সাফ কাপে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যে খুব একটা কৃতিত্বের স্বীকৃতি পাওয়া যায় না কোনও কালেই। সেই ১৯৯৩ সালে ভারত যখন প্রথম সাফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তানে, তখনও নয়। আর কদিন আগে ভারত যখন অষ্টম বার চ্যাম্পিয়ন হল মালদ্বীপে তখনও নয়। ব্যাপারটা যেন পেনাল্টি শটে গোল করার মতো। করলে ভাল। আর গোল করতে না পারলে ছি ছিক্কার। এ বারের টুর্নামেন্টে পাকিস্তান ছিল না, ছিল না ভুটান। সব মিলিয়ে পাঁচটা টিম ছিল। তা প্রথম দুটি ম্যাচে যখন ভারত বাংলাদেশ এবং শ্রী লঙ্কাকে হারাতে পারল না, তখন খানিকটা গ্যাল গ্যাল রব উঠেছিল। কিন্তু তারপর সুনীল ছেত্রীর দল পর পর দুটো ম্যাচে নেপাল (১-০) এবং মালদ্বীপকে (৩-১) হারিয়ে যখন ফাইনালে আবার নেপালের মুখোমুখি হল তখন তারাই ছিল ফেভারিট। গোল শূণ্য প্রথমার্দ্ধের পর পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে ভারত এগিয়ে গেল ২-০। পরে আরও একটা গোল করে জিতল ৩-০ গোলে। এবং ইগর স্টিমাচের কোচিংয়ে প্রথম বার কোনও ট্রফির মুখ দেখল।
গোটা টুর্নামেন্টে ভারত গোল করেছে আটটি। এর মধ্যে সুনীল ছেত্রীই করেছেন পাঁচটি গোল। এবং পাঁচটি গোল করার পথে তিনি ছাপিয়ে গেছেন ফুটবল সম্রাট পেলেকে (৭৭)। এবং ছুঁয়ে ফেলেছেন লিওনেল মেসিকে (৮০)। ছেত্রীর বয়স এখন ৩৭। ফুটবল জীবন প্রায় শেষের মুখে। সম্ভবত ২০২৩-এর এশিয়ান কাপের পরেই তিনি অবসর নেবেন। ভারত অবশ্য যদি কোয়ালিফাই করে। কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ম্যাচগুলি শুরু হবে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। তবে ভারত কাদের সঙ্গে খেলবে তা এখনও জানা যায়নি। শোনা যাচ্ছে ভারতের গ্রুপের দলগুলি খুব একটা শক্তিশালী হবে না। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে মোট ২৪টি দলকে চারটি পটে ভাগ করা হয়েছে। ভারত আছে এক নম্বর পটে। তাদের সঙ্গে আছে উজবেকিস্তান, বাহারিন, জর্ডন, কিরঘিস্থান এবং প্যালেস্টাইন। এই টিমগুলোর ফিফা র্যাঙ্কিং ৮৪ থেকে ১০৭। বাকি যে তিনটি পট আছে তাদের র্যাঙ্কিং আরও নীচে। সবচেয়ে নীচে আছে শ্রী লঙ্কা। যেহেতু ভারত আছে এক নম্বর পটে, তাই ভারতের যখন গ্রুপিং হবে তখন ভারত তাদের চেয়ে নীচের র্যাঙ্কিংয়ের টিমের সঙ্গেই খেলবে। ভারতের গ্রুপে কারা পড়বে তা জানা যাবে ২২ অক্টোবর। প্রতি গ্রুপে থাকবে ছটি টিম। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন সরাসরি কোয়ালিফাই করে যাবে। আর ছটি গ্রুপের রানার্সদের মধ্যে সেরা দুটি দেশ যাবে মূল পর্বে। মোট ২৪টি দেশ নিয়ে ২০২৩-এর জুন-জুলাইয়ে হবে এশিয়ান কাপ। আসলে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনও চায় ভারত এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলুক। তাতে ভারতের মতো দেশে কোটি কোটি মানুষ এশিয়ান কাপ টিভিতে দেখবে। ভারত প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোতে পারবে কি না তা নিয়ে অবশ্য কারুর কোনও হেলদোল থাকবে না। এশিয়ান কাপের মূল পর্বে ভারত উঠেছে সেটাই বড় কথা।
ইদানীং কালে ভারত এশিয়ান কাপের মূল পর্বে উঠেছে ১৯৮৪, ২০১১ এবং ২০১৯। তিনটি এশিয়ান কাপে ভারত জিতেছে মোটে একটি ম্যাচ। সেটা ২০১৯ সালে তাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪-১ গোলে যাতে সুনীল ছেত্রীর জোড়া গোল ছিল। এখন দেখার ভারত এবার এশিয়ান কাপের মূলপর্বে উঠতে পারে কি না। ভারতের এই টিমটা একগাদা নতুন ছেলেদের নিয়ে তৈরি। অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী ছাড়া অভিজ্ঞ বলতে আছেন গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধু এবং অমরিন্দর সিং, ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গন, প্রীতম কোটাল, উইঙ্গার উদান্তা সিং, মিডফিল্ডার অনিরুদ্ধ থাপার মতো কয়েকজন। বাকিরা সবই নতুন। বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনে সুনীলের সঙ্গে যোগ্য পার্টনার কেউ নেই। ২০০৫ থেকে দেশের জার্সি গায়ে খেলছেন সুনীল। তখন তিনি ছিলেন বাইচুং ভুটিয়ার পার্টনার। বাইচুং শুরু করেছিলেন আই এম বিজয়নের পার্টনার হিসেবে। ভারতের জার্সি গায়ে বিজয়ন-বাইচুং প্রচুর ম্যাচ জিতেছেন। আবার সুনীল ছেত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাইচুং-ও প্রচুর ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারতকে। কিন্তু ২০১১ সালে বাইচুংয়ের অবসরের পর সুনীল ছেত্রী কিন্তু সে রকম ভাল পার্টনার পেলেন না। এখন যিনি তাঁর সঙ্গী সেই মনবীর সিং তো একেবারেই পাতে দেওয়ার মতো নয়।আর সুনীলেরও তো বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে তো আগের ফ্লেক্সেবেটি আশা করা অন্যায়। তাই ইগর স্টিমাচের কাজটা কঠিন হয়ে গেছে।
তবে প্রায় দু বছরের মতো ভারতীয় দলের হেড কোচ স্টিমাচ এখন পর্যন্ত দারুন কিছু কোচিংয়ের নিদর্শন রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর কোচিংয়ে ভারত বিশ্ব কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ম্যাচগুলিতে তেমন দাগ রাখতে পারেনি। বিশ্ব কাপে ভারতের কোয়ালিফাই করা দিবা স্বপ্নের মতো ছিল। এখনও আছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাকি টুর্নামেন্টগুলিতে স্টিমাচের পারফরম্যান্স খুব ভাল কিছু নয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর কোচিংয়ে ভারত যদি এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করে সেটাই হবে বড় পাওয়া। তাই সাফ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশেষভাবে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। সুনীল ছেত্রী-ইগর স্টিমাচদের আসল পরীক্ষা এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন করা।