস্ক বলে, না না মাক্স নয় মাস্ক বলে, এটা পরে থাকতে হবে, এটুকু বলেই ক্ষান্ত থাকলে হবে না, এটুকুতেই দায় সারলে হবে না, গণস্বাস্থ্যের ধারণা অনেক বড়। সেই কবে প্রাজ্ঞরা বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলে গেছেন, সর্বে ভবন্তু সুখিন,
সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,
ওম শান্তি, শান্তি শান্তি।
অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন, সকলে শান্তি লাভ করুন।
সব্বাই সুখি না হলে, আপনি একা একা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে বসে থাকলেও কোনও লাভ হবে না, সকলে যেন নিরাময় হয়, সেটাই গণস্বাস্থ্য। ওধারে দেখুন, ‘যিনি শান্তির পথের পথিক, যিনি অন্যের নিরাপত্তা বিধানে সর্বদা সচেষ্ট, যিনি পরের মঙ্গল কামনা ও হিত সাধনায় সদা ব্রতী; সর্বোপরি যিনি সৃষ্টিকুলের শান্তি রক্ষার জন্য মহান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃত ও যথার্থ মুসলিম।’
—সুরা তাওবা, কোরান অর্থাৎ ইসলামও ওই একই কথাই বলছে, অন্যের নিরাপত্তা, পরের মঙ্গল কামনা, ওইখানেই লুকিয়ে আছে গণস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি, সমাজের মঙ্গল।
যিশু আছেন, সামনে শিষ্যরা, একজন প্রশ্ন করলেন, কে তোমার পড়শি, এর উত্তর বাইবেল এই লিউক ১০:৩০ – ১০:৩৭ এ যিশু নিজেই তার উত্তর দিচ্ছেন, একটা গল্প বলছেন, যেখানে এক সামারিটান, পথের পাশে পড়ে থাকা এক অজানা অচেনা অসুস্থ মানুষকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে খাইয়ে, ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তুলছে। তিনি বলছেন ওই সামারিটান দেখিয়ে দিল কে তোমার প্রতিবেশি, যাও তাহলে মানুষকে সাহায্য করো, বি অ্যা গুড সামারিটান।
পৃথিবীর সব ধর্ম, মানবিকতার সব পাঠে আছে সবাইকে নিয়ে বাঁচার কথা, একসঙ্গে বাঁচার কথা। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, করোনা এসে সেটাই মনে করিয়ে দিল। মনে করিয়ে দিল যে তুমি একলা বাঁচতে পারোনা, সংক্রমণ যদি ছড়ায়, ভাইরাস তোমাকেও ধরে ফেলবে, কাজেই তোমাকে সুস্থ থাকতে হলে তোমার পরিবেশ, তোমার প্রতিবেশিকেও সুস্থ রাখতে হবে, সেটাই গণস্বাস্থ্য।
গণস্বাস্থ্য না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু সেটা হবে কী করে? আমাদের দেশে সেটা এক বিরাট সমস্যা, তার প্রধান কারণ আমাদের জনসংখ্যা আর আমাদের গ্রামের জীবন যাত্রার নিম্নমান। ধরুন কিউবা, ছোট্ট দেশ, তাদের প্রতি ১০০০ জনের জন্য ৬ জনেরও বেশি ডাক্তার আছে, গ্রিসে ৫.৪ প্রতি ১০০০ মানুষ, স্পেনে প্রায় ৫ জন, রাশিয়া ৪.৩, আমেরিকা ২.৫, ফ্রান্স ৩.৩, জার্মানি ৩.৮ জন ডাক্তার আছে প্রতি ১০০০ জন নাগরিকের জন্য। আমাদের দেশ? প্রতি ১৪৫৬ জনের জন্য এক জন ডাক্তারবাবু বরাদ্দ, ওয়ার্লড হেলথ অর্গানাইজেশন বলছে প্রতি ১০০০ জনের জন্য অন্তত ১ জন ডাক্তার থাকা উচিত, আমাদের ১০০০ জনের জন্য ৬৮, মানে একেরও কম জন ডাক্তার আছে। তাতেও সামলানো যেতো, কিন্তু আরও বড় সমস্যা হল আমাদের দেশের এই ডাক্তারবাবুদের উজ্জ্বলতমদের ভিড় কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ইত্যাদি বড় শহরে। তাঁরা বিরাট ডাক্তার, নামকরা ডাক্তার, মাঝেমধ্যে ভিডিও আপলোড করবেন, জ্ঞান গর্ভ সেসব ভিডিও। বাকি ডাক্তারদের সিংহভাগ বড়, ছোট মাঝারি শহরে, গ্রামে প্রতি ২০০০ মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তারবাবুও নেই, আদিবাসী এবং দরিদ্র অঞ্চলে এই ছবি আরও করুণ। তারপর যদিবা ডাক্তার আছে, তাও তিনি খাতায় কলমে, সপ্তাহে বড় জোর তিন দিন, গ্রামীণ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নেই, ওষুধ নেই। বেসরকারি ডাক্তারেরা গ্রামে যাবেন কেন? ডাক্তারি পাস করে পসার জমাতেই ৩৫ বছর, তারপরে গ্রামে পসার কই? রোগী আছে প্রচুর কিন্তু ফিজ দেবার ক্ষমতা নেই। অতএব হয় বাধ্য হয়ে না হলে গ্রামেই বাড়ি বলে না