বিশ্ব কাপে যেমন নিজেদের দেশের মাঠে খেলা হলে সেই দেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভুরি ভুরি নজির আছে ইউরোতে তেমন নজির নেই বললেই হয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল নিজেদের দেশে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ফ্রান্স ইউরো আয়োজন করেছে দুবার। একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, একবার হয়নি। তাই রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় ইংল্যান্ড যখন লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইতালির বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলতে নামবে তখন এই ফ্যাক্টরটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। যদিও কাগজে কলমে এবারের ইউরো কোনও একটা দেশে হয়নি। এগারোটা দেশের বিভিন্ন শহরে হয়েছে খেলাগুলি। কিন্তু ইংল্যান্ড ফাইনালে ওঠার আগে যে ছয়টি ম্যাচ খেলেছে তার মধ্যে পাঁচটি ম্যাচ তারা খেলেছে ওয়েম্বলিতে। ফাইনাল নিয়ে সংখ্যাটি হবে ছয়। শুধু কোয়ার্টার ফাইনালটা তারা খেলেছে রোমে। তাই ইংল্যান্ডের কাছে এবারের ইউরো অনেকটা হোম টুর্নামেন্টই।
এবং ফাইনালে তার পুরো সুবিধেটা পাবে ইংল্যান্ড। অর্থাৎ গ্যালারির সমর্থন। এত দিন ওয়েম্বলিতে ষাট হাজার দর্শকের প্রবেশাধিকার ছিল। ফাইনালে সেটা হয়ে যাবে ৬৫ হাজার। ধরেই নেওয়া যায় এর মধ্যে কম করে ষাট হাজার দর্শক সমর্থন করবে তাদের দেশকে। তাদের মধ্যে কোনও একজন আবার লেজার রশ্মি দিয়ে ইতালির গোলকিপারের মুখে ফেলবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, যেমন তারা ফেলেছিল ডেনমার্কের গোলকিপার কাসপার স্কিমিশেলের মুখে। সেমিফাইনালের সেই ম্যাচে পেনাল্টি শট বাঁচাবার সময় স্কিমিশেলের মুখে ফেলা হয়েছিল লেসার রশ্মি। সে জন্য উয়েফা ইংল্যান্ডকে ৩০ হাজার ইউরো জরিমানা করেছে। সব মিলিয়ে ফাইনালের আগেই শুরু হয়ে গেছে বিতর্ক।
ইতালি অবশ্য এ সবের থেকে অনেক দূরে। ডেনমার্ককে হারিয়ে তারা ফিরে গেছে তাদের বেস ক্যাম্প ফ্লোরেন্সে। সেখান থেকে তারা সরাসরি নামবে লন্ডনে দুপুর বেলায়। টিমের সঙ্গেই লন্ডন আসবেন চোট পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়া ডিফেন্ডার লিওনার্দো স্পিনাজোলা। ইংল্যান্ডকে নিয়ে ইতালি যে খুব ভাবিত তা নয়। আবার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কথাও ভাবছে না। তাদের টিমে কোনও নায়ক নেই। টিমটাই নায়ক। তাদের গোল করার লোক অনেক। তারা গোল করেছে ১১টা। এই গোলগুলো এসেছে সিরি ইম্মোবাইল, লরেঞ্জো ইনসিগ্নে, ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি, মাত্তেও পেসিনা, ফেদেরিকো চিয়েসা এবং নিকোলা বারেল্লার পা থেকে। উল্টো দিকে ইংল্যান্ডের দশটা গোলের মধ্যে আটটাই করেছেন দুজন। হ্যারি কেন চারটি, রহিম স্টার্লিং চারটি। এতে কেন বা স্টার্লিংয়ের সমর্থকরা উল্লিসিত হতে পারেন, কিন্তু গোল করার জন্য যে এই দুজনের উপর ইংল্যান্ড একটু বেশিই নির্ভরশীল এটাই বেশি করে প্রকট হয়।