হলে সেবাই করবো বলে কিছু মানুষ গ্রামে থেকে যান। এই সমস্যা সহজে মেটার নয়, চোখের সামনেই শহর আরও ঝকঝকে তকতকে হচ্ছে, আরও সুবিধে, আরও রোজগার, আরও উন্নত জীবন মান। এ ছেড়ে কেনই বা ডাক্তারবাবুরা হঠাৎ গ্রামে যাবেন? তাঁরা রেড ভলেন্টিয়ার্সও নন, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজও নন। যদিও সরকারি মেডিক্যাল কলেজের একেক জন ডাক্তার বাবুর জন্য সরকারের, মানে আম আদমির ট্যাক্সের যে পরিমাণ পয়সা খরচ হয়, তা শুনলে চোখ কপালে উঠবে, ডাক্তার পিছু এই মুহূর্তে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা পাবলিক মানি, মানে আমাদের টাকা খরচ হয়। কিন্তু এতকিছু বলার পরেও তাঁরা গ্রামে আসবেন না, শহরে থাকার উপায় থাকলে আমার আপনার কতজনই বা গ্রামে থাকতো বলুন তো? একদিন দু দিন গ্রামে যাওয়া, আহা হা হা, গুলু গুলু কুচুকুচু, নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি— / গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। / অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি—
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি। / পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ— / স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ।
ওসব কবিতার জন্যই রাখা থাক। সারাবছর কাদা, সাপ, পোকা মাকড়, সিনেমা হল ২৪ কিলোমিটার দূরে, আলো গেলে ফিরবে দু’দিন পর, মাইক্রো ওভেন চলবে না, কেন ডাক্তারেরাই বা মরতে যাবেন? জোর করে পাঠানো হলে ওই সপ্তাহে তিন দিন। মন পড়ে থাকবে শহরে। তাহলে উপায়? উপায় ওই খালিপদ ডাক্তার। ১৯৬৫তে চীনে স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে মাও সে তুং ২৬ জুন এই বেয়ার ফুট ডাক্তারদের কথা বলেন, তার আগেই চীন বিপ্লবের সময়েই এই বেয়ার ফুট ডাক্তাররা কাজ শুরু করে, কিন্তু ১৯৬৮ থেকে চীনে বেয়ারফুট ডাক্তাররা এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেন।
এই খালিপদ ডাক্তারেরা হবেন ছাঁকনি, ছোটখাটো অসুখ বিসুখ তাঁরা সামলে নেবে, রাতবিরেতে ইঞ্জেকশন, স্যালাইন অক্সিজেন, তাঁরা সামলে নেবেন। জটিল অসুখ বিসুখের জন্য তো ডাক্তারবাবুরা রইলেন।
এই খালিপদ ডাক্তার যারা গ্রামে কোয়াক বলেই পরিচিত, তাঁদের প্রপার ট্রেনিং দিতে হবে, তাঁদের মান্যতা দিতে হবে, বাংলার সরকার নার্সদের চিফ মেডিক্যাল অফিসার করে গ্রামে পাঠাচ্ছেন, এও এক ভাল পদক্ষেপ, এরাও ওই খালিপদ ডাক্তারের দলেই থাকবেন। এভাবেই গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। গ্রামে ৫০০/৬০০ জন প্রতি একজন খালিপদ ডাক্তার এই গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থার যোদ্ধা হয়ে উঠবে। তবে হ্যাঁ এই সব কথা তাদের জন্য যাঁরা গোমূত্র খেয়ে রোগ নিবারণের কথা বলেন না, যাঁরা গোরুর দুধে সোনা খোঁজেন না, তাঁদের জন্য। তাঁদের নেতা নরেন্দ্র মোদী, শাহ, যোগী থেকে দিলীপ ঘোষকে এসব বোঝানোর কোনও মানেই নেই, ওরা গণ মানে সেই সম্মোহিত মানুষের কথা ভাবে যারা না খেতে পেয়েও রাম মন্দিরের জন্য ইট নিয়ে যাবে। ওদের কথা বাদ দিয়ে আসুন আমরা এক নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখি যেখানে প্রতিটা গ্রামে, অক্সিমিটার দেখার লোক থাকবে, থার্মোমিটার দেখার লোক থাকবে, প্যারাসিটামল দেবার লোক থাকবে, মানুষ অতিমারী মহামারী অতিক্রম করে সুস্থ জীবন কাটাবে আর আঙুল তুলে দেখাবে, ওই যে, আলপথ দিয়ে ওই যাচ্ছে খালিপদ ডাক্তার, যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, সময়ে অক্সিজেন টা লাগিয়ে দিয়েছিল, অক্সিমিটার দিয়ে দেখে সতর্ক করেছিল, ধূম জ্বরে প্যারাসিটামল দিয়েছিল। এই মে মাসেই কারা যেন আলো ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল, আসুন আজ শপথ নিই সেই ভালোবাসার আলো আবার জ্বালানোর, আজ ২৫ মে সেই শপথ নেওয়াই যায়, প্রতিটি গ্রামে তৈরি হোক খালিপদ ডাক্তার।