আসলে দুটো টিমের দর্শনই আলাদা। ডিফেন্সিভ ফুটবলের খোলস ছেড়ে ইতালি এবার প্রথম থেকেই অ্যাটাকিং ফুটবল খেলছে। ব্যাক ফোরকে অটুট রেখে তারা মাঝ মাঠে তিন জন এবং সামনে তিনজন ফরোয়ার্ড নিয়ে মাঠে নামছে। মাঝ মাঠের সেরা হলেন ব্রাজিলজাত জর্জিনহো। সামনে গিয়ে এবং পিছিয়ে এসে তিনি অনবদ্য খেলছেন। তাঁর দু পাশে বারেল্লা এবং ভেরাত্তি সারাক্ষণ সচল থাকছেন। এবং এই তিনজনের জন্যই গোল করার বল পাচ্ছেন চিয়েসা , ইম্মোবাইল এবং ইনসিগ্নে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও এই রণনীতি নিয়েই খেলবেন রবের্তো মানচিনি, যিনি অ্যাটাকিং ফুটবল খেলে ইতালি ফুটবলের দর্শনটাই বদলে দিয়েছেন। এই ইতালি চ্যাম্পিয়ন হলে চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের দেশে অন্য রকম ফুটবল দর্শন শুরু হবে।
ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট আবার ডিফেন্স আগে, তার পর অ্যাটাক নীতিতে বিশ্বাসী। তাই ব্যাক ফোরের সামনে তিনি রাখছেন দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার ডেকলান রিসে এবং কলভিন ফিলিপসকে। বাইশ বছরের রিসে খেলেন ওয়েস্ট হ্যামে। আর পঁচিশ বছরের ফিলিপস খেলেন লিডস ইউনাইটেডে। এই দুজন ডিফেন্সিভ ব্লকার হিসেবে ইংলিশ ডিফেন্সকে একটা আলাদা বর্ম পরিয়ে দিয়েছেন। যাতে জন স্টোনসের নেতৃত্বে ব্যাক ফোর অনেক নিশ্চিন্তে খেলতে পারে। তাদের সামনে আছেন তিন অ্যাটাকিং প্লেয়ার। মেসন মাউন্ট, বুকোয়া সাকা এবং রহিম স্টার্লিং। সামনে সিঙ্গল স্ট্রাইকার হ্যারি কেন। ইতালির ফ্রি হুইলিং ফুটবলের সামনে ইংল্যান্ডের আলট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল কীভাবে সামাল দেয় তার উপর নির্ভর করছে ম্যাচের ভাগ্য।
তবে ইংল্যান্ড আল্ট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল খেললেও আলাদা করে বলতে হবে রহিম স্টার্লিংয়ের কথা। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির এই উইঙ্গার গোল করতে এবং করাতে সমান দক্ষ। ডান দিক থেকে বল নিয়ে দৌড়ে তিনি কাট করে যখন ভেতরে ঢোকেন তখন বলের জন্য অপেক্ষা করেন তাঁর সতীর্থরা। কিন্তু স্টার্লিং যতক্ষণ না অবধি নিশ্চিত হচ্ছেন তাঁর বাড়ানো বল ধরে সেই সতীর্থ গোল করার মতো জায়গায় থাকবেন ততক্ষণ বল রিলিজ করেন না। এটা সেলফিস ফুটবল নয়, কনসাস ফুটবল। ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হলে তো বটেই না হলেও স্টার্লিং কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে ডার্লিং হয়ে গেছেন।
আরও দুজনের কথা বলতে হবে। দুই দলের গোলকিপার জিয়ানলুকা দোনারুমা এবং জর্ডন পিকফোর্ড। এ সি মিলানের দোনারুমার বয়স মাত্র ২২। এই বয়সে তিনি যা ম্যাচিওরিটি দেখাচ্ছেন তাতে ইউরো শেষ হওয়ার আগেই বিশ্ব ফুটবলের দর্শকদের নজর কেড়ে ফেলেছেন তিনি। ইতালির বিশ্বজয়ী দলের গোলকিপাররা ছিলেন অনেক পরিণত। দিনো জফ কিংবা জিয়ানলুকা বুফোঁরা যখন ফর্মের শীর্ষে ছিলেন তখন তাদের বয়স প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। সেই তুলনায় দোনারুমা একেবারে বাচ্চা ছেলে। কিন্তু এই ছেলেটার উপরেই ভরসা করে ম্যাচের পর ম্যাচ জিতে যাচ্ছেন মানচিনি। তাঁর টিম এখন ৩৩টি ম্যাচে অপরাজিত যার মধ্যে টানা ষোলটি ম্যাচ জিতেছে তারা। উল্টো দিকে লিডস ইউনাইটেডের জর্ডন পিকফোর্ড তো প্রথম পাঁচটা ম্যাচে গোলই খাননি। গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র একটি গোল খেয়েছেন পিকফোর্ড। চ্যাম্পিয়ন হলে তিনিও ব্রিটিশ ফুটবলে নায়কের মর্যাদা পাবেন।
তার মানে কী দাঁড়াল? রবিবারের ফাইনালে কে ফেভারিট? ফুটবল তো গোলের খেলা। গোল করার লোক বেশি বলে ইতালিকেই সামান্য হলে এগিয়ে রাখতে হবে। তবে ইংল্যানহ চ্যাম্পিয়ন হলে সেটা কিন্তু অঘটন হবে না। তা হবে পরিকল্পিত ফুটবলের নায্য পাওনা